১০ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১:১০

ছিনতাইকারীরা বেপরোয়া

তখন সন্ধ্যা। সড়কবাতি জ্বলতে শুরু করেছে মাত্রই। সড়ক গাড়িতে ঠাসা। আশপাশে ফুটপাতের দোকানিরাও কর্মব্যস্ত। এর মধ্যেই ‘ধর ধর...আমার মোবাইল ফোন নিয়ে গেল’ বলে এক তরুণীর চিৎকার। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মোটরসাইকেল আরোহী ছিনতাইকারী পালিয়ে যায়। গত ৫ মে ধানমণ্ডি ২৭ নম্বর সড়কের সাতমসজিদ সড়ক প্রান্তে মোহাম্মদপুর এলাকায় এই ঘটনা ঘটে।

ঘটনার পরপরই ওই এলাকায় গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শুধু রাতে নয়, দিনের বেলাও ওই এলাকায় মাঝেমধ্যেই এ ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। আওরঙ্গ নামের স্থানীয় এক দোকানি কালের কণ্ঠকে জানান, শুধু এপ্রিল থেকে ওই দিন পর্যন্ত ওই এলাকায় অন্তত ১৫টি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে।

জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ওসি আব্দুল লতিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে আমরা পুলিশের টহল বাড়িয়েছি। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিনতাইপ্রবণ স্থান চিহ্নিত করেছি। এর মধ্যে ২৭ নম্বরের সড়কের সাতমসজিদ সড়ক প্রান্তসহ আরো তিন-চারটি স্থান আছে আমার থানা এলাকায়।’

ছিনতাইয়ের এই চিত্র শুধু মোহাম্মদপুর এলাকায়ই নয়, রাজধানীর প্রায় সব থানা এলাকায়ই ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। পুলিশের গোয়েন্দা শাখার তথ্য মতে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) আওতাধীন এলাকায় অন্তত ৩৫৮টি স্পট রয়েছে, যেখানে ছিনতাইকারীরা সক্রিয়।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীগুলোর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পাশাপাশি অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, করোনার কারণে মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ায় বাড়ছে ছিনতাইসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ। এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আগামী দিনে এ ধরনের অপরাধ আরো বাড়বে মনে করছেন তাঁরা।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার (ডিএমপি) মুহা. শফিকুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বরাবরই বিচ্ছিন্নভাবে কিছু ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। করোনার কারণে মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়াও এটার একটা কারণ। তবে সার্বিকভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত আছে।’

গত ৩০ মে সন্ধ্যায় বিজয় সরণিতে গাড়িতে বসা পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের হাত থেকে তাঁর আইফোন সেটটি ছোঁ মেরে নিয়ে যায় এক ছিনতাইকারী। ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনাটি মন্ত্রী নিজেই সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। এরপর গত সাত দিনেও ওই ফোনসেটটি উদ্ধার হয়নি।

গত মঙ্গলবার জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে এনইসি সম্মেলনকক্ষ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় পরিকল্পনামন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে যাওয়ার পথে বিজয় সরণিতে গাড়িতে বসে মোবাইল ব্রাউজ করছিলাম। এ সময় হুট করে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কেউ একজন মোবাইল নিয়ে দৌড় দেয়। এ বিষয়ে কাফরুল থানায় অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার আ স ম মাহতাব উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই ছিনতাইকারী শনাক্ত হয়েছে। সে একজন মাদকসেবী। সে ওই এলাকার ফুটপাতে ঘুমাত। ওই এলাকায় কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল না। তাকে গ্রেপ্তার করে মোবাইলটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।’

কাফরুল থানার ওসি মো. সেলিমুজ্জামান বলেন, ছিনতাই হওয়া ওই মোবাইল ফোনসেটটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, ‘শুধু আমরা নই, পুলিশের বিভিন্ন শাখার সবাই মিলে চেষ্টা করছি, কিন্তু এখনো ফোনটি উদ্ধার হয়নি।’

গত ৪ জুন রাজধানীর খিলগাঁওয়ে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আবুল কালাম আজাদ ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। ছিনতাইকারীরা তাঁর কাছ থেকে কিছু আম, দুই হাজার ৮৫৫ টাকাসহ মানিব্যাগ ছিনিয়ে নেয়। এর আগে গত ২৩ এপ্রিল সাংবাদিক সিয়াম সারোয়ার জামিলের কাছ থেকে মোবাইল ফোনসেট, ঘড়ি ও টাকা ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা।

গত ৫ মে ভোরে রাজধানীর কমলাপুর বিআরটিসি বাস ডিপোর পাশ দিয়ে রিকশায় করে কর্মস্থলে যাওয়ার পথে পরিচ্ছন্নতাকর্মী সুনিতা রানীর ভ্যানিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। ব্যাগ ধরে ছিনতাইকারীরা টান দিলে রিকশা থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পান সুনিতা। এরপর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। পরদিন ৬ মে কুড়িল ফ্লাইওভারে দুবাইপ্রবাসী সুভাষ চন্দ্র সূত্রধরের লাশ উদ্ধার করা হয়। পুলিশের তদন্তে জানা গেছে, ছিনতাইকারীরা তাঁকে হত্যা করেছে। এর কয়েক দিন আগে দিনদুপুরে যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা মোড়ে জাহিদ হাসান নামের এক ব্যবসায়ীকে ছুরি দেখিয়ে টাকা ও মোবাইল ফোনসেট ছিনিয়ে নিয়ে যায় একদল ছিনতাইকারী।

এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি রুনা আক্তার নামের এক গৃহবধূ মধ্য বাড্ডা এলাকায় ছিনতাইয়ের শিকার হন। ১৪ ফেব্রুয়ারি উত্তরা ৪ নম্বরের ৪ নম্বর সড়কে এক নারীর হাতব্যাগ টান দেয় প্রাইভেট কারে থাকা ছিনতাইকারীরা। ব্যাগ না ছাড়া পর্যন্ত বেশ কিছুদূর তাঁকে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ে আহত অবস্থায় ওই হাসপাতালে আসার ঘটনা ৫৫টি। তবে ছিনতাইয়ের শিকার হলেও ‘ঝামেলা’ এড়াতে অনেকেই থানায় অভিযোগ করে না।

পুলিশ সূত্র বলছে, রাজধানীর ৪৯টি থানায় এপ্রিল ও মে মাসে রাজধানীর ৪৯টি থানায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা ও সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে কমপক্ষে ৪৫টি।

জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ওসি মোহাম্মদ মামুন অর রশিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ছিনতাই নিয়ন্ত্রণে টহল আরো বাড়ানো হয়েছে।

ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীতে ভোর ও সন্ধ্যার পর ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটছে। থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।’

দিনের বেলায় দুই ছিনতাই : গতকাল বুধবার বিকেল ৫টার দিকে রাজধানীর খিলগাঁও নগদারপাড় ও বাংলামোটর এলাকায় দুটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে খিলগাঁও এলাকায় আবির নামের এক বাসযাত্রীকে প্রকাশ্যে মারধর করে তাঁর সোনার চেইন ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। পরে আহতাবস্থায় আবির নামের ওই যাত্রীকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। এ ছাড়া গতকাল প্রায় একই সময়ে বাংলামোটর সড়কে প্রাইভেট কারে থাকা এক আইনজীবীর গলা থেকে সোনার চেইন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/06/10/1041658