১০ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১:০৪

কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র

ধারণক্ষমতার দ্বিগুণের বেশি অপরাধী

আড়ালেই থেকে যাচ্ছে নেপথ্যের নায়করা - অপরাধের তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা

সমাজের তিন ব্যাধি (কিশোর গ্যাং, মাদক ও টিকটক) রোধে কিশোর গ্যাং সদস্যদের গ্রেফতারে ব্যাপক অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এতে প্রায় প্রতিদিনই চাপ বাড়ছে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোয়। দেশের দুইটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ধারণক্ষমতার চেয়ে দ্বিগুণের বেশি কিশোর অবস্থান করছে।

এদিকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজধানীতে গত তিন বছরে কিশোর গ্যাং সদস্যদের বিরুদ্ধে ৪৫টি মামলা হয়েছে। এসবের বেশির ভাগেরই বিচারকাজ শেষ হয়নি। তদন্তাধীন আছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা।

এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে মাঝেমধ্যে কিশোর গ্যাং সদস্যদের আটক বা গ্রেফতার করা হচ্ছে। কিন্তু ধরা পড়ছে না তাদের গডফাদাররা। বিচার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘসূত্রতা এবং গডফাদাররা আড়ালে থাকা কিশোর অপরাধ না কমার অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

অপরাধীরা কিশোর বলে দণ্ডবিধিতে এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না পুলিশ। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তাদের আটক করে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশে দুটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। এর একটি গাজীপুরের টঙ্গীতে এবং অন্যটি যশোরের পুলেরহাটে। এ দুটি কেন্দ্রে ধারণক্ষমতা ৪৫০ জন। কিন্তু এখন সেখানে ৯৯৫ জন কিশোর অবস্থান করছে।

এর মধ্যে টঙ্গীতে অবস্থিত জাতীয় কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ৭২৮ জন এবং পুলেরহাট কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে ২৬৭ জন। অথচ টঙ্গীতে অবস্থিত জাতীয় কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা ৩০০ জন এবং পুলেরহাটে অবস্থিত কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রের ধারণক্ষমতা ১৫০ জন। এছাড়া গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে ১৫০ জন ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি জাতীয় কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে ধারণক্ষমতার চেয়ে কম (৮৮ জন) কিশোরীর অবস্থান।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপপরিচালক (ইনস্টিটিউশন) রাকিব আহমেদ বলেন, সাম্প্র্রতিক সময়ে কিশোর অপরাধ অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোয় চাপ অনেক বেড়েছে। তবে বালিকাদের মধ্যে অপরাধ তৎপরতা তুলনামূলক কম। তাই কিশোরী উন্নয়ন কেন্দ্রগুলোয় কোনো চাপ নেই। বরং সেখানে অনেক আসন খালি আছে।

তিনি বলেন, কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র নিয়ে আমরা অনেক সমস্যা মোকাবিলা করছি। একদিকে কিশোর অপরাধীদের অতিরিক্ত চাপ, অন্যদিকে জনবল খুবই কম-এ দুইটি সমস্যা নিয়ে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র দুটি পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিশোর অপরাধীরা গাদাগাদি করে কেন্দ্র দুইটিতে অবস্থান করছে।

এক প্রশ্নের জবাবে রাকিব আহমেদ বলেন, কোনো কিশোর যদি উন্নয়ন কেন্দ্রে আসে, তাহলে জামিন পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা তত্ত্বাবধান করি। জামিন পেতে সাধারণত ৩-৬ মাস সময় লাগে। তবে সাজা হয়ে গেলে তাদেরকে দীর্ঘ সময় রাখতে হয়। বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, সাজা যত বছরই হোক না কেন, ৩-৪ বছরের বেশি উন্নয়ন কেন্দ্রে থাকে না। তবে সবই হয় আদালতের নির্দেশে। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কিশোর তিন বছর ধরে কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে রয়েছেন বলেও তিনি জানান।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার একেএম হাফিজ আক্তার যুগান্তরকে বলেন, গ্যাং সদস্যদের মধ্যে যারা প্রাপ্তবয়স্ক, প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু অপরাধীদের যারা অপ্রাপ্তবয়স্ক, তাদের বিরুদ্ধে অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা আগেও ছিল। কিন্তু তাদের ভয়াবহতা এত ছিল না। এখন ভিন্ন ফরমেটে অপরাধ সংঘটিত করছে গ্যাং সদস্যরা। আগে সিনিয়ররা জুনিয়রদের স্নেহ-মমতায় আগলে রাখত।

সিনিয়ররা সিনিয়রদের সম্মান করত। কিন্তু এখন সেই অবস্থা নেই। কোথাও কোথাও রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে কিশোর গ্যাং সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে। মাঝেমধ্যে তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলেও জেল থেকে বেরিয়ে আবারও অপরাধ তৎপরতায় লিপ্ত হচ্ছে।

সম্প্রতিক সময়ে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিশোর গ্যাং সদস্যদের হাতে বেশ কয়েকটি খুনাখুনির ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-২৭ মে রাতে শনিরআখড়া আরএস শপিং কমপ্লেক্সের সামনে ধূমপানের প্রতিবাদ করার জের ধরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে আরাফাত ইয়াসিন নামে এক যুবক নিহত হন। এ ঘটনায় কিশোর গ্যাংয়ের আট সদস্য পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও এর নেপথ্যের গডফাদাররা আড়ালে রয়ে গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে অনেক আগে থেকেই কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা ছিল। ২০১৭ সালে স্কুলছাত্র আদনান হত্যার পর থেকে তাদের সহিংসতার বিষয় সামনে ওঠে আসে। ওই বছরের ৬ জানুয়ারি উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডে এলোপাতাড়িভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় স্কুলছাত্র আদনান কবিরকে। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ডিসকো বয়েস, বিগবস, নাইনএমএম এবং নাফিস ডন গ্রুপের সদস্যরা।

আদনান ছিলেন নাইনস্টার গ্রুপের সদস্য। আদনান হত্যার ঘটনায় চলতি বছরের শুরুতে ২৩ জনের নামে চার্জ গঠন করেছেন আদালত। কিন্তু এখনো বিচারকাজ শেষ হয়নি। এ হত্যা মামলার ২৭ আসামির মধ্যে ২৫ জনকে গ্রেফতার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। ইতোমধ্যে সবাই জামিন পেয়ে গেছেন। জামিনের পর পালিয়ে গেছেন ৭-৮ জন। তারা আদালতে হাজিরাও দিচ্ছে না।

যারা হাজিরা দিচ্ছে না, তারা সবাই বিগবস গ্রুপের সদস্য। এ বিষয়ে আদনান কবিরের বাবা কবির হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমি বিচার পাইনি বলেই কিশোর গ্যাং সদস্যরা ধারাবাহিকভাবে অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। সারা দেশেই এদের দাপট চলছে। তিনি বলেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে আমি এবং আমার পরিবার এখন মারাত্মক হুমকিতে আছি।

২০১৯ সালের ২১ মার্চ রাজধানীর উত্তরখান থানাধীন রাজবাড়ি বাহরেরটেক এলাকায় স্কুলছাত্র কামরুল হাসান হৃদয়কে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিগবস (ছোটন) গ্রুপের সঙ্গে কাশ্মীরি গ্রুপের সংঘর্ষে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। হৃদয় বগবস (ছোটন) গ্রুপের সদস্য ছিলেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তরখান থানার তৎকালীন ওসি হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, হৃদয় হত্যার ঘটনায় প্রধান আসামি মুরাদ হোসেন রাবিক্ষ ওরফে টেলি রাবিক্ষসহ বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। অনেক আগে চার্জশিট দেওয়া হলেও এখনো বিচারকার্জ শেষ হয়নি।

আধিপত্য বিস্তার এবং পূর্বশত্রুতার জেরে ২০১৯ সালের ৭ জুলাই টঙ্গী পূর্ব থানাধীন মদিনাপাড়া এলাকায় বুকে-পিঠে ও মাথায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় স্কুলছাত্র শুভ আহমেদকে। ঘটনার তিনদিন পর হত্যাকাণ্ডে জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করে র‌্যার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য ইউনিটের পক্ষ থেকেও কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু এখনো শুভর স্বজনরা বিচার পাননি বলে সূত্র জানায়।

২০১৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর গাজীপুর সদর থানাধীন রাজদীঘিরপাড় এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নুরুল ইসলাম নুরু নামের এক কিশোর ছুরিকাঘাতে নিহত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, দীঘিরপাড় গ্রুপ এবং ভাই-ব্রাদার্স গ্রুপের সিনিয়র সদস্যদেরকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করাকে কেন্দ্র করে বাগ্বিতণ্ডার ঘটনা ঘটে। একপর্যায়ে হাতাহাতি হয়। এতে ভাই-ব্রাদার্স গ্রুপের সদস্যরা বেশি আহত হয়।

এর প্রতিশোধ নিতেই ভাই-ব্রাদার্স গ্রুপের সদস্যরা ঘটনার দিন দীঘিরপাড় গ্রুপের সদস্যদের ওপর আকস্মিক হামলা চালায়। নুরুল হামলা থেকে বাঁচতে পাশের পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তার গ্রুপের অন্য সদস্যরা পালিয়ে যায়। পরে ভাই-ব্রাদার্স গ্রুপের সদস্যরা নুরুলকে পুকুর থেকে তুলে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। এ বিষয়ে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই সাইদুর রহমান খান যুগান্তরকে বলেন, ঘটনায় দায়ের করা মামলায় এরই মধ্যে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছি। এখনো বিচারকাজ শেষ হয়নি।

এছাড়া ২০২০ সালের ১০ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলায় কিশোর গ্যাংয়ের বিবাদে এসএসসি পরীক্ষার্থী মিনহাজুল ইসলাম নিহাদ ও স্কুলছাত্র জিসাদ আহমেদ খুন হয়। ওই বছরের ১৫ জুলাই কামরাঙ্গীরচরের পূর্ব রসুলপুরে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে সজিব নামের এক কিশোরকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। একই বছরের ৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সবুজবাগে কিমোর গ্যাং সদস্য ইমনের ছুরিকাঘাতে জব্বার আলী নামের অপর কিশোর নিহত হয়।

ওই বছরের ২৭ আগস্ট উত্তরখান খ্রিষ্টানপাড়ায় কিশোর গ্যাং সদস্য হৃদয়ের গায়ে ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে পানি লাগার ঘটনায় সোহাগ নামের এক যুবককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ৩০ আগস্ট চকবাজারে নাদিম নামের এক যুবককে প্রকাশ্যে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। ১ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা শরিফ হোসেন নামের এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করে। ২৩ ফেব্রুয়ারি তেজগাঁও কৃষি প্রশিক্ষণায়তনের সামনে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে হাসান নামের এক যুবক নিহত হন।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/429729/