১০ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১:০৩

কার্যকর পদক্ষেপ নেই

অর্থ পাচার রোধে অনীহা

মামলায় আটকে আছে পাচারকারীর শাস্তি - রেমিট্যান্সে ফেরত আসছে পাচারের কিছু অর্থ

দেশ থেকে টাকা পাচার বাড়ছে। এরসঙ্গে জড়িত সংসদ সদস্য, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, ঠিকাদার, দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারা। সাম্প্রতিক সময়ে এদের বেশ কিছু নাম প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার রিপোর্টে অর্থ পাচারের তথ্যও এসেছে। কিন্তু অর্থ পাচার রোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেই। বিভিন্ন মহল থেকে দাবি এলেও বাজেটে অর্থ পাচার নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে অর্থ পাচার বন্ধে উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলা হলেও প্রস্তাবিত বাজেটে তা অস্পষ্ট। বিষয়টি নিয়ে সোমবার জাতীয় সংসদে উত্তপ্ত আলোচনা হয়েছে। এ সময়ে পাচারকারীদের নাম জানতে চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সাম্প্রতিক সময়ে একজন সংসদ সদস্যের বিদেশে অর্থ পাচারের খবর আসায় বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

অন্যদিকে পাচার রোধে বেশ কয়েকটি মামলা দীর্ঘদিন থেকে আদালতে আটকে আছে। অর্থনীতিবিদ এবং সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পাচার রোধে সবার আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। এক্ষেত্রে আইনকানুনের কোনো ঘাটতি নেই।

তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে পাচার হওয়া কিছু অর্থ রেমিট্যান্স (প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ) আকারে ফেরত আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে রেমিট্যান্স বেড়ে যাওয়ার এটি অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। টাকা পাচার নিয়ে আন্তর্জাতিক ৪টি সংস্থার রিপোর্টেই বাংলাদেশ থেকে ভয়াবহ আকারে টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে।

এ সংস্থাগুলোর মধ্যে আছে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি (জিএফআই), সুইস ব্যাংক, ইউএনডিপি এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন আইসিআইজের পানামা ও প্যারাডাইস পেপার। জিএফআইর রিপোর্ট অনুসারে গত বছরে দেশ থেকে প্রায় ৫ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। সুইস ব্যাংকের সর্বশেষ রিপোর্টে বলা হয়েছে, দেশটিতে বাংলাদেশিদের আমানত সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্সে ৮৪ জন বাংলাদেশির টাকা পাচারের তথ্য উঠে এসেছে।

সংস্থাগুলোর মতে, বাংলাদেশ থেকে যে সব টাকা পাচার হয়, তা যায় উন্নত ৩৬ দেশে। তবে সম্প্রতি বিএফআইইউ এবং দুদকের রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাচারের জন্য বড় ১০টি দেশ চিহ্নিত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে কর কম এবং আইনের শাসন আছে, অপরাধীরা সে সব দেশকেই বেছে নিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- সিঙ্গাপুর, কানাডা, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়া, হংকং এবং থাইল্যান্ড। সম্প্রতি বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) রিপোর্টে এসব তথ্য উঠে এসেছে। পাচারকারীরা অধিকাংশই প্রভাবশালী।

এছাড়াও নিজ থেকে অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কানাডায় আন্দোলন শুরু করেছে দেশটিতে থাকা বাংলাদেশিদের একটি অংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ৫ কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। এর মধ্যে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশের অভাব, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার শঙ্কা, রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোর দুর্বল নজরদারি, আইনের শাসনের ঘাটতি এবং বেপরোয়া দুর্নীতি। পাচার বন্ধ এবং আগে পাচার হওয়া টাকা ফিরিয়ে আনতে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।

জানা গেছে, দেশ থেকে অর্থ পাচারের ব্যাপারে হাজারের বেশি ঘটনার প্রমাণ পেয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এসব প্রতিবেদন ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), সিআইডি এবং বাংলাদেশ ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৫৮টি ঘটনা চিহ্নিত করে বিএফআইইউ। এছাড়াও ২০১৬-১৭ সালে ১২১টি, ২০১৭-১৮ সালে ৬৭৭টি, ২০১৮ সালে ৫২টি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১১৬টি ঘটনা চিহ্নিত করা হয়।

আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে কয়েকটি পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে-বিদেশে অর্থ পাচার ও সম্পদ গচ্ছিত রাখা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো, অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে অপরাধ দমনে দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। বড় বড় পাচারকারীদের নাম সামনে এলেও দৃশ্যমান কোনো তৎপরতা নেই।

জানতে চাইলে দুর্নীতি বিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দেশ থেকে প্রতি বছর যে টাকা পাচার হয়, এটি তার আংশিক চিত্র। পুরো চিত্র আরও ভয়াবহ। কারণ মোট বাণিজ্যের ৩৬ শতাংশই বিদেশে পাচার হয়। তার মতে, অর্থ পাচারের অনেক কারণ রয়েছে। আর এগুলো বন্ধের জন্য সরকারের সদিচ্ছা নেই।

সম্প্রতি নাটোর ২ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল ইসলাম শিমুলের টাকা পাচারের তথ্য গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। স্ত্রী জান্নাতীর নামে তিনি কানাডায় সাড়ে ১২ কোটি টাকায় বাড়ি কিনেছেন। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশি কয়েকজন ব্যবসায়ীর ১ বিলিয়ন ডলার অর্থ পাচারের তথ্য প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ ৮ হাজার ৫শ কোটি টাকা। ২০১৪ সালে বাংলাদেশি একটি আলোচিত গ্রুপ সিঙ্গাপুরে ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকায় একটি হোটেল কিনেছিল। ওই গ্রুপটিই ২০১৬ সালে দেশটিতে ৭৮৬ কোটি টাকায় আরও একটি হোটেল কিনেছে।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার হওয়া ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুরে ২২৭ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে দুদক। এ বছর ২১ আগস্ট দুই হাজার কোটি টাকা পাচারের মামলায় ফরিদপুর জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নিশান মাহামুদ শামীমকে গ্রেফতার করে সিআইডি। একই জেলার দুই হাজার কোটি টাকা অবৈধ উপায়ে অর্জন ও পাচারের অপরাধে ২৬ জুন শহর আওয়ামী লীগের অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ হোসেন বরকত ও তার ভাই ইমতিয়াজ হাসান রুবেলের বিরুদ্ধে ঢাকায় সিআইডি মামলা করেছে।

অফশোর ব্যাংকিংয়ের নামে ২০১৪-২০১৬ সালে ২৩৬ কোটি টাকা দুবাই ও সিঙ্গাপুরে পাচার করে এবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়াহিদুল হক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শামীম আহমেদ চৌধুরী। ইতোমধ্যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক।

অর্থ পাচার করে বাংলাদেশিরা মালয়েশিয়া সরকারের সেকেন্ড হোম প্রকল্পে বাড়ি করেছেন। প্রবাসীরা বলছেন, সেখানে বাংলাদেশির সংখ্যা ১৪ থেকে ১৫ হাজারের মতো। তারা সেখানে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগও করেছেন। ক্যারিবিয়ান দ্বীপরাষ্ট্র সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে কার্যক্রম শুরু করে কয়ি রিসোর্ট অ্যান্ড রেসিডেন্স।

এর মালিক বাংলাদেশের বহুবিতর্কিত একটি ব্যবসায়ী গ্রুপ। যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস ও নিউইয়র্ক, লাসভেগাস, আরব আমিরাত, থাইল্যান্ড ও ব্যাংককেও এ হোটেলের শাখা রয়েছে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও সুইজারল্যান্ডে এ পরিবারের বিনিয়োগ রয়েছে। সিকদার পরিবারের একাধিক কোম্পানি ও বিপুল বিনিয়োগ। এছাড়াও লক্ষ্মীপুর ২ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুলের বিশাল পরিমাণ সম্পদ আটক করা হয়েছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের অন্যতম গন্তব্য কানাডা। দেশটির সরকারি সংস্থা ফিনট্র্যাক (দ্য ফাইন্যান্সিয়াল ট্রানজেকশনস অ্যান্ড রিপোর্ট অ্যানালাইসিস সেন্টার অব কানাডা) সন্দেহভাজন আর্থিক লেনদেন দেখাশোনা করে। সম্প্রতি প্রকাশিত হওয়া সংস্থাটির রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে করোনার মধ্যেও গত এক বছরে কানাডায় ১ হাজার ৫৮২টি মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটেছে।

এ অর্থ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কানাডায় এসেছে। পাচারকারীদের বিস্তারিত তথ্য ইতোমধ্যে কানাডিয়ান সিকিউরিটিজ ইনটেলিজেন্স সার্ভিসের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, শেয়ারবাজারের ব্রোকারেজ হাউজ, আবাসন কোম্পানি এবং ক্যাসিনো থেকে এ তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন বিদেশে সম্পদ গড়ার দিক থেকে রাজনীতিবিদের চেয়ে সরকারি চাকরিজীবীর সংখ্যা বেশি। তিনি বলেন, গোপনে কানাডার টরোন্টোতে অবস্থিত বাংলাদেশিদের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হয়েছে।

ধারণা ছিল, সেখানে রাজনীতিবিদদের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু যে তথ্য এসেছে, তাতে আমি অবাক হয়েছি। সংখ্যার দিক থেকে সরকারি চাকরিজীবীদের বাড়িঘর সেখানে বেশি। তাদের ছেলেমেয়েরা সেখানে থাকে। যদিও এটি সামগ্রিক তথ্য নয়। তিনি বলেন, আমার কাছে ২৮টি কেস এসেছে। এরমধ্যে রাজনীতিবিদ হলেন ৪ জন। এছাড়া কিছু আছেন গার্মেন্ট ব্যবসায়ী। তবে আরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, শুধু কানাডা নয়, মালয়েশিয়াতেও একই অবস্থা।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আমদানির নামে এলসি খুলে বিল পরিশোধ করছে, কিন্তু কোনো পণ্যই দেশে আসছে না। এছাড়াও রয়েছে আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানি মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার হচ্ছে। সম্প্রতি টাকা পাচারের আরও একটি বড় মাধ্যম হয়ে দেখা দিয়েছে রেমিট্যান্স। একটি চক্র বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীদের রেমিট্যান্স সংগ্রহ করে তা বিদেশেই রেখে দেয়। আর এ দেশে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকায় এর দায় শোধ করা হয়। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপ অনুযায়ী এ প্রক্রিয়ায় প্রায় ৪০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসছে না। ওগুলোও পাচার হয়ে বিদেশের কোনো ব্যাংকে রাখা হচ্ছে।

সূত্র জানায়, দেশে-বিদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বন্ধ ও মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে তথ্যের আদান-প্রদান করতে ২০১৩ সালের জুলাইয়ে এগমন্ট গ্রুপের সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ। বর্তমানে ১৫৯টি দেশ ওই গ্রুপের সদস্য। বাংলাদেশ এ গ্রুপের সদস্য হওয়ায় এখন সব দেশ থেকে মানি লন্ডারিং, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন বা টাকা পাচার বিষয়ক যে কোনো তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। কিন্তু সেক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই।

সংশিষ্ট সূত্র বলছে, পাচারকরা কিছু অর্থ ইতোমধ্যে রেমিট্যান্স আকারে ফেরত আসছে। অর্থবছরের ১১ মাসে রেমিট্যান্স ২৩ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এরমধ্যে বাংলাদেশে রেমিট্যান্স আয়ে আরব আমিরাতকে পেছনে ফেলে ইতোমধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে চলে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। আর বিশ্বব্যাপী মন্দা থাকার পরও রেমিট্যান্স এভাবে বৃদ্ধির কারণ দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।

বাণিজ্যের আড়ালে বেশির ভাগ পাচার: মির্জ্জা আজিজ

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, প্রতিবছর দেশ থেকে যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়, তার অধিকাংশই বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে। আর বিনিয়োগ না হওয়ায় দেশ থেকে এই অর্থ পাচার হচ্ছে।

তিনি বলেন, দেশের মোট বিনিয়োগের ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ আসে বেসরকারি খাত থেকে। কিন্তু গত কয়েক বছরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমছে। তার মতে, বিনিয়োগের পরিবেশ নেই, যে কারণে টাকা পাচার হচ্ছে। এছাড়া অনেকেই এ দেশে টাকা রাখতে নিরাপদ মনে করেন না। পাশাপাশি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকা দেশে রাখা কঠিন। ফলে টাকা বাইরে নিয়ে যাচ্ছেন।

তিনি বলেন, টাকা কারা পাচার করছে, সবার আগে তা চিহ্নিত করতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে বিষয়টি অবশ্যই খতিয়ে দেখতে হবে। কারণ একবার বিদেশে টাকা গেলে, তা ফেরত আনা খুব কঠিন। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের টাকা তার বড় প্রমাণ।

তিনি আরও বলেন, সরকার তার ভাবমূর্তি হারানোর ভয়ে তথ্য লুকিয়ে রাখে। কিন্তু এগুলো করে লাভ হয় না। কারণ ভাবমূর্তি শেষ পর্যন্ত রক্ষা হয় না। মির্জ্জা আজিজ বলেন, টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে সরকারি রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে যোগাযোগ করতে হবে।

অন্তর্নিহিত কারণ বন্ধ করতে হবে: আহসান এইচ মনসুর

পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, অর্থ পাচার রোধ করতে সবার আগে অন্তর্নিহিত কারণ বন্ধ করা জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারি সংস্থাগুলোর নজরদারি বাড়াতে হবে। আইন-কানুনেও আনতে হবে প্রয়োজনীয় সংস্কার।

তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে টাকা পাচার হয়। এর অন্যতম কারণ ভীতি। মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য উন্নত দেশগুলোতে টাকা নিয়ে যায়। এসব ভীতির মধ্যে রয়েছে-বিভিন্ন অনিশ্চয়তা, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সরকার পরিবর্তনের আশঙ্কা। এছাড়া দুর্নীতি হলো টাকা পাচারের অন্যতম কারণ।

এর ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, দুর্নীতির মধ্যেও আবার রাজনৈতিক দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক দুর্নীতি রয়েছে। এই দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত টাকার বেশির ভাগই দেশের বাইরে যায়।

এছাড়া বিভিন্ন জালজালিয়াতির মাধ্যমে অর্জিত বড় অঙ্কের টাকা পাচার হয়। অন্যদিকে দেশে আরেকটি প্রবণতা রয়েছে। বেশ কিছু মানুষের সন্তানরা দেশের বাইরে পড়াশোনা করে। সন্তানের কারণে মা-বাবাও ওইসব দেশে সেটেল হওয়ার চেষ্টা করে। ফলে তারা সম্পদ দেশের বাইরে নিয়ে যায়। তবে একবার দেশের বাইরে টাকা গেলে, তা ফিরিয়ে আনা কঠিন। কারণ যেসব দেশে টাকা যায়, সে দেশে প্রমাণ করতে হয়, এই টাকা জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়ে আসা হয়েছে। এর মাধ্যমে বহু মানুষ প্রতারিত হয়েছে। এক্ষেত্রে ওইসব দেশের সরকার চাইলেও ব্যাংকগুলো টাকা দেবে না। তখন বিষয়টি ওইসব দেশের আইন আদালতের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জটিল। এসব কারণেই আমরা বলছি, টাকা পাচারের অন্তর্নিহিত কারণ বন্ধ করতে হবে।

পাচার রোধে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: ড. ইফতেখারুজ্জামান

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, অর্থ পাচার রোধে সবার আগে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। এরপর দক্ষতা, সক্ষমতা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। তিনি বলেন, সবার আগে রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, পাচার নিয়ন্ত্রণ করা হবে। কারণ যারা অর্থ পাচার করছে, তারা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত প্রভাবশালী। এদের ক্ষমতা অনেক বেশি। সব সময় তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। সরকারি সংস্থাগুলো এদের ধরতে সাহস পায় না। তাই তারা অর্থ পাচার করছে। এদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনা জরুরি। এক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত পাচারকারীদের বার্তা দেওয়া উচিত। কিন্তু এ ধরনের বার্তা দেওয়া হচ্ছে না।

আর যখন ইস্যুটি সামনে আসে, তখন চুনোপুঁটি কাউকে ধরা হয়। কিন্তু রাঘববোয়ালরা নিরাপদেই থাকে। আর এ সংস্কৃতি থেকে বের না হলে পাচার বন্ধ হবে না। দ্বিতীয়ত, পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আর ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আইন-কানুনসহ কোনো কিছুর ঘাটতি নেই। তিনি আরও বলেন, ২০০৭-০৮ সালে সিঙ্গাপুর থেকে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা হয়েছে। ওই সময়ে পারলে এখন পারা যাবে না কেন। ওই সময়ে যেসব আইন-কানুন ছিল, এখনো তার সবকিছুই আছে। উলটো অনেক ক্ষেত্রে আইনের সংস্কার হয়েছে। ফলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেই অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

পাচারের ৯০ ভাগই দুর্নীতির টাকা: ড. জাহিদ হোসেন

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, দুই কারণে অর্থ পাচার করা হয়। এর মধ্যে প্রধান এবং প্রথম কারণ দুর্নীতি। দুর্নীতির আবার সাপ্লাই এবং ডিমান্ড সাইট আছে। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিরা দুর্নীতি সরবরাহকারী বা সাপ্লাইয়ার। এর ডিমান্ড সাইট বা সুবিধাভোগী নিজেরা এবং অন্য প্রভাবশালীরা। আমার ধারণা অর্থ পাচারের ৯০ ভাগই দুর্নীতির টাকা। বাকি ১০ ভাগ চলে যায় বিনিয়োগ পরিবেশ দুর্বলতার কারণে।

তিনি বলেন, বিদেশে অর্থ পাচারের দ্বিতীয় কারণ দেশে বিনিয়োগ পরিবেশটা দুর্বল। এছাড়া কিছুটা অনিশ্চয়তা এবং অনাস্থাও রয়েছে। এসব কারণে আংশিক বৈধ টাকা চলে যাচ্ছে অবৈধ ঠিকানায়।

তার মতে, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ), জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সিআইসিসহ বিভিন্ন সংস্থা অর্থ পাচার রোধে কাজ করে যাচ্ছে। পর্যাপ্ত জনবল, প্রশিক্ষণও আছে এছাড়া আইন-কানুনের কোনো অভাব নেই। এরপরও অর্থ পাচার বন্ধ হচ্ছে না কেন? মূলত দেশে দুর্নীতি বন্ধ করতে না পারলে বিদেশে টাকা পাচার রোধ করা যাবে না। মনে রাখতে হবে-খেলোয়াড় নয়, খেলাটা বন্ধ করতে হবে। এর বাইরে কর্মকর্তাদের কাছে কম যেতে হয়-এমন সিস্টেম চালু করতে হবে। নিয়ম-কানুন আরও সহজ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, নিয়ম-কানুনের ফাঁকফোকরের কারণেও দুর্নীতি এবং অর্থ পাচার বাড়ছে। তবে সব কথার মূল কথা রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সরিষার মধ্যে ভূত থাকলে সে ভূত কে তাড়াবে? যে টাকা পাচার হয়েছে, তা ফেরত আনা কঠিন, যদি না সে দেশ সহযোগিতা করে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/429721/