১০ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার, ১২:৫৭

তুলসা গণহত্যা এবং সভ্যতার গতিপথ

দুঃখজনক অনেক স্মৃতি আছে মানবজাতির। কোনো কোনোটি আবার নিষ্ঠুর, পৈশাচিক এবং জঘন্য। যেমন ‘গণহত্যা’। গণহত্যা কারা করেছে, কোন ধর্ম বা বর্ণের মানুষ করেছে; এর চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- মানুষই মানুষকে হত্যা করেছে নৃশংসভাবে এবং ব্যাপকভাবে। প্রশ্ন জাগে- এই যে এত জাত্যাভিমান, ধর্ম ও বর্ণের অহঙ্কার, তা কি মানুষকে মানুষ করতে পেরেছে? আসল কাজটি যদি না হয়ে থাকে, তাহলে কেন এই জাত্যাভিমান এবং অহঙ্কার? পৃথিবীর সব মানচিত্রেই রোদেলা কোমল সকাল আছে, আছে বৃষ্টি বা বরফস্নাত নিবিড় রাত্রিও। প্রকৃতির এমন সুন্দর বাতাবরণে পৃথিবীরসক্ষম ব্যক্তিরা কি সভ্যতার গতিপথ নিয়ে ভাবতে পারেন না? ক্ষমতাবানরা কি গ্লানিমুক্ত হওয়ার জন্য আত্মসমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে পারেন না? ক্ষণিকের জন্য দাঁড়ালেও পৃথিবীর, মানবজাতির মঙ্গল হতো।

গণহত্যার সব চিত্রই নিষ্ঠুর, নৃশংস ও বীভৎস। পরিণামে কান্না, আহাজারি আর আর্তনাদ। গণহত্যার কোনো ঘটনাতেই বিচার-বিবেচনা কাজ করেনি; কাজ করেছে, প্রতিশোধ-স্পৃহা, উগ্রতা ও জিঘাংসা। ‘তুলসা গণহত্যা’ এমন এক জিঘাংসার নাম। আমেরিকার ওকলাহোমায় তুলসার অবস্থান। ১৯২১ সালে তুলসায় শ্বেতাঙ্গ উগ্রবাদীদের হত্যার শিকার হন শত শত কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনী। এক শ্বেতাঙ্গ নারীর ওপর একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির হামলার অভিযোগে তুলসায় কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর গণহত্যা চালায় স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ অধিবাসীরা। ১৯২১ সালের ৩১ মে ও ১ জুন, মাত্র দুইদিনে গুলি করে হত্যা করা হয় ৩০০ কৃষ্ণাঙ্গকে। পাশাপাশি জ্বালিয়ে দেয়া হয় এবং লুট করা হয় কৃষ্ণাঙ্গদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। ওই ঘটনাসমৃদ্ধ আফ্রিকান-আমেরিকান কমিউনিটিকে একেবারে তছনছ করে দেয়। আর এখানে বলার মতো বিষয় হলো, যে অভিযোগে গণহত্যার ঘটনা সংঘটিত হলো তা কখনো প্রমাণিতই হয়নি। আর বেদনার বিষয় হলো, সহিংসতা তথা গণহত্যার জন্য দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি একজনকেও।

উল্লেখ্য যে, যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন কোনো প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথমবারের মতো ওকলাহোমায় তুলসা-গণহত্যার স্থান পরিদর্শন করলেন জো বাইডেন। গত ১ জুন মঙ্গলবার ওই পরিদর্শনের মধ্য দিয়ে শত বছরের পুরনো গণহত্যার ঘটনার দায় মোচনের একটা চেষ্টা চালালেন তিনি। পরিদর্শনকালে জো বাইডেন বলেন, বর্ণবাদী ওই সহিংসতা ও শ্বেত আধিপত্যবাদের উত্তরাধিকার মার্কিন সমাজে আজও বিদ্যমান। তুলসার গ্রিনউড এলাকায় নৃশংস ওই হামলায় প্রাণে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের কয়েকজন ও নিহত ব্যক্তিদের সন্তান-সন্ততিদের সঙ্গে দেখা করেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। এ সময় প্রদত্ত বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভালো-মন্দ সব বিষয় জানা দরকার। গণমুখী রাষ্টও এগুলো স্বীকার করে নেয়।’ জো বাইডেন আরও বলেন, চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটলে রক্তক্ষয়ী হামলা ও গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কয়েকটি রাজ্যে ভোটাভুটি বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা একই সমস্যার (বর্ণবাদী সহিংসতা) পুনরাবৃত্তি মাত্র। তিনি বলেন, গ্রিনউডে যা ঘটেছে তা ঘৃণাত্মক ও অভ্যন্তরীণ সন্ত্রাসবাদি কর্মকাণ্ড। এমন কর্মকাণ্ড চলছে আজও।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঠিকই বলেছেন। তুলসা গণহত্যার পেছনে যে ঘৃণা, উগ্রতা ও বর্ণবাদি জিঘাংসা সক্রিয় ছিল তা আজও বর্তমান রয়েছে আমাদের সভ্যতায়। আরও দুঃখের বিষয় হলো, যারা সভ্যতার শাসক তাদের প্রশ্রয়ে, প্রণোদনায় অনেক ক্ষেত্রে হিংসাত্মক ও ধ্বংসাত্মক কাজগুলো সংঘটিত হচ্ছে। যদি উদাহরণ হিসেবে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, কাশ্মীর, উউঘুর কিংবা মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকটের বিশ্লেষণ করা হয়- তাহলে বিশ্ব রাজনীতির চেহারাটা কেমন লাগে? মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও উগ্রবাদিরা তো আগে হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন চালিয়েছে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর; আর এখন দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে মিয়ানমারের ব্যাপক জনগোষ্ঠীর ওপর। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে যে, মিয়ানমারে এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে গৃহযুদ্ধের ঘনঘটা। আসলে মানুষ প্রকৃত মানুষ না হলে তার হাতে কেউ নিরাপদ নয়। এমন মানুষ ধর্ম, বর্ণ ও ভাষার পক্ষে সাময়িক উত্তেজনা সৃষ্টিতে সমর্থ হলেও প্রকৃতঅর্থে সাধারণ মানুষের স্বার্থ আদায়ে সক্ষম হয় না।

কারণ ওই মানুষগুলো ত্যাগ-তিতিক্ষার চেতনায় শুদ্ধ হয়নি বরং দম্ভ ও ক্ষুদ্র স্বার্থে দূষিত হয়েছে। এরা চাতুর্য ও পলিটিক্সে মগ্ন থেকেছে। সাধারণ মানুষের কল্যাণে যে বিচার-বিবেচনা ও ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ প্রয়োজন তা তাদের অভিধানে নেই।

পৃথিবী বলি, প্রকৃতি বলি- সবই টিকে আছে ভারসাম্য গুণে। ব্যক্তি মানুষকেও এগিয়ে যেতে হলে প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ জীবন। আসলেই প্রান্তিকতা কিংবা ভারসাম্যহীনতা কোন ভালো বিষয় নয়। তাহলে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রনেতারা ভারসাম্য গুণে পুষ্ট হবেন না কেন? এ ক্ষেত্রে বর্তমান সভ্যতায় ছোট কিংবা বড় বহু দেশ সংকটে রয়েছে। এর বড় কারণ ভ্রান্ত জীবনদর্শন এবং সম্পদ ও ক্ষমতার মোহ। সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকার যে মানবিক বিবেচনা ও ন্যায়ের দৃষ্টি- সেখানে ধস নেমেছে। ক্ষুদ্র মানুষ সম্পদ ও সমরাস্ত্রের দম্ভে এমন এক বিকৃত বাতাবরণ সৃষ্টি করে রেখেছে, যেখানে সুস্থ চিন্তা-চেতনার প্রবেশ নিষেধ। এই ভুবনের দাম্ভিক মানুষরা এখন আর শুভ কিংবা মানবিক ভাবনার ধারক নন। এসব কৃত্রিম প্রভুরা আসল প্রভুকে ভুলে গেছেন। ভুলে গেছেন স্রষ্টার বাণী এবং দিকনির্দেশনাকেও। ফলে জলে-স্থলে এবং মানুষের জীবনযাপনে লক্ষ্য করা যাচ্ছে বিপর্যয়। আর এই বিপর্যয় দাম্ভিক ও ক্ষমতাবান মানুষদের ভুল কাজের বিষফল। দাম্ভিক ও নিষ্ঠুর নেতাদের চরম পন্থার কারণে পৃথিবীর বহু দেশের সমাজে এবং রাজনীতিতে ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। ফলে শান্তি ও সমৃদ্ধির বদলে নেমে এসেছে ভাঙ্গন ও বিপর্যয়। এমনকি গৃহযুদ্ধও। এমন পরিস্থিতি এখন লক্ষ্য করা যাচ্ছে মিয়ানমারে। দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাতের চার মাস পার হলো। ১ ফেব্রুয়ারি দেশটির ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। এর আগে গ্রেফতার করা হয় নেত্রী অং সান সু চিসহ নির্বাচিত সরকারের মন্ত্রী ও নেতাদের। এর প্রতিবাদে ও গণতন্ত্রের দাবিতে শুরু থেকে বিক্ষোভ করে আসছে দেশটির জনতা।

বিক্ষোভে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে কমপক্ষে ৮৩৩ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। সেনাবাহিনীর নির্বিচার হামলা ও নিপীড়ন চলছেই। ফলে জান্তা-বিরোধী বিক্ষোভ রূপ নিয়েছে সশস্ত্র প্রতিরোধে। যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, এমন পরিস্থিতিতে গৃহযুদ্ধের শংকা দেখা দিয়েছে মিয়ানমারে। টানা সামরিক সহিংসতার মুখে নিজেদের রক্ষা করতে বিভিন্ন গোষ্ঠী অস্ত্র হাতে তুলে নিচ্ছে। জান্তা সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে গড়ে ওঠা ছায়া সরকার (ঐক্য সরকার) ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) মুখপাত্র সাসা সতর্কতা উচ্চারণ করে বলেন, মিয়ানমারের জনগণের এখন আর কোন উপায় নেই। জান্তা বাহিনীর নির্বিচার অভিযান, গ্রেফতার, নির্যাতন ও হত্যা মানুষকে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে। এটি মাত্র শুরু। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। কোন গ্রামে যদি একজন পুরুষ মানুষও থাকে তবু খুনীদের সামনে তারা মাথা নত করবে না। তার মানে পুরো দেশ এখন গৃহযুদ্ধের দিকেই হাঁটছে। ঐক্য সরকারও এখন জান্তার বিরুদ্ধে গড়ে তুলছে নিজস্ব বাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে উপলব্ধি করা যায়, গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে মিয়ানমার। তবে এর মাত্রা নির্ভর করবে সামরিক জান্তার কর্মকাণ্ডের উপর। তবে পৃথিবীতে গৃহযুদ্ধের যে ইতিহাস তাতে ভালো বার্তা নেই। মিয়ানমারের জনগণের সামনে অপেক্ষা করছে ধ্বংস ও দুর্ভোগের দিন, যা চাপিয়ে দিল দাম্ভিক সামরিক জান্তা। তবে সবকিছুরই একটা পরিণতি আছে। যোগ্য নেতৃত্বের অধীনে জনতার যুদ্ধ কখনো ব্যর্থ হয় না। জনতার জয়ের মাধ্যমে পরাজিত হতে পারে সামরিক জান্তার দম্ভ ও অহংকার। ইতিহাসে তেমন উদাহরণের অভাব নেই।

https://dailysangram.com/post/455004