৯ জুন ২০২১, বুধবার, ৩:০৪

সাততলা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড

খোলা আকাশের নিচে আশ্রয়হারা মানুষ

রাত তিনটা। মুহূর্তের মধ্যে বস্তিবাসীর সর্বস্ব কেড়ে নিয়েছে আগুন। খোলা আকাশের নিচে পোড়া ঘরের আসবাবপত্রের ছাইয়ের উপরে নির্ঘুম রাত-দিন কাটছে ঘরপোড়া মানুষগুলোর। ছোট ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কখনো রোদে পুড়ছেন, কখনো আবার ভিজছেন বৃষ্টিতে। খাবার বিতরণ করছেন অনেকে। কিন্তু সবার খাবার জুটছে না।

ঘরে থাকা সখের জিনিসপত্র সব পুড়ে ছাই হলেও আবার স্বপ্ন দেখছেন এই বস্তিতে মাথা গোঁজার। অনেকে গ্রামে চলে যাওয়ার চিন্তা করছেন। কিন্তু গ্রামেও বেশিরভাগেরই নেই চাষাবাদ করার মতো জমি।
ভিটেহীন, ভূমিহীন অনেকের একমাত্র আশ্রয়স্থল এই বস্তি। ঘরপোড়া মানুষগুলো নতুন করে শুরু করতে চান। গতকাল আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত রাজধানীর মহাখালী সাততলা বস্তিতে সরজমিন গিয়ে দেখা যায় এমন চিত্র।

পেয়ারা বেগম। সাত ছেলে-মেয়ে নিয়ে তার সংসার। খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে পোড়া ঘরের ওপরে চোখে-মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে বসে আছেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে আহাজারি করছেন। তিনি জানান, চারদিকে আগুন আগুন শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে যায় তার। চোখ খুলে দেখেন মাথার উপরে রুমের একপাশে আগুনের ফুলকি দেখা যাচ্ছে। চিৎকার করে বাকি সবাইকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলেন। জিনিসপত্রের মায়া না করে সবাইকে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান। ছোট এক রুমের ঘরটিতে তার ১৫ বছর ধরে বসবাস ছিল। স্বামী বাঁধন মুন্সি মাংসের দোকানে কাজ করেন। অনেক স্বপ্ন নিয়ে এই শহরে এসেছিলেন ময়মনসিংহ থেকে। কষ্ট করে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালান। তার পাঁচ ছেলে-মেয়েই লেখাপড়া করে। তাদের স্বপ্নের বই-খাতা সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ঘরে থাকা ফ্রিজ, আলমারিসহ অন্যান্য জিনিসপত্রও পুড়ে শেষ।

রোজিনা বেগম। ১৫ মাস বয়সি ছোট্ট ছেলেকে কোলে নিয়ে পুড়ে ছাই হওয়া ঘরের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন। আকাশের দিকে তাকিয়ে আক্ষেপে চোখ ভেজাচ্ছেন। তিনি জানান, দুদিন ধরে খাবার জোটেনি। নেই খাবার পানিটুকু মুখে দেয়ার কোনো ব্যবস্থা। এক পোশাকে ছোট ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে কোনোমতে প্রাণে রক্ষা পান তিনি। ছেলের ক্ষুধার কান্না তার আর সহ্য হচ্ছে না। তাকে সারাক্ষণ কোলে রাখতে হচ্ছে। ঘুম পাড়াতেও পারছেন না। স্বামী সামান্য কাজ করে সংসার চালান। শখ করে টাকা জমিয়ে সংসারের জন্য অনেক কিছু বানালেও নিমিষেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে সব। দুই বছর আগে বিয়ে করে স্বামীকে নিয়ে ঢাকায় আসেন তিনি।

ছয় বছর বয়সী হাসি আক্তার। দুই ভাই-বোনের মধ্যে সে ছোট। পোড়া ঘরের ছাইয়ের মধ্যে বসে পুড়ে যাওয়া টিন সংগ্রহ করছে। বাবা জসিম সিকদার রিকশা চালান। মা বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। পোড়া বস্তির মেয়ে ছোট্ট হাসি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আগুনে তার বই পুড়ে গেছে। এখন সে ডাক্তার হবে কী করে- জানতে চায়। ওয়ারলেস মডেল স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে হাসি। ঘরে আগুন লাগার আগের দিন তার বাবা তাকে একটি গাইড বই এনে দিয়েছিলেন। গাইড বইটির জন্য তার অনেক মায়া হচ্ছে। চোখের পানি ফেলছে আর পোড়া ঘরে তার বইসহ অন্যান্য জিনিসপত্র খুঁজছে।

নিলুফা বেগম জানান, গত দুদিন ধরে কিছুই খাইনি। সাহায্য আসে পাই না। এই পোড়া ঘরের ছাইয়ের ওপর বসে নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিয়েছি। বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া কাপড় রোদে শুকিয়ে পরছি। কিস্তিতে একটা ফ্রিজ কিনেছিলাম সেটিও পুড়ে গেছে।

বারবার এই বস্তিতে আগুন লাগে। নতুন করে সংগ্রাম শুরু করে বস্তিবাসী। আগুন তাদের নিঃস্ব করে দেয়। বস্তির বাসিন্দা মিজানুর রহমান জানান, এর আগেও একবার এ বস্তিতে আগুন লাগে। তখনো সব পুড়ে শেষ হয়ে যায়। কিছুদিন একটু ভালোভাবে জীবনযাপন করা শুরু করলে আবার আমাদের সব কেড়ে নেয় আগুন। তিনি বলেন, রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতে অনেক কষ্ট হয়। দুই ছেলে-মেয়েকে পড়াশোনা করাই। তাদের বই-খাতা সব শেষ হয়ে গেছে। জমানো কোনো টাকাও নেই।

মীনা আক্তার। স্বামীকে নিয়ে ১৫ বছর ধরে থাকেন বস্তিতে। অনেক কষ্ট করে সংসারে কিছু আসবাবপত্র কিনেছিলেন। আগুন তার সবকিছু শেষ করে দিয়েছে। নতুন করে কীভাবে ঘর তৈরি করবেন সেই চিন্তায় দিশাহারা তিনি।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=277601&cat=3