৯ জুন ২০২১, বুধবার, ৩:০৪

ফের বেড়েছে মৃত্যু ও শনাক্ত

সীমান্ত থেকে অন্য জেলায় ছড়াচ্ছে করোনা

দেশে করোনা রোগী শনাক্ত ও মৃত্যু বেড়েই চলছে। একদিনে শনাক্ত আবার দুই হাজার ছাড়িয়েছে সেই সঙ্গে বেড়েছে মৃত্যুও। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরও ৪৪ জন। করোনায় একদিনে মৃত্যুও এক মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হারও বেড়েছে। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় করোনাভাইরাসের প্রকোপ আগে থেকেই বাড়ছিল। এবার তার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হচ্ছে আশপাশের জেলাসহ সদর এলাকাগুলোও। জেলা হিসেবে সাতক্ষীরায় শনাক্তের হার ৫৫ শতাংশের উপরে।
করোনা রোগী বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

এ জেলায় হাসপাতালের শয্যা বাড়ানো ও একটি হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। জেলাগুলো থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায় সীমান্ত জেলাগুলো থেকে পাশের জেলায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের জেলাভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী শনাক্তের হার কিছুটা বেড়েছে রংপুর, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগে। গত দুইদিনের তথ্য পর্যালোচনা করে এসব জানা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গতকাল ঢাকা বিভাগে শনাক্তের হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ছিল ৯ দশমিক ৯৭ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ১১ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ১৬ দশমিক ২৬ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ২৫ দশমিক ৭৩ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ৩৭ দশমিক ১০ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ১৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ।

আগের দিন ৭ই জুন শনাক্তের হার ঢাকা বিভাগে ছিল ৫ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ, ময়মনসিংহ বিভাগে ১০ দশমিক ১৬ শতাংশ, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৩ দশমিক ১৯ শতাংশ, রাজশাহী বিভাগে ১৮ দশমিক ১৫ শতাংশ, রংপুর বিভাগে ২১ দশমিক ৩১ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ৩০ দশমিক ৩৩ শতাংশ, বরিশাল বিভাগে ১৫ দশমিক ১৮ শতাংশ, সিলেট বিভাগে ১৬ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন জানিয়েছেন, করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় চলতি জুন মাস গত মাসের মতো স্বস্তিকর যাবে না বলে মনে করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর অন্যতম কারণ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার। খুলনা, রাজশাহী, যশোর, চাঁপাই নবাবগঞ্জে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে জানিয়ে অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, কেন্দ্র থেকে একটি মেডিকেল টিম চাঁপাই নবাবগঞ্জে অবস্থান করে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। চাঁপাই নবাবগঞ্জে ইতিমধ্যে বলা হয়েছে, জরুরি রোগী ছাড়া যেন কাউকে ভর্তি নেয়া না হয়। প্রয়োজনে পুরো হাসপাতাল করোনা সেবায় ব্যবহার করা হবে। প্রান্তিক অন্য এলাকাগুলোতেও তা-ই বলা হয়েছে।

রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী মানবজমিনকে বলেন, তার হাসপাতালে করোনা রোগী বাড়ছে। পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। অতিরিক্ত রোগী বাড়ায় হাসপাতালে করোনার রোগীদের জন্য দ্রুতই একটি ওয়ার্ড বাড়ানো হবে। এরপর পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে আরও দুইটি ওয়ার্ড বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানান তিনি।

খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায় সংক্রমণ বেশি কেন জানতে চাইলে জেলার সিভিল সার্জন ডা. কেএম হুমায়ুন কবির বলেন, এই জেলায় ছোট ছোট কিছু লাইটার ভারতে থেকে মোংলা বন্দরে আসে। ওখানে মানুষে বাজারে যাওয়া-আসা করে। এতে সন্দেহ করা হচ্ছে এজন্য পুরো মোংলায় সংক্রমণ বেশি। এই জেলায় গত ২৬শে মে থেকেই বাড়ছে সংক্রমণ। তবে জেলায় স্বাস্থ্যবিধি কড়াকড়িভাবে পালনের জন্য বিধিনিষেধ চলছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এতে সংক্রমণ কমে আসবে। সাতক্ষীরা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত মানবজমিনকে বলেন, তার জেলায় ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় জ্বর-সর্দি কাশি উপসর্গের রোগী বেশি দেখা যাচ্ছে। জেলায় বিধিনিষেধ কঠোরভাবে পালন হচ্ছে। হাসপাতালেও চাপ একটু আগের চেয়ে কমছে বলে তিনি মনে করছেন। পিরোজপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. হাসনাত ইউসুফ জাকী জানান, আমরা চারদিনের টেস্টের ফলাফল একসঙ্গে পাই। তাছাড়া প্রতিদিনই দুই একজন করে বাড়ে। টেস্ট কম হচ্ছে কিন্তু সন্দেহজনকভাবে যারা আসছেন তাদের মধ্যে পজেটিভ হওয়ার প্রবণতা বেশি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী জেলায় করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১ হাজার ২৬৩টি, শনাক্ত হয়েছেন ২৯৯ জন অর্থাৎ শনাক্তের হার ২৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। চাঁপাই নবাবগঞ্জে ৬৪৭টি পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছেন ১৮৯ জন। শনাক্তের হার ২৯ দশমিক ২১ শতাংশ। নাটোরে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৩৩৪টি, এতে শনাক্ত ৪২ জন (প্রায় ১৩ শতাংশ)। জয়পুরহাটে ২০৩টি নমুনা পরীক্ষার মধ্যে শনাক্ত ৫৩ জন। শনাক্তের হার ২৫ দশমিক ৬১ শতাংশ। আবার রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁতে ৮৮টি নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছেন ২২ জন (২৫ শতাংশ), দিনাজপুরে ১৪১টি পরীক্ষায় ৪৭ জন শনাক্ত (৩৩ শতাংশ), কুড়িগ্রামে ৩১টি পরীক্ষায় ১০ জন শনাক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ শনাক্তের হার ৩২ দশমিক ২৫ শতাংশ।
এদিকে, খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায় ১৩৯টি নমুনা পরীক্ষায় ৫৩ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৩৮ দশমিক ১২ শতাংশ। সাতক্ষীরায় ১৮৭টি নমুনা পরীক্ষার মধ্যে ১০৩ জন শনাক্ত হয়েছেন। শনাক্তের হার ৫৫ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। খুলনায় ৪৭৯টি নমুনা পরীক্ষার মধ্যে ১৫১ জন শনাক্ত (প্রায় ৩২ শতাংশ), যশোর জেলায় ২৬৩টি নমুনা পরীক্ষায় ১২৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত (প্রায় ৪৮ শতাংশ), চুয়াডাঙ্গায় ৬২টি নমুনা পরীক্ষার মধ্যে ২৮ জন শনাক্ত (৪৫ শতাংশ), মেহেরপুরে ৬৯টি পরীক্ষায় ১৪ জন শনাক্ত। বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর জেলায় ৬টি নমুনা পরীক্ষায় ৪ জন শনাক্ত হয়েছেন। শনাক্তের হার প্রায় ৬৭ শতাংশ।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বিএসএমএমইউ’র সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করে কো-অর্ডিনেশন করা মুশকিল, যদি এসব এলাকায় অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হয় তাহলে একটা সুরাহা হয়। তাতে দ্রুত রোগী শনাক্ত হবে, আর রোগী শনাক্ত হলে তাদের আইসোলেশন করা, রোগীর সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিন করতে সুবিধা হবে। আর যেসব এলাকায় আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাও রয়েছে, সেখানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হলে রোগী শনাক্তের হার আরও বাড়বে, আর তখন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেও সুবিধা হবে।

শনাক্ত আবার ২ হাজার ছাড়ালো, মৃত্যু বেড়ে ৪৪: দেশে একদিনে করোনা রোগী শনাক্ত আবার দুই হাজার ছাড়িয়েছে। এক মাসের বেশি সময় পর শনাক্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৩২২ জনে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে করোনার মৃত্যুও। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আরও ৪৪ জন। করোনায় একদিনে মৃত্যুও এক মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর আগে গত ৯ই মে ৫৬ জনের মৃত্যুর কথা জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গত ২৪ ঘণ্টায় পরীক্ষার বিপরীতে রোগী শনাক্তের হারও বেড়েছে। নতুন ২ হাজার ৩২২ জনকে নিয়ে সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত মোট শনাক্ত ৮ লাখ ১৫ হাজার ২৮২ জন। এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ১২ হাজার ৯১৩ জনে। ২৪ ঘণ্টায় ২ হাজার ৬২ জন এবং এখন পর্যন্ত ৭ লাখ ৫৫ হাজার ৩০২ জন সুস্থ হয়ে উঠেছেন।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=277606&cat=2