৯ জুন ২০২১, বুধবার, ২:৫২

নির্মাণ সামগ্রীর ছাড়ে উদ্যোক্তাদের স্বস্তি মিললেও হতাশ হয়েছেন সাধারণ গ্রাহকরা

প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সিমেন্ট ও স্টিল শিল্পের কাঁচামাল আমদানির ওপর অগ্রিম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর ফলে রড-সিমেন্টসহ বেশ কিছু নির্মাণসামগ্রীর দাম কমার কথা বলা হচ্ছে। বাজেটে সুখবরের আশায় ছিলেন রড সিমেন্টের ক্রেতা বা গ্রাহকেরা। কিন্তু বাজেট ঘোষণার পর তাঁদের হতাশ হতে হয়েছে। তবে দেশীয় উদ্যোক্তারা স্বস্তি পাচ্ছেন। কারণ, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে রডের কাঁচামাল আমদানির ওপর অগ্রিম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। এর ফলে ব্যবসায় লাভ-লোকসান যা-ই হোক, পণ্য উৎপাদনের আগেই কাঁচামাল আমদানিতে তাঁদের অগ্রিম কর পরিশোধ করতে হবে না।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) পক্ষ থেকে বাজেট পরবর্তী এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বাজেট তাদের প্রস্তাবনা রক্ষার কোনও প্রতিফলন পাওয়া যায়নি। এমনকি বাজেটে আবাসন খাতে প্রস্তাবিত আয়করের পরিমাণ পরিবর্তনের ফলে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের মৌলিক অধিকার বাসস্থানের জন্য ব্যয় বেড়ে যাবে। ফলে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে জড়িত ২ কোটি মানুষের আয়ের এ খাতটি আরো মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। আর আবাসন খাতের এই সংকট ২৬৯টি লিংকেজ শিল্পকে আরও সংকটে ফেলবে। তাই প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট পাস করার আগে রিহ্যাবের ১৩ দফা দাবি বিবেচনা দাবি জানানো হয়েছে।

জানা গেছে, অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে এম এস রডের দাম। মাত্র ৬ মাস আগে ৫২ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া ৭৫ গ্রেডের এম এস রড এখন বিক্রি হচ্ছে প্রতি টন ৭২ হাজার টাকায়। সেই হিসেবে, পাইকারি বা মিল পর্যায়ে গত ৬ মাসে প্রতি টন রডের দাম ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে রড তৈরির কাঁচামাল স্ক্র্যাপ ও বিলেটের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যটির দাম বাড়ছে বলে জানিয়েছেন এই খাতের উদ্যোক্তারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রডের দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ আর্ন্তজাতিক বাজারে স্ক্র্যাপ ও স্ক্র্যাপ জাহাজের বুকিং দর বৃদ্ধি। গত বছর ২০২০ সালে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম ছিল ২৬৫-২৭০ ডলারে। চলতি সপ্তাহে স্ক্র্যাপের বুকিং দর ৫৫০-৫৮০ ডলার অর্থাৎ স্ক্র্যাপের প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ইস্পাতের বাজারে বর্তমানে চার কোয়ালিটির এম এস রড রয়েছে। এরমধ্যে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি বা অটো কারখানাগুলোতে তৈরি ৭৫ গ্রেড, সেমি অটো কারখানাগুলোতে তৈরি ৬০ গ্রেড, সাধারণ গ্রেড বা ৪০ গ্রেড এবং কোন সিল বা গ্রেড ছাড়া রড যা বাজারে ‘বাংলা রড’ বলে পরিচিত। ইস্পাতের বাজারে অস্বাভাবিক বেড়েছে ৭৫ গ্রেডের (৫০০ ওয়াট) রডের দাম। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে বাজারে বিভিন্ন ব্রান্ডের প্রতি টন ৭৫ গ্রেডের রড বিক্রি হয়েছে ৭০-৭২ হাজার টাকা দামে। যা আগের সপ্তাহে ৭০ হাজার টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। আর গেল বছরের (২০২০ সাল) নভেম্বরের শেষ দিকে প্রতি টন ৭৫ গ্রেডের রডের দাম ছিল মাত্র ৫০-৫২ হাজার টাকার মধ্যে। সেই হিসেবে, গত ছয় মাসে প্রতি টন ৭৫ গ্রেডের রডের দাম বেড়েছে ২০-২২ হাজার টাকা।

প্রস্তাবিত বাজেটে ইস্পাত শিল্পের কাঁচামাল ও রাসায়নিক মিলিয়ে প্রধান চারটি পণ্য আমদানিতে অগ্রিম কর প্রত্যাহার করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে স্ক্র্যাপ বা পুরোনো লোহার টুকরা, পুরোনো জাহাজ, স্পঞ্জ আয়রন ও ফেরো অ্যালয় নামের রাসায়নিক। এসব কাঁচামাল ও রাসায়নিক আমদানিতে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে অগ্রিম কর ছিল চার শতাংশ। তার আগে ছিল পাঁচ শতাংশ। আমদানির পর অবশ্য এই কর সমন্বয় করা হয়ে থাকে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের অন্যতম উপকরণ হচ্ছে সিমেন্ট, লৌহ এবং লৌহজাত পণ্য। এসব পণ্য উৎপাদনে নিয়োজিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানকে করসুবিধা দেওয়া হলে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ সহজ ও সাশ্রয়ী হবে। বাজেট বক্তৃতায় তিনি অগ্রিম কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব দেওয়ার দিনেই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে।

অগ্রিম কর কমানোয় মূলত সুবিধা পাবেন উদ্যোক্তারা। শুল্ক কমালে পরোক্ষভাবে সুবিধা পেতেন ভোক্তারা। কিন্তু বাজেটে রড তৈরির কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কর কমানো হয়নি। শুধু স্টেইনলেস স্টিল বা মরিচারোধী ইস্পাতের পুরোনো টুকরা বা বর্জ্য আমদানিতে টনপ্রতি নির্ধারিত শুল্ক দেড় হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ৫০০ টাকা করা হয়েছে। বিস্ময়কর হলো, গত পাঁচ বছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে এই পণ্য এক কেজিও আমদানি হয়নি। বরং এই পণ্য দেশ থেকে রপ্তানি হয়। চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে মরিচারোধী এই ইস্পাতের পুরোনো টুকরা রপ্তানির ফলে দেশে ৩ কোটি ১৭ লাখ ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা এসেছে।

এ বিষয়ে রড উৎপাদনকারি কোম্পানিগুলো জানান, আগাম কর বাবদ শীর্ষস্থানীয় কোম্পানিগুলোর বছরে ৫০ থেকে দেড়শ’ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হতো। এটা চলতি মূলধনের টাকা। এই টাকা আটকে থাকায় এত দিন পুঁজিতে টান পড়তো। অগ্রিম কর প্রত্যাহারের ফলে এই টাকা আর আটকে থাকবে না। মূলধন আটকে না থাকলে সুদও দিতে হবে না। তাই বলব, সরকার খুব ভালো একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বাজেট উদ্যোক্তাদের এমন স্বস্তি এনে দিলেও গ্রাহকদের জন্য স্বস্তির খবর নেই। কারণ বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম গেল নভেম্বর থেকে ঊর্ধ্বগতিতে ছুটছে। যেমন, নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল গলনশীল ভারী লোহার টুকরা (এইচএমএস) বিশ্ববাজারে টনপ্রতি ৩১০-৩১২ ডলারে বেচাকেনা হয়েছিল। উত্থান-পতন শেষে সম্প্রতি বিশ্ববাজারে একই ক্যাটাগরির কাঁচামাল বিক্রি হয়েছে ৫০৫ থেকে ৫২২ ডলারে। টনপ্রতি দাম বেড়েছে ১৯৫-২১০ ডলার।

ইস্পাতের কাঁচামালের ৯৫ শতাংশের বেশি আমদানি করে স্থানীয় চাহিদা মেটানো হয়। তাই বিশ্ববাজারে দাম বাড়ার প্রভাব পড়েছে দেশের বাজারে। এখন কোম্পানিভেদে প্রতি টন ভালো মানের রড বিক্রি হচ্ছে ৬৯ হাজার থেকে ৭৪ হাজার টাকা, যা গত বছরের নভেম্বরের তুলনায় ২০-২২ হাজার টাকা বেশি। দাম বাড়ায় নির্মাণশিল্পে ব্যয় বেড়েছে।

গ্রাহকরা বলছেন, দেশে রডের দাম যেমন চড়া, তেমনি বাজেটেও সুখবর নেই। রডের দাম গত ছয় মাসে যেভাবে বেড়েছে, তাতে গ্রামে বাড়ির কাজে হাত দেওয়ার সাহস পাচ্ছেন না তারা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিশ্ববাজারে ইস্পাতের কাঁচামালের দাম বাড়ায় ভারত ও চীন শুল্ক প্রত্যাহার করেছে। আমাদের এখনো টনপ্রতি ১ হাজার ৫০০ টাকা শুল্ক রয়ে গেছে। এটা প্রত্যাহার হলে ভোক্তাদের জন্য স্বস্তি থাকত।
এদিকে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে আবাসন খাতের ব্যবসায়ীদের সংগঠন রিহ্যাবের একটি সুপারিশও রাখা হয়নি। ১৩টি প্রস্তাবের সব প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন রিহ্যাব নেতারা। তারা বলেছেন, আবাসন খাতে ক্রান্তিকাল চলছে। এ অবস্থা উত্তরণে বিশেষ অর্থায়ন তহবিল, জমি ও ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশন ব্যয় কমানো ও কর অবকাশ সুবিধাসহ কিছু সুপারিশ বাজেট অনুমোদনের সময় অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানিয়েছেন তারা।

রিহ্যাব সভাপতি বলেন, বাজেটে এফবিসিসিআইর কিছু প্রস্তাব রাখা হয়েছে। কিন্তু রিহ্যাব ১৩টি দাবি জানালেও তার একটিও রাখা হয়নি। এতে আমরা সত্যিই লজ্জিত। আমরা ভবিষ্যতে এনবি আরের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনা করব কি-নাথ তা নিয়ে সন্দেহ আছে। তিনি বাজেট পাস করার সময় অন্তত ৭টি দাবি বিবেচনার অনুরোধ জানান।

খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সিমেন্ট খাতে যে করভার কমানো হয়েছে, তা খুবই নগণ্য। বিশ্ববাজারে সিমেন্টের কাঁচামালের দাম বাড়ার কারণে বাজেটে দেওয়া এ ছাড় দামের ক্ষেত্রে তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না। আবার উদ্যোক্তারাও খুব বেশি লাভবান হবেন না। সিমেন্ট যেহেতু নির্মাণশিল্পের অন্যতম উপকরণ, সে কারণে বাজেটে নির্মাণশিল্প খুব বেশি সুবিধাভোগী হচ্ছে না। সিমেন্টের কাঁচামাল আমদানিতে অগ্রিম আয়কর ও ভ্যাটের অগ্রিম কর ১ শতাংশ করে কমানো হয়েছে। এর ফলে অগ্রিম কর বাবদ প্রতি বস্তা সিমেন্টে তিন টাকা কমতে। সিমেন্টের অন্যতম কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে শুল্কহার এখন টনপ্রতি ৫০০ টাকা। আমাদের দাবি ছিল, আমদানি মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ শুল্কহার ধার্য করার। সেটি করা হলে ভোক্তারা কিছুটা হলেও সুবিধা পেত। প্রতি ব্যাগ সিমেন্টে ১২-১৩ টাকা খরচ কম পড়ত।

https://dailysangram.com/post/454902