৯ জুন ২০২১, বুধবার, ২:৩৩

দীর্ঘ অপেক্ষার পর খুলবে কী! শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কপাট!

অধ্যাপক এ.বি.এম. ফজলুল করীম : ॥ গতকালের পর ॥
এছাড়া গ্রামে ইন্টারনেটের ধীরগতি মারাত্মক, যা দিয়ে অনলাইন ক্লাস ঠিকমতো করাটাও সম্ভব নয়। গ্রামের শিক্ষার্থীদের কথা কেউ ভাবছেন না। বেশিরভাগ নিম্নআয়ের পরিবারের সন্তানরা হয়তো আর স্কুলেই ফিরতে পারবে না। ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে অনেকেই করোনাকালীন উপার্জনের পথ বেছে নিয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় নিশ্চিতভাবে ঝরে পড়বে অনেক শিক্ষার্থী, যারা আর কোনোদিন ছাত্রজীবনে ফিরতে পারবে না। সেশনজট ও বেকারত্বের চিন্তায় অনেকে হারিয়ে ফেলবে পড়ালেখার আগ্রহ। ক্যাম্পাস খুললে করোনা হবে, কিন্তু বন্ধ থাকলে করোনা হবে না- এমন ভিত্তিহীন তথ্যের ওপর নির্ভর করে এভাবে লাখ লাখ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন ধ্বংস করা কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ বলেন, স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখায় করোনা সংক্রমণ লাগামের মধ্যে এসেছে- এমন কথা বলার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বিগত সময়ে নেই। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায় ২০২০ সালের ১২ জুলাই থেকে হেফজখানা ও পরবর্তীতে কওমী মাদ্রাসা খুলে দেওয়ায় ছাত্ররা করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এমন কোন সংবাদ ফেডারেশনের নেতৃবৃন্দ বলেন আমাদের জানা নেই। তাই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে স্থানীয় চাহিদা ও পরিবেশ-পরিস্থিতি অনুযায়ী এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে পরামর্শ করে নমনীয় সিলেবাস তৈরি করা একান্ত প্রয়োজন এবং ২০২১ সালের ১৩ই জুন থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত বাস্তাবায়ন করা অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।

একজন শিক্ষার্থী যখন স্কুল, কলেজের গন্ডি অতিক্রম করে বিশ্বদ্যিালয় অঙ্গনে পা রাখে, স্বভাবতই তার কাছ থেকে পরিবারের প্রত্যাশা বেড়ে যায়। মা-বাবা অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকে সন্তান শিগগির সংসারের হাল ধরবে বলে। অনেকেরই এই সময়ে পরিবারকে সাপোর্ট দিতে হয় ।
ঠিক এমন একটা বয়সকালে যখন অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে, তখন শিক্ষার্থীদের বিকল্প কোনো পথ থাকে না । এই পরিস্থিতিতে কোনো কোনো শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা এতটাই বিপন্ন যে, অনেক সময় তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

মহামারি করোনা ভাইরাসকে প্রথম দিকে হেলথ ক্রাইসিস বা স্বাস্থ্যগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে এটি মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলেছে বেশি। বাধ্যতামূলকভাবে সামাজিক দূরত্বসৃষ্টির কারণে প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী ১৫ মাসেরও বেশি ঘর বন্দী হয়ে আছে । দীর্ঘদিন বন্দীদশায় কাটানোর কারণে তাদের মানসিক স্বাস্থেও অবস্থা অত্যান্ত শোচনীয়। সি এন এন এর তথ্য অনুযায়ী, ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী লকডাউনের বিরুপ প্রতিক্রিয়ার শিকার। ওয়ার্ল্ড ভিশনের আর এক জরিপে দেখা গেছে, ৯১ শতাংশ শিক্ষার্থী মানসিক চাপে রয়েছে, যেটা খুবই স্ট্রেসফুল।
ভাইরাসের দৌরাত্ব বিবেচনায় রেখে বিভিন্ন দেশ জারী করেছে লকডাউন, শাটডাউন, কারফিউসহ বিভিন্ন সামাজিক দুরুত্ব সুষ্টিকারী মাধ্যম। পরে করোনা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে যুগোপযোগী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে লকডাউনের ক্ষতি উতরে নিয়েছে এই দেশসমূহ। এমনকি বিভিন্ন দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়েছে ইতিমধ্যে। ইউরোপের প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো সরাসরি ক্লাস নিচ্ছে মে মাস থেকে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মানসিক ঝুঁকি বিবেচনায় রেখে শিগগির সম্পূর্ণভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিভিন্ন দেশ।
জরিপ মোতাবেক ৬৯ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণই করতে পারেনি। এই বছর করোনায় মৃত্যুর চেয়ে আত্মহত্যায় মৃত্যুবরণ করেছে প্রায় দ্বিগুন শিক্ষার্থী, যার অধিকাংশই মানসিক হতাশার কারণে।

গত বছরের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের ‘অটোপাস’ দিয়ে অনেকটাই সমালোচনার মুখে পড়েছে শিক্ষা প্রশাসন। তাই আপাতত বড় কোনো পাবলিক পরীক্ষায় অটোপাসের চিন্তা সরকারের নেই। ফলে চলতি বছরের ৪০ লাখ এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার্থী নিয়ে মহাসংকটে পড়েছে সরকার। এসব শিক্ষার্থীকে ক্লাস না করিয়ে কোনোভাবেই পরীক্ষা নেওয়া যাচ্ছে না। তাই সরাসরি ক্লাস রুমে নেওয়া দরকার।
জুন-জুলাইয়ে হওয়ার কথা ছিল চলতি বছরের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এ পরীক্ষা নিয়েও দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। পরীক্ষার্থীরা অটোপাসের দাবি তুললেও তা দেয়া হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ৬০ ও এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের ৮০ দিনের সংক্ষিপ্ত সিলেবাস পড়িয়ে নেয়া হবে পরীক্ষা। আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় সাব-কমিটির সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নেহাল আহমেদ বলেন, এসএসসি-এইচএসসির জন্য সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে দিয়েছি। এসএসসি পরীক্ষা হয়তো দু-এক মাস পিছিয়ে যেতে পারে। পরীক্ষা না হলে শিক্ষার্থীদের অটোপাস দেয়া হবে না। প্রয়োজনে বিকল্প পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে। বিজ্ঞজনরা বলছেন এসব বাদ দিয়ে এর সমাধান হচ্ছে শিক্ষা প্রাতিষ্ঠান খুলে দিয়ে লেখা পড়ার ব্যবস্থা করা উত্তম।

সরকারের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার পর ৬০ কর্মদিবস এসএসসি পরীক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়া হবে। আর ৮৪ কর্মদিবস ক্লাস হবে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের। সেটা অনুযায়ীই কাস্টমাইজড সিলেবাস তৈরি করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের কতটুকু ক্ষতি হলো, তা দীর্ঘ ১৫ মাসেও মূল্যায়ন করা যায়নি। কত শিক্ষার্থী পড়াশোনার বাইরে চলে গেল, তারও হিসাব নেই। অস্থায়ীভাবে যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেগুলো মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলা ও পরীক্ষা ঘিরে। সেগুলোও বাস্তবায়িত হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষার এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দু-তিন বছরের জন্য কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়ে এখন থেকেই কাজ শুরু করতে হবে। না হলে ক্ষতির প্রভাব পড়বে দীর্ঘ মেয়াদে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ক্ষতি বহুমাত্রিক। শিক্ষক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন শ্রেণিকক্ষের বাইরে। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ভুলে যাচ্ছে। বড় ঘাটতি নিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠছে। পরীক্ষা নিতে না পারায় শেখার দক্ষতা যাচাই হচ্ছে না। সরাসরি শিক্ষার ক্ষতির বাইরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সামাজিক ও মানসিক প্রভাবও রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং ঝরেপড়া বাড়ছে। কিশোরীদের অনেকে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা সেশনজটে পড়ে কর্মজীবনে প্রবেশে পিছিয়ে যাচ্ছেন। পরীক্ষা না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজট বাড়ছে। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়য়ের শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি সংকটে আছেন। অবশ্য অনলাইনে ক্লাসের ব্যবস্থা হয়েছে। কিন্তু অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস শেষ হলেও চূড়ান্ত পরীক্ষা আটকে আছে।

সংকট থেকে উত্তরণে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। তারা কেবল সংকট নিয়ে আলোচনা করেছে, সমাধানে জোরালো কোনো পদক্ষেপ নেই। ইউজিসির কয়েকজন কর্মকর্তার মত হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন ইচ্ছে করলে বিভিন্ন বর্ষের পরীক্ষাগুলো স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিতে পারত। আবাসিক হলগুলোয়ও ভিড় এড়াতে ধাপে ধাপে পরীক্ষা নেওয়া যেত। কিন্তু তারা এটি করতে পারেনি।

শিক্ষাবিদরা বলেন, দুই মন্ত্রণালয় কোনোরকমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কবে খোলা যাবে, সেটা নিয়েই বেশি ভাবছে। কিন্তু এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধের কারণে যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণে দুই থেকে তিন বছরের পরিকল্পনা নিতে হবে। এবার জাতীয় বাজেটের ২০ শতাংশ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ রাখা উচিত ছিল বলে শিক্ষাবিদরা মনে করেন।

গত ৩ মার্চ ইউনিসেফের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে মাত্র ১৩টি দেশে। এই দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিন এশিয়া থেকে আছে শুধু বাংলাদেশ। এসব দেশে দীর্ঘ সময় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ১৬৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী। এর মধ্যে বাংলাদেশেরই রয়েছে ৩৭ মিলিয়ন শিক্ষার্থী।

কোভিশিল্ডের প্রথম ডোজ নেওয়া প্রায় ১৫ লাখ মানুষের দ্বিতীয় ডোজ টিকা নেওয়াই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে থাকা এক লাখ ত্রিশ হাজার শিক্ষার্থীকে টিকা দেওয়ার জন্য তাঁদের তালিকা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে পাঠানো হলেও খুব অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীই তা পেয়েছে। শিক্ষকদের বড় অংশই এখোনো টিকা নিতে পারেনি। আর কলেজের শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়ার কোনো পরিকল্পনার কথা করো জানা নেই। কবে টিকা সহজলভ্য হবে আর কবে শিক্ষার্থীদের টিকা দেওয়া হবে, তা বলতে পারছেনা কেউ। তাহলে কবে খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ? সে প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।

শিক্ষার্থীদের পদচারন মার্কেট, বাজার, রাস্তাঘাটসহ সব জায়গায়ই। শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ক্ষেত্রেই করোনার ভয় করা হচ্ছে যা আমাদের বোধগম্য নয়।

বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো প্রায় ১৫ মাস বন্ধ ি থাকায় তারা বাড়িভাড়া ও শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছেন না। তাছাড়া ৫০% শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চিরতরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় সরকারের উচিৎ ইউনিয়ন ও থানা ভিত্তিক ক্ষতিগ্রস্থ মাদ্রাসা, স্কুল ও কলেজের তালিকা তৈরী করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক কর্মচারীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান করা। পরিশেষে আমরা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের নিকট দোয়া করবো আল্লাহ পাক যেন আমাদের কলিজার টুকরা সন্তান শিক্ষার্থীদের সুস্থ রেখে মেধা বিকাশের সুযোগ করে দিন। আমীন। (সমাপ্ত)
(লেখক : বাংলাদেশ আদর্শ শিক্ষক ফেডারেশনের জেনারেল সেক্রেটারি ও সাবেক সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)

https://dailysangram.com/post/454899