৮ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ২:০০

৩৮ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত

দেশে করোনার সংক্রমণ বেশ ঊর্ধ্বগতিতে হাঁটছে। সঙ্গে বেড়েছে মৃত্যুও। একদিনে ১ হাজার ৯৭০ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। যা গত ৩৮ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। তবে দেশের অন্যান্য স্থানের তুলনায় সীমান্তবর্তী ও এর আশেপাশের জেলাগুলোতে করোনার প্রকোপ অপেক্ষাকৃত বেশি। বাগেরহাট জেলায় গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ৫৫ দশমিক ১৭ শতাংশ, সাতক্ষীরায় ৫৩ দশমিক ১৯ শতাংশ আর কুড়িগ্রাম জেলায় শনাক্তের হার শতভাগ। করোনার প্রকৃত চিত্র বুঝতে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।

জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনতে স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী যেসব জেলায় সংক্রমণ বেশি, সেখানে কঠোর লকডাউন জোরদার করতে হবে।

নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে, রোগী শনাক্ত এবং কন্টাক্ট ট্রেসিং করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, দেশে বর্তমানে ৫১০টি পরীক্ষাগারে করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এরমধ্যে আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে হচ্ছে ১৩২টি পরীক্ষাগারে, জিন এক্সপার্ট মেশিনের মাধ্যমে ৪৪টি পরীক্ষাগারে এবং র‌্যাপিড অ্যান্টিজেনের মাধ্যমে ৩৩৪টি পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।

এদিকে চলতি জুন মাস নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, গত মাসের মতো এটা স্বস্তির মাস নাও হতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন জানিয়েছেন, খুলনা, রাজশাহী, যশোর, চাঁপাই নবাবগঞ্জে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়েছে। চাঁপাই নবাবগঞ্জে জরুরি রোগী ছাড়া যেন কাউকে ভর্তি নেয়া না হয়, সে বিষয়ে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে পুরো হাসপাতাল করোনা সেবায় ব্যবহার করা হবে। প্রান্তিক অন্য এলাকাগুলোতে তা-ই বলা হয়েছে। রোগী বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর হারও বেড়েছে বলে জানান তিনি। অধ্যাপক রোবেদ আমিন বলেন, গত ৩০শে মে থেকে সংক্রমণের হার উঠানামা করছে। এখন আমরা যে পর্যায়ে আছি, তাতে বলতে পারবো না যে অবস্থা স্থিতিশীল। এখন পর্যন্ত আমাদের ট্রান্সমিশন আনস্টেবল। তিনি বলেন, জুন মাস গত মাসের মতো স্বস্তিকর যাবে বলে মনে হচ্ছে না।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে দেখা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী বিভাগের রাজশাহী জেলায় করোনার নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৯৮৫টি, শনাক্ত হয়েছেন ২৭০ জন অর্থাৎ শনাক্তের হার ৩০ দশমিক ১৬ শতাংশ। চাঁপাই নবাবগঞ্জে ৩৯২টি পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছেন ৭৫ জন। যা ১৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। নাটোরে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৯৭টি, এতে শনাক্ত ৩৫ জন (৩৬ শতাংশ)। আবার রংপুর বিভাগের ঠাকুরগাঁতে ৭৯ নমুনা পরীক্ষায় শনাক্ত হয়েছেন ১৮ জন, দিনাজপুরে ১৫৮টি পরীক্ষায় ৩৩ জন, কুড়িগ্রামে ২টি পরীক্ষায় ২ জনই শনাক্ত হয়েছেন। অর্থাৎ শনাক্তের হার শতভাগ।

এদিকে, খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায় ৫৮টি নমুনা পরীক্ষায় ৩২ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। শনাক্তের হার ৫৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। সাতক্ষীরায় ৯৪টি নমুনা পরীক্ষায় মধ্যে ৫০ জন শনাক্ত হয়েছেন। শনাক্তের হার ৫৩ দশমিক ১৯ শতাংশ। খুলনায় ৩০৩টি নমুনা পরীক্ষায় মধ্যে ৭৯ জন শনাক্ত (২৬ শতাংশ), যশোর জেলায় ৫১৭টি নমুনা পরীক্ষায় ১৬১ জন করোনা রোগী শনাক্ত, মেহেরপুরে ৩১টি পরীক্ষায় ১০ জন শনাক্ত, নড়াইলে ৩৩টিতে ১৭ জন শনাক্ত। এই জেলায় শনাক্তের হার প্রায় ৫২ শতাংশ। ঝিনাইদহে ৬৯টিতে ৮ জন শনাক্ত। বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর জেলায় ২৮টি নমুনা পরীক্ষায় ১৫ জন শনাক্ত হয়েছেন। শনাক্তের হার প্রায় ৫৪ শতাংশ।

খুলনা বিভাগের বাগেরহাট জেলায় দেশের করোনার শনাক্তের হার সবচেয়ে বেশি। যা ৫৫ দশমিক ১৭ শতাংশ। কেন এই জেলায় সংক্রমণ এত বেশি জানতে চাইলে জেলার সিভিল সার্জন ডা. কেএম হুমায়ুন কবির মানবজমিনকে গতকাল বলেন, এই জেলায় ছোট ছোট কিছু লাইটার ভারত থেকে মোংলা বন্দরে আসে। ওখানে মানুষ বাজারে যাওয়া-আসা করে। এতে সন্দেহ করা হচ্ছে এজন্য পুরো মোংলায় সংক্রমণ বেশি। এই জেলায় গত ২৬শে মে থেকেই বাড়ছে সংক্রমণ। তবে জেলায় স্বাস্থ্যবিধি কড়াকড়িভাবে পালনের জন্য বিধিনিষেধ চলছে। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, এতে সংক্রমণ কমে আসবে। সাতক্ষীরা জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত মানবজমিনকে বলেন, তার জেলার ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকায় জ্বর-সর্দি কাশি উপসর্গের রোগী বেশি দেখা যাচ্ছে। জেলায় বিধিনিষেধ কঠোরভাবে পালন হচ্ছে। হাসপাতালেও চাপ একটু আগের চেয়ে কমছে বলে তিনি মনে করছেন।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য এবং বিএসএমএমইউ’র সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে নমুনা পরীক্ষা করে কো-অর্ডিনেশন করা মুশকিল, যদি এসব এলাকায় অ্যান্টিজেন টেস্ট করা হয় তাহলে একটা সুরাহা হয়। তাতে দ্রুত রোগী শনাক্ত হবে, আর রোগী শনাক্ত হলে তাদের আইসোলেশন করা, রোগীর সংস্পর্শে আসাদের কোয়ারেন্টিন করতে সুবিধা হবে। আর যেসব এলাকায় আরটি-পিসিআরের মাধ্যমে পরীক্ষার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতাও রয়েছে, সেখানে অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করা হলে রোগী শনাক্তের হার আরও বাড়বে, আর তখন সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতেও সুবিধা হবে।

ভারতীয় তথা ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে শনাক্ত হয়েছে এবং সেটা এখন বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে জানিয়ে অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন বলেন, ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ ক্ষমতা অন্য ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে অনেক বেশি। আর সংক্রমণ অনেক বেশি হলে মৃত্যুর সংখ্যাও অনেক বেশি হবে। তবে দেশে করোনার নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা আরও বাড়ানোর জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর চেষ্টা করছে জানিয়ে রোবেদ আমিন বলেন, বিশেষ করে র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট বাড়ানোর জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে। বর্ডারে, যেসব জায়গা থেকে মানুষ আসা যাওয়া করছে বিশেষ করে যেখানে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টসহ করোনার সংক্রমণ অনেক বেড়ে যাচ্ছে সেখানে যেকোনো লক্ষ্মণসহ সমস্যা এলেই অ্যান্টিজেন টেস্ট ব্যবস্থাকে সহজ করতে হবে। চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী যারা আছেন যেন র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন করতে থাকেন। এতে কেউ আক্রান্ত হলে এক ঘণ্টার মধ্যে শনাক্ত হবেন এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া যাবে।

গত ৩৮ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ শনাক্ত: এদিকে, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় নতুন করে শনাক্ত হয়েছেন ১ হাজার ৯৭০ জন। এখন পর্যন্ত করোনা সরকারি হিসাবে শনাক্ত হলেন ৮ লাখ ১২ হাজার ৯৬০ জন। এ ছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩০ জন। এ পর্যন্ত মারা গেলেন মোট ১২ হাজার ৮৬৯ জন। ১ হাজার ৯৭০ জন শনাক্ত গত ৩৮ দিনের মধ্যে সর্বোচ্চ। এর আগে গত ৩০শে এপ্রিল ২ হাজার ১৭৭ জন শনাক্তের খবর দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এরপর এটিই সর্বোচ্চ শনাক্ত।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা বিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরও জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা রোগী শনাক্তের হার ১১ দশমিক ৪৭ শতাংশ আর এখন পর্যন্ত দেশে করোনা শনাক্তের হার ১৩ দশমিক ৪০ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৯২ দশমিক ৬৫ শতাংশ। মৃত্যুর হার ১ দশমিক ৫৮ শতাংশ। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনা থেকে সুস্থ হয়েছেন ১ হাজার ৯১৮ জন, এদের নিয়ে দেশে করোনা থেকে সুস্থ হলেন ৭ লাখ ৫৩ হাজার ২৪০ জন। এই সময়ে করোনার নমুনা সংগৃহীত হয়েছে ১৭ হাজার ৬৬৬টি। নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১৭ হাজার ১৬৯টি। দেশে এখন পর্যন্ত করোনার মোট নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৬০ লাখ ৬৭ হাজার ৪২টি। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ৩০ জনের মধ্যে পুরুষ ১৯ জন আর নারী ১১ জন। এখন পর্যন্ত দেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে পুরুষ মারা গেলেন ৯ হাজার ২৭৫ জন আর নারী ৩ হাজার ৫৯৪ জন। এদের মধ্যে ষাটোর্ধ্ব রয়েছেন ২২ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে আছেন ২ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে আছেন ৩ জন আর ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে আছেন ৩ জন। মারা যাওয়া ৩০ জনের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ৭ জন, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১ জন, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের ২ জন করে, খুলনা বিভাগের ৩ জন, সিলেট বিভাগের ৪ জন এবং রংপুর বিভাগের আছেন ১ জন। এদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে মারা গেছেন ১৭ জন, বেসরকারি হাসপাতালে ১০ জন এবং বাসায় ৩ জন।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=277428&cat=2