গতকাল সোমবার ভোররাতে রাজধানীর মহাখালী ৭ তলা বস্তিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে -সংগ্রাম
৮ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:৪৯

ফের আগুনে পুড়ল সাততলা বস্তির সহস্রাধিক ঘর ॥ খোলা আকাশের নিচে সবহারা মানুষ

ছয় মাসের ব্যবধানে ফের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে রাজধানীর মহাখালীর সাততলা বস্তিতে। রোববার রাত সোয়া ৪টার দিকে আগুন লাগার পর প্রায় আড়াই ঘণ্টার চেষ্টায় ফায়ার সার্ভিসের ১৮টি ইউনিট গতকাল সকাল পৌনে ৭টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। আগুনে প্রায় এক হাজার ঘর পুড়ে গেছে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ঘরপোড়া মানুষের পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। গভীর রাতে আগুন লাগার কারণে ঘরের আসবাবপত্র কেউ নিয়ে বের হতে পারেনি। দিন আনে দিনে খায় গোছের মানুষগুলোর ঠাঁই এখন আকাশের নিচে। এ ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ১৮টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করেছে। বস্তিতে অবৈধভাবে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংযোগ দেওয়া হয়েছে। গ্যাস সংযোগ থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তদন্তের বাইরে স্পষ্ট করে বলা যাবে না। তিনি বলেন, ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক নুর হাসানকে সভাপতি করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা সবকিছু তদন্ত করে প্রতিবেদন জমা দেবেন। এক প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিস ডিজি বলেন, প্রায় শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে। দুয়েকজন সামান্য আহত হলেও বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, সবহারিয়ে আগুনে পোড়া বস্তিবাসিরা আহাজারি করছেন। বৃদ্ধা জুলেখা বেগম বলেন, ‘আমাগো সব শেষ। এই ঘরে তিন হাজার টাহা ভাড়া দিয়া মাসে থাকতাম আমরা বুড়া-বুড়ি। আমি মাইনসের বাড়িত কাম করতাম। সরকারের দেয়া ১০ কেজি চাইল, কয়ডা সাবান, আর ১০ কেজি তেল জমাইছিলাম। সব গেছেগা।’ নির্মম আগুনে নির্বাক তারা। বস্তিটিতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো বস্তির অর্ধেক অংশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। বাকি অর্ধেকে আগুনের ছোঁয়া লাগেনি। ফায়ার সার্ভিস থেকে বলা হয়েছে, প্রায় ২ হাজার ঘর আছে এই সাততলা বস্তিতে, যার অর্ধেকই পুড়ে ছাই।

বস্তিবাসীরা জানান, ভোররাতে আগুনের সূত্রপাত হয় বস্তির মাঝখানের একটি ঘরে। ভেবেছিলেন নিজেরাই নিভিয়ে ফেলবেন সে আগুন। তাই যে যার মতো ছুটে গিয়েছিলেন সেই ঘরের দিকে। কিন্তু হঠাৎ শুরু হলো দখিনা বাতাস, আগুনের মুখ ছুটে গেল উত্তর দিকে। এক ঘর দুই ঘর করে আগুন ছড়াল বস্তির উত্তর দিকের সব ঘরে। পোড়া বস্তিতে দেখা গেল এক বৃদ্ধ দম্পতিকে। তাদের মালামালের সবই পুড়ে ছাই। আধপোড়া কিছু চাল কুড়াতে ব্যস্ত তারা। বস্তিবাসি জুলেখা বেগম বলেন, ‘আল্লায় খালি গরিবরেই মারে বাজান। আমাগো সব শেষ।

দুই ছেলে ও দুই মেয়েকে নিয়ে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে থাকতেন জাহানারা বেগম। ২০ বছর ধরে তিল তিল করে গড়া স্বপ্ন চোখের পলকে পুড়ে যাচ্ছিল, অথচ শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না তার। ঘাম-শ্রমে দীর্ঘ দুই দশকে তিলে তিলে জাহানারা গড়েছিলেন স্বপ্নের ঘর। সেখানে ছিল দামি টিভি, ফ্রিজসহ যাবতীয় আসবাবপত্র। জাহানারা বেগম বলেন, এই বস্তিতেই জন্ম। স্বামী ৮ বছর আগে মারা গেছে। ৪ লাখ টাকা ঋণ করে ঘর তুলেছিলাম। কিন্তু ঋণ পরিশোধ হতে না হতেই ঘরের সব আসবাবপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। ঘরে ছিল নগদ ২০ হাজার টাকা। তাও পুড়ে গেছে। তিনি বলেন, বারবার আমাদের মতো গরীবদের উপর অত্যাচার কেন হয়? আমরাই কেন এই আগুনের শিকার হই? এর উত্তর হয়তো কারো কাছে নেই। কিন্তু এই স্বপ্নের সংসার যখন পুড়ে ছাই হয়ে যায় তখন কার কাছেই কী বলব? বলার অবস্থাটুকুও নেই। বস্তিবাসীরা জানান, আগুনের সূত্রপাত বস্তির পশ্চিম-দক্ষিণ দিক থেকে। এরপর দ্রুত আগুন ছড়িয়ে পড়ে বস্তির উত্তর-পূর্ব দিকে। একে একে পুড়ে যায় শত শথ ঘর।

বস্তির পাশে ফুটপাতে লুঙ্গি ব্যবসা করেন আবদুল গফফার। তার বাসাও বস্তির ভেতরে। আগুন লাগার খবর শুনে তিনি ঘর থেকে বালতি নিয়ে আগুন নেভাতে যান। আগুনের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকলে নিজের ঘরের দিকে এসে দেখেন তার ঘরেও আগুন চলে এসেছে। এরপর স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে আসেন। তিনি বলেন, ঘরে কিছু নগদ টাকা ছিল। লুঙ্গির লট ছিল, আরও ছিল টিভি, ফ্রিজসহ দামি আসবাবপত্র। কিন্তু ঘরে আগুন লাগার কারণে ঘর থেকে কিছুই বের করতে পারিনি। ঘর পুড়ে নিঃস্ব অবস্থায় এখন তার ঠাই হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। সকালে এবং দুপুরের খাবারও খাননি তিনি। নীলুফা বেগম নামের এক বস্তিবাসী জানান, লোন করে ৬০ হাজার টাকায় ফ্রিজ কিনেছিলেন। ফ্রিজের অর্ধেক লোনও পরিশোধ হয়নি। ঘরের বিন্দুমাত্র অক্ষত নেই। সব পুড়ে শেষ। ‘এখন লোন দেব কীভাবে, আর খাবই বা কী তা চিন্তা করতে পারছি না।’ অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত বস্তির বাসিন্দার দাবি, আগুনে সব পুড়ে ছাই গেছে। অধিকাংশ মানুষই সন্তান কোলে এক কাপড়ে ঘর থেকে ছুটে বেড়িয়েছেন জীবন রক্ষার তাগিদে।

পুড়ে কয়লা হওয়া ঘরে দাঁড়িয়েছিলেন রংপুরের সীমা বেগম। তার স্বামী কামাল রিকশা চালান। সীমার বাসা-বাড়িতে কাজ করেন। সন্তান আর স্বামীকে নিয়ে তার দুই ঘরে আট সদস্যের সংসার। রাতে সবাই একসঙ্গেই ঘুমিয়েছিলেন। সকালেই দেখলেন পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছু নেই তাদের। ঠাঁই হয়েছে খোলা আকাশের নিচে। এদিকে গতকাল দুপুরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, সাততলা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে পাঁচ হাজার করে নগদ টাকা, টিন, শুকনা খাবার এবং প্রতি বেলায় খাবার রান্না করে দেয়া হবে। ডিএনসিসি মেয়র বলেন, আমি পুড়ে যাওয়া বস্তিবাসীর সঙ্গে কথা বলেছি। আপাতত তাদের ঘরের জন্য টিন দিতে হবে এবং এই মুহূর্তে খাদ্য লাগবে। ইতোমধ্যে কাউন্সিলর খাবার রান্নার কাজ শুরু করেছেন। প্রতিটি পরিবারের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দুপুর থেকে খাবার চালু হবে এবং রাতেও বস্তিবাসীকে খাওয়ানো হবে। যতক্ষণ ত্রাণ না এসে পৌঁছাবে ততক্ষণ খাবার বিতরণ করা হবে। এছাড়াও শুকনা খাবার প্যাকেট বিতরণ করা হবে। একটি মানুষও অভুক্ত থাকবে না।

মিরপুরের বাসায় অগ্নিদগ্ধ নারী: এদিকে রাজধানীর মিরপুরে মধ্য রাতে আগুনে দগ্ধ হয়েছেন এক নারী। মাহমুদা সিহাবুম মুবিন মৌ (৩০) নামের ওই নারীকে রোববার রাতে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ভর্তি করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) মো. বাচ্চু মিয়া চিকিৎসকের বরাত দিয়ে বলেন, মাহমুদার শরীরের ৪৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। তার অবস্থা আশংকাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাকে হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে রাখা হয়েছে। পুলিশ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, হাইউম নামের এক ব্যক্তি তাকে দগ্ধ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। হাইউম জানিয়েছেন, মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকার বাসায় এ ঘটনা ঘটেছে। এদিকে খবর মাহমুদার স্বজনরা হাসপাতালে ছুটে আসেন। তার মা সালমা বেগম বলেন, গত বিশ দিন ধরে মেয়ের কোনো খোঁজ পাইনি। রাতে তার দগ্ধ হওয়ার সংবাদ পাই। মেয়েটির স্বজনরা আসার পর হাসপাতালের জরুরি বিভাগে হৈচৈ শুরু হয়। খবর পেয়ে শাহবাগ থানার এসআই গোলাম হোসেন সেখানে উপস্থিত হন। এসআই গোলাম হোসেন বলেন, এক রোগীকে ভর্তি নিয়ে হৈচৈ হচ্ছিল শুনে সেখানে গিয়েছি। কিন্তু ওই রোগী সম্পর্কে কিছু জানতে পারিনি।

https://dailysangram.com/post/454837