৮ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:৪৬

কোভিড’ থেকে যদি উত্তরণ ঘটে, তার পর...

দেখা অদেখা

[গতকালের পর]

বহুবার বহু তথ্য থেকেই জেনেছি, পৃথিবীতে অসংখ্য মানুষ এখন তাদের কাজ হারিয়ে চরম দুর্দিনের সম্মুখীন। কোটি কোটি মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়েছে। আজো তারা পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষের সার্বিক অবস্থা এতটাই শোচনীয় যা অচিন্তনীয়। দেশের শতকরা ষাট ভাগের বেশি মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। নব্বই ভাগ মানুষেরই আয় রোজগার এতটা হ্রাস পেয়েছে যে, তাদের জীবনযাত্রার মান অনেক নিচে নেমে এসেছে। অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে ফেলতে হয়েছে। এসব কিছু আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে আসা এক মহা কর্মযজ্ঞের ব্যাপার। আমাদের অবস্থান ফিরাতে পূর্বশর্ত হচ্ছে, বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটা। হাতেগোনা কয়েকটি দেশ আগে যাদের ‘ইকোনমিক জায়েন্ট’ বলা হতো, এখন তারাই ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে কিছু সাফল্য পেতে শুরু করেছে। তবে সেজন্য আমাদের হতাশ হয়ে হাতগুটিয়ে বসে থাকলে চলবে না। পানিতে পড়ে গেলে হাত-পা না নাড়ালে নির্ঘাত ডুবে মরতে হবে। এটা ভেবে হাত-পা নাড়াতে শুরু করা এখন জরুরি। অবশ্যই এজন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে তাদের পরামর্শ অন্ধের যষ্টি বলে মনে করতে হবে। এখনই এ ব্যাপারে উদ্যোগ আয়োজন করতে কালক্ষেপণ করা যাবে না। আমরা জানি, সরকারপ্রধানের সুদূরপ্রসারী চিন্তা আর ভিশন রয়েছে। তার পাশে আরো অনেককেই থাকতে হবে, মনে রাখা দরকার, ‘দশের লাঠি একের বোঝা’। সরকারপ্রধানের পক্ষে সবকিছু আঞ্জাম দেয়া সম্ভব নয়; সমন্বয় তদারকি তিনি করছেন। মন্ত্রীদের নিজ অবস্থান থেকে সুবিবেচনাকে কাজে লাগাতে হবে। এটা তারা করছেন কি না, জানি না। কোভিড নিয়ে যে ভয়ানক বিড়ম্বনা দেখা যাচ্ছে, তার দায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের ওপরই পড়বে। টিকা কূটনীতির খেলায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চৌকস খেলোয়াড়ের মতো সক্ষমতা দেখাতে পারেনি। অথচ আপৎকালে সবাই সর্বোচ্চ সক্ষমতা দেখাবেন বলেই মানুষ আশা করে। মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী হিসেবে মন্ত্রীবৃন্দের ধ্যানজ্ঞান যদি হয় কেবল দেশের ভালো করাটাই তবে তার কর্মকর্তারা পিছু পড়ে থাকতে পারবেন না।

বস্তুত কোভিড থেকে উঠে আসতে পারলে যে নবযাত্রার সূচনা করতে হবে, সেখানে প্রথমে সঙ্কট সম্ভাবনার বিষয়গুলো ঠিক করে ফেলতে হবে এখনই। দেশের সবচেয়ে বেশি আলোচিত সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি। এর সাথে যারা জড়িত বিশেষ করে যারা ‘নাটের গুরু’, সেই গভীর জলের রুই কাতলারা সরকারি সংস্থার ঘেরের মধ্য থেকেই দিব্যি বিচরণ করে বেড়াচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঢাকঢোল পেটানো হয় বটে এবং কিছু চুনোপুঁটিও ধরা হয়। কিন্তু গভীর পানির সেই রুই কাতলার কিছুই তাতে খসে না। সে এক রহস্য, যার কোনো প্রতিকার দেখা যায় না। অদৃশ্য থেকে তাদের রীতিমতো ‘আধার’ দেয়া হয়। এর অবসান না হলে যে নবযাত্রার কথা বলা হলো তা নিছক ফাঁকা বুলি হয়ে থাকবে। বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় যে, ভরা কোভিডের মধ্যেও এরা থেমে থাকেনি। নানা দোলাচলের মধ্যেও তারা হাতিয়ে নিয়েছে প্রচুর টাকাকড়ি। জাদুকরী মন্ত্রে সব অসম্ভবকে তারা সম্ভব করে ফেলে। কথায় বলে ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়’। আজকের অবস্থা যেন অনেকটা তেমনি। রোগ সারার পর রোগীকে যদি পথ্যটা ঠিকমতো জোগান দেয়া না হয় তবে তার শারীরিক দুর্বলতার কারণে নানা ব্যাধি দেহে বাসা বাঁধবে। আজ দেশের লক্ষ মানুষের অবস্থা মূক বধিরের মতো হয়ে আছে, সবাই যেন ঘোরের মধ্যে পড়ে আছে। কিন্তু সময় এলে দেখা যাবে, তাদের উচ্চ কলরবে সব কিছু বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলার বিষয় এখনই ভাবতে হবে। যাদের কথা উপরে বলে এসেছি, যারা জাদুর জালে অসম্ভবকে সম্ভব করে, তারা তখন বসে থাকবে না, যা কিছু পাবে সব চুষে নেয়ার চেষ্টা করবে। এসব সর্বভুককে তখনই থামানো যাবে যখন তাদের নেপথ্যে থাকা মদদদাতাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অসাড় করে দেয়া সম্ভব হবে।

আমাদের অবস্থাটা এমন যে, না আমরা শিল্পে সমৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছি, না কৃষিকে এতটা উচ্চতায় নিয়ে যেতে পেরেছি যে উৎপাদিত পণ্য রফতানি করে অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হবো। বর্তমান যে ভঙ্গুর অর্থনীতি তাতে কোনো সেক্টরই অবদান রেখে দেশকে পরিপুষ্ট করে তুলতে পারছে না। আসলে হেলা অবহেলায় কেবল দিন গুজরান করা হয়েছে। ক্ষমতার জন্য আমাদের নেতৃবৃন্দ লালায়িত। ক্ষমতাকে তারা উপভোগ করতে অভ্যস্ত; তবে ক্ষমতাকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে কখনো সক্ষম হননি। অথচ পৃথিবীর সর্বত্র যারা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত, তাদের লক্ষ্য আর ধ্যানজ্ঞান একটাই হয়ে থাকে যে, নিজেদের বোধ বিবেচনা আর চিন্তা গবেষণার আলোকে দেশকে এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা সাধনা করে থাকেন। তাদের রাজনীতির এই লক্ষ্য সফল করার জন্য নিজেদের যোগ্যতা সক্ষমতা বাড়িয়ে তুলতে অধ্যবসায় আর অনুশীলন অনুক্ষণ করে থাকেন।

পক্ষান্তরে আমাদের রাজনীতিকরা এমন পরিশ্রম আর মেধা খরচ করার কথা ভাবেন না। বিদেশীদের সাথে এই গুণগত পার্থক্যের কারণে দেশ সঠিক পথে তারা পরিচালনা করতে পারছেন না।

যে উন্নয়নের কথা বলা হলো, তার সাথে সমান্তরালভাবে যদি দেশে গণতন্ত্রের চর্চা করা না হয় তবে উন্নয়নের গতি স্থবির হবার পাশাপাশি সঠিক চলার পথ থেকে ছিটকে পড়বে। গণতন্ত্র অর্থ জনগণের শাসন। আমাদের সংবিধানে এটা স্পষ্ট করা আছে, ‘এ দেশের মালিক জনগণ’। সেই জনগণের অংশ গ্রহণকে নিশ্চিত না করে দেশ পরিচালনা করা হলে সংবিধানের নির্দেশনায় ব্যত্যয় হবে। গণতন্ত্র জারি থাকলে জনগণ তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে দেশ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারে। গণতন্ত্রের আর যেসব বৈশিষ্ট্য রয়েছে সেগুলো কার্যকর না থাকলে যে উন্নয়নের কথা বলা হয় তা সফল তো হবেই না বরং শত সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে হবে। গণতন্ত্রের অন্যতম বিষয়, সুশাসন প্রতিষ্ঠা। এ লেখায় এ পর্যন্ত প্রশাসনিক যেসব দুর্বলতার বিষয়ে ইঙ্গিত করা হয়েছে এগুলোসহ আরো বহু সমস্যা শাসনব্যবস্থায় বিদ্যমান। এর কারণ সুশাসনের অভাব; সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা তথা ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে থাকা। যোগ্য ও দক্ষতার অভাব ঘটলেই সমস্যার আবর্তে পড়ে দিগি¦দিকশূন্য হয়ে জ্ঞান হারানোর সম্ভাবনা ষোলআনা। সুশাসনে দীক্ষা হচ্ছে, যোগ্য ব্যক্তিকে যথাস্থানে পদায়ন করা বা এ ক্ষেত্রে অনুরাগ বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া; উত্তম ও যথার্থ কর্মের জন্য পুরস্কৃত করা আর ব্যর্থতার জন্য তিরস্কার। এই নীতি নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হবে। সুশাসন কার্যকর থাকলে প্রশাসনে জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা পায়। কেউই দুর্বলতার ঊর্ধ্বে নয়। তার ওপর, যদি কাজের মূল্যায়ন করে ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করা না হয় অর্থাৎ জিজ্ঞাসাবাদের সংস্কৃতি জারি রাখা না হয় তবে সুশাসনে ব্যাঘাত ঘটবে। যারা সংবাদপত্রের সচেতন পাঠক বা অন্যান্য মিডিয়ার মনোযোগী শ্রোতা-দর্শক তাদের সবাই এটা জ্ঞাত যে, দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিনিয়ত চিহ্নিত হচ্ছে নানা অনিয়ম আর কর্মকর্তাদের কাজের ক্ষেত্রে যত অদক্ষতা ও অবহেলা। এসব অব্যাহত রয়েছে দীর্ঘদিন থেকে। যে প্রশাসন সমাজের অব্যবস্থার অন্ধকার দূর করার কথা, সেই প্রদীপের নিচেই যদি অন্ধকার জমাট বাঁধে, তবে পরিত্রাণের পথ কোথায়?

আমাদের শিল্প বলতে যা এখন আমরা বুঝি সেটা হলো, পোশাক তৈরির কারখানাগুলো। এই শিল্প কতকাল দেশে স্থায়ী হতে পারবে সেটা এখন চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এ ক্ষেত্রে বহু দেশ আমাদের প্রতিযোগী। তাদের পোশাককর্মীদের দক্ষতা আমাদের চেয়ে বেশি। পোশাক আর রফতানির বাজার ধরার জন্য শিল্পের মালিকসহ সে সব দেশের সরকারি সংস্থা যুগপৎ প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। কিন্তু বাংলাদেশে কেবল শিল্প মালিকরাই ছোটাছুটি করেন; কিন্তু তাদের পাশে সরকারি সংস্থাকে পাওয়া যায় না। তাছাড়া কোভিডের কারণে তৈরী পোশাকের বাজার অনেক সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। তাতে বাংলাদেশের বহু পোশাক কারখানা বন্ধ করে দিতে হয়েছে। সেজন্য অসংখ্য পোশাকশ্রমিক তাদের কাজ হারিয়েছে। বিশ্বে কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি হলে বাংলাদেশ তা থেকে কতটুকু ফায়দা হাসিল করতে পারবে তথা পোশাকের বাজার পুনরুদ্ধার করতে পারবে, সেটা অনুমান করা এখন কঠিন। তা ছাড়া বাংলাদেশেও কোভিড পরিস্থিতির উন্নতি ঘটার ব্যাপার রয়েছে। দেশে সব মানুষকে টিকা দেয়ার ওপরই তা অনেকাংশে নির্ভর করছে। এখন পর্যন্ত টিকা সংগ্রহ নিয়ে যে চরম অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে, তাতে শ্রমঘন এই শিল্প আগামী দিনে কী অবস্থায় গিয়ে দাঁড়াবে এমন কিছু আমাদের জানা নেই। কোভিডের টিকা নিয়ে দুশ্চিন্তা কেবল পোশাক শিল্পেই নয়। গোটা দেশের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা তার সাথে জড়িত। পোশাক শিল্প নিয়ে আর সামান্য কিছু কথা এখানে যোগ করতে চাই। তৈরী পোশাক রফতানি করে যে বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের আসে, সেটা আরো বৃদ্ধি করার সুযোগ আছে, কিন্তু উদ্যোগ নেই। এখন দেশে যে পোশাক তৈরী হয়, তার মজুরি বাবদ আমরা সামান্য অর্থ পেয়ে থাকি। কেননা পোশাক তৈরীর কাপড়, সেলাইয়ের সুতা এমনকি বোতামটা পর্যন্ত বাইরে থেকে আনতে হয়। তার পরও যেটুকু অর্থ পাওয়া যাচ্ছিল সেটা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রেখে আসছে। এ খাত থেকে প্রাপ্ত বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে অনেক সহায়তা দিচ্ছে। তাছাড়া, পোশাক শিল্পের সাথে বিপুলসংখ্যক কর্মী জড়িত। তারা এখান থেকে যে অর্থ রোজগার করত তা দিয়েই পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন নির্বাহ করে আসছিল। এ কথা আগে বলে এসেছি যে, পোশাক কারখানাগুলো শ্রমঘন শিল্প। আর তার কর্মীদের অধিকাংশই নারী। কাজ করে নারীরা যে রোজগার করছে তাতে তাদের সংসারই শুধু চলছে না; নারীকর্মীদের আত্মপ্রত্যয় এবং মর্যাদাও তাতে বেড়েছে। অথচ আগে তারা তাদের পরিবার পরিজনের কাছে একটি বোঝা হিসাবেই মূল্যায়িত হতো। অনেক নারীকর্মী পোশাক শিল্পে জড়িত হবার আগে গৃহকর্মীর কাজ করতেন। সেখানে যৎসামান্যই আয় হতো কিন্তু তা ছিল তাদের জন্য গ্লানিকর। অবশ্য কোভিডের বালা মুসিবতের জন্য তাদের অনেকেই বেকার হয়ে গেছেন। এসব কর্মীকে কাজে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য প্রশাসনকে এখনই কাজ শুরু করতে হবে। পুনরায় কাজে ফিরিয়ে নিতে পারলে তাদের বর্তমান কষ্ট শুধু কমবে না, সেই সাথে পোশাক খাত বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের যে সঙ্কটের মধ্যে দেশ রয়েছে সেটাও ঘুচতে পারে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের আরেকটি বড় উৎস হচ্ছে, রেমিট্যান্স বাবদ প্রাপ্ত অর্থ। দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ বিদেশে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে কাজ করছেন। তারা সেখানে যে আয় করেন তার ষোলআনাই দেশে আনতেন। বাইরে কোথাও তা পাচার হতো না। এটা শুধু ব্যক্তিজীবনের সততাই নয়, তাতে জাতির প্রভূত কল্যাণ হয়েছে। কোভিডের কারণে বাইরে কাজ করার সুযোগ কমে গেছে। বহু মানুষ কাজ হারিয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। তাদের এই বেকারত্ব পারিবারিক জীবনে যেমন দুর্ভোগ নিয়ে এসেছে তেমনি রেমিট্যান্সের পরিমাণ বিপুলভাবে হ্রাস পেয়েছে। আরেকটা কথা বলা প্রয়োজন, সেটা হলো মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের কর্মী ছাড়াও ভারত, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়ারও বহু কর্মী কাজ করেন। কিন্তু তাদের বেতনভাতা বাংলাদেশী কর্মীদের চেয়ে অনেক বেশি। তার কারণ সেসব কর্মীর বেতনভাতা নিয়ে দরকষাকষির কাজটি অনেক শক্তিশালী; কেননা সেসব দেশের সরকারি সংস্থাগুলোই প্রধানত মজুরির বিষয় নিয়ে দর কষাকষি করে থাকে। অপর দিকে, আমাদের অবস্থান অত্যন্ত দুর্বল কেননা দেশ থেকে জনশক্তি পাঠানোর বিষয়টি পুরোপুরি বেসরকারি বা ব্যক্তি পর্যায়ে হয়ে থাকে। তাদের দরকষাকষির ক্ষমতা খুব কম। আর নানা খাতে কারসাজিও রয়েছে।

এ ক্ষেত্রে ভারতের অবস্থান অত্যন্ত মজবুত। তারা সরকারিভাবে কর্মীদের বেতনভাতা নির্ধারণের কাজটি শক্ত হাতে করে থাকে। সেজন্য ভারতীয় কর্মীদের বেতনভাতা অন্যান্য দেশের কর্মীদের চেয়ে অনেক বেশি। তাছাড়া আরো একটি কারণে ভারতের রেমিট্যান্স বেশি আসে। ভারত থেকে যেসব মানুষ বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যায়, তারা সবাই দক্ষ। তাদের মধ্যে সাধারণ শ্রমিক শ্রেণীর সংখ্যা খুব কম; বরং দক্ষ শিক্ষিত ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানুষই মধ্যপ্রাচ্যে বেশি কাজ করেন; পক্ষান্তরে বাংলাদেশ থেকে যে জনশক্তি মধ্যপ্রাচ্যে যান, তারা অদক্ষ ও সাধারণ কর্মী। তাদের শিক্ষাদীক্ষা তেমন নেই আর প্রশিক্ষণের কোনো বালাই নেই। সাধারণ কর্মী হিসেবে তারা ন্যূনতম বেতনভাতাই পেয়ে থাকেন। অথচ দীর্ঘকাল থেকে বাংলাদেশের মানুষ বাইরে যাচ্ছেন; কিন্তু এসব বিষয় কখনো সক্রিয় বিবেচনায় নেয়া হয়নি। আসলে আমরা সব বিষয়েই অর্বাচীন এবং আমাদের কাজকর্ম নিছক দায়সারা। যদিও এ বিষয়গুলোর সাথে জাতীয় স্বার্থ ওতপ্রোতভাবে জড়িত। দেশে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে যে অদক্ষতা আর দূরদৃষ্টির অভাবের কথা বলি, এসব তারই প্রমাণ। উপরে ভারতবিষয়ক যেসব কথা বলেছি, তা আমাদের সংশ্লিষ্ট সরকারি বিভাগের যে অজানা, তা নয়। তবে কোনো পরিবর্তনের উদ্যোগ আর প্রচেষ্টা নেই।

কোভিডের কাল অতিক্রম করা গেলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমনস্কতা বৃদ্ধি সরকারের অগ্রাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট কারণ রয়েছে। বলা হয়ে থাকে, এখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। ভারত তথ্যপ্রযুক্তি খাতে মনোযোগ ও বিনিয়োগ দুটিই বহুগুণে বাড়িয়েছে। শুধু সরকারি সাহায্য সহযোগিতাই নয়, সেখানে তথ্যপ্রযুক্তির খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ আর উদ্যোগও সরকারের সাথে সমান্তরালভাবে চলছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত রফতানি করে ভারত বিপুল অর্থ উপার্জন করছে। এই খাতে বহু মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। ভারতের এই সেক্টর থেকে বহু দক্ষ জনশক্তি তৈরি হয় এবং বিদেশে তাদের কর্মসংস্থান হচ্ছে। এসব তথ্য নতুন না হলেও বাংলাদেশ বিভিন্ন বিষয়ে যে অমনোযোগিতার পরিচয় দিয়ে আসছে, এই প্রযুক্তির ব্যাপারে তার কোনো ব্যতিক্রম নেই। কোভিড থেকে উত্তরণ ঘটলে এ খাতে সরকারের এবং তার পাশাপাশি, বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মনোযোগ দেয়া জরুরি। স্মরণ রাখতে হবে পোশাক শিল্পের আয় যেভাবে সঙ্কুচিত হয়েছে, তা কতটা পুনরুদ্ধার হতে পারে তা অনিশ্চিত। তাই বিকল্প আয়ের কথা ভাবতে হবে। সে ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির খাত থেকে আয় করার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে।

বাংলাদেশে বৃহৎ ও ভারী শিল্প গড়ার জন্য বিনিয়োগ ও অবকাঠামোগত সমস্যা প্রকট। তাই হয়তো এই পথে না চলাই ভালো। তবে আমাদের চেয়ে বিশেষজ্ঞরাই এ নিয়ে সঠিক অভিমত দিতে পারবেন। ‘ভারী শিল্প’ মানেই রফতানির বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিতে হবে। কেননা এ দেশের বাজার এত ক্ষুদ্র যে, উৎপাদিত যন্ত্রপাতি রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের মানসম্মত বাজার অনুসন্ধান করা আমাদের মতো দেশের অবস্থান থেকে প্রায় অসম্ভব। বিশ্বের বৃহৎ তথা অর্থনৈতিক দিক থেকে শক্তিশালী, দক্ষ জনশক্তির অধিকারী এবং বাজার দখলের মতো অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দেশের সাথে আমাদের প্রতিযোগিতা করার কথা ভাবাই যায় না। দেশে বিদ্যমান মাঝারি ও ক্ষুদ্র যে শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেখানে সরকারি সহযোগিতা বাড়িয়ে বেকার মানুষের জন্য কর্মসংস্থান কোভিড-পরবর্তী কর্মংস্থানের সাথে সাথে সংযুক্ত করা যেতে পারে। দেশের বাজারে এমন বহু কিছু রয়েছে যা মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে তৈরি হয়েছে। কিন্তু দেশের বাজারে এসব পণ্যের বেশির ভাগই বাইরে থেকে এসেছে। তাই দেশ থেকে বিদেশি পণ্য হটানো যদি সম্ভব হয় আর পণ্যের মান ঠিক থাকে, তবে উৎপাদিত সেসব পণ্য মূল্যের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতায় ভালো অবস্থানে থাকতে পারবেন উৎপাদকরা।

ইতঃপূর্বে আমরা ভিন্ন লেখায় বলেছিলাম, উপজেলা পর্যায়ে অবকাঠামো তৈরি করা সম্ভব হলে সেখানেও মাঝারি, ক্ষুদ্র এবং কুটির শিল্প গড়ে উঠতে পারে এবং তাতে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে। এসব উদ্যোগের জন্য যে পুঁজির দরকার হবে, সরকারি সহায়তা আর যদি ব্যাংকগুলো ঋণসুবিধা সহজ করে তবে পুঁজির সমস্যা কাটবে। নবীনরা যাতে এসব উদ্যোগের সাথে জড়িত হতে পারে সে জন্য প্রশিক্ষণ ও কারিগরি সহায়তা দিতে সরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের ভিশন দেশকে মাঝারি আয়ের দেশে পরিণত করা। এভাবে এগিয়ে যেতে সক্ষম হলে সে ভিশন বাস্তবায়ন করা অসম্ভব হবে না।

লেখা শেষ করতে চাই বালাবিষয়ক প্রসঙ্গ টেনেই। বিশ্বের পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, পরিবেশের বিপর্যয় ঘটলে নানা রোগব্যাধি সৃষ্টি হয়ে মহামারীর মতো অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। আর রোগ শোক হওয়া তো সাধারণ ও স্বাভাবিক ব্যাপার। এ জন্য বিশ্বে পরিবেশ নিয়ে সতর্কতা বহু গুণে বেড়েছে। অথচ বাংলাদেশের পরিবেশ সমস্যা ভয়াবহ। দেশের রাজধানী মহানগরী ঢাকার বায়ুদূষণের এতটা অবনতি ঘটেছে যে এই নগরীকে মারাত্মক গ্যাস চেম্বারের সাথেই তুলনা করা যেতে পারে। ঢাকায় বসবাসকারী অসংখ্য মানুষ শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করছেন। বহু বিজ্ঞানী মনে করেন, পশু তার শরীরে মারাত্মক সব জীবাণু বহন করে। এদিকে, বিভিন্ন দেশে বন উজাড় হতে চলেছে, সেখানে পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছেই। সেই বনের পশু তার শরীরের মারাত্মক জীবাণু নিয়ে লোকালয়ে এসে ঢুকছে যা কিনা বড় বিপদ সৃষ্টির কারণ হয়ে উঠবে। আমাদের দেশের বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রয়োজনের চেয়ে অনেক নিচে। তার পরও এখানে গাছপালা দেদার কাটা হচ্ছে। সুন্দরবনের পাশে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে যা নিয়ে দেশে বহু প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলন হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মত, সে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হলে সুন্দরবনের মারাত্মক ক্ষতি হবে। অথচ সুন্দরবন প্রাকৃতিক দুর্যোগ তথা ঝড় সাইক্লোন থেকে উপকূলবাসীকে রক্ষা করছে। এই বনের ক্ষতি হলে পরিবেশ মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হবে। আমাদের জানা থাকা দরকার, দেশের সংবিধানে (অনুচ্ছেদ-১৮ক) রয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ আমরা কি আজ সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের চেতনার প্রতি সম্মান শ্রদ্ধা পোষণ করছি? শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও সুন্দরবন পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে।

ndigantababor@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/586901