৭ জুন ২০২১, সোমবার, ১:০৩

খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ

১৭২১ কোটি টাকার প্রকল্প এখন ৪৩২৯ কোটিতে

৩ বছর মেয়াদি প্রকল্পের কাজ চলছে ১০ বছর ধরে - সংশোধন হয়েছে দফায় দফায় ব্যয় বেড়েছে ১৫২ ভাগ

খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প চলছে তো চলছেই। তিন বছরে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ১০ বছর ধরে চলছেই। ১৭২১ কোটি টাকা প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৪৩২৯ কোটিতে। রেলে এ রোগ বেশ পুরোনো। নির্ধারিত সময়ে প্রকল্প সমাপ্তির বাণী নেই বললেই চলে। দুদফায় প্রকল্পটি সংশোধন করতে হচ্ছে। এতে ২৬০৮ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে। চলমান ৩৭ উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা চলছে। বেঁধে দেওয়া সময় ও নির্দিষ্ট টাকায় প্রকল্প শেষ হবে-এমন আশ্বাসে ভরসা রাখতে পারছে না খোদ রেলপথ মন্ত্রণালয়ই।

খুলনা-মোংলা রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি নেওয়া হয় ২০১০ সালের ডিসেম্বরে। ১৭২১ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার তারিখ ছিল ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে। কিন্তু এখন কাজ চলছে। বর্তমানে এর অগ্রগতি ৮২ শতাংশ। বাকি কাজ শেষ করতে সময় বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়ানো হচ্ছে ব্যয়ও। আরও দেড় বছর মেয়াদ বৃদ্ধির সঙ্গে ২৬০৮ কোটি টাকা ব্যয়ও বাড়ছে।

অর্থাৎ ৩ বছরের প্রকল্প প্রায় ১ যুগ পর শেষ হতে পারে। সঙ্গে ব্যয় বাড়ছে ১৫২ শতাংশ। সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে আজ (সোমবার) প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় এ সংক্রান্ত প্রস্তাবটি পর্যালোচনার জন্য উপস্থাপন হবে। এ বিষয়ে রোববার বিকালে রেলপথ সচিব সেলিম রেজা যুগান্তরকে বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প।

সময়ের সঙ্গে ব্যয় বাড়ছে স্বীকার করে তিনি বলেন, এটি ভারতীয় নমনীয় ঋণ সহায়তাভুক্ত (এওসি)। চুক্তি অনুযায়ী এর অধিকাংশ সরঞ্জাম ভারত থেকে আনতে হচ্ছে। করোনায় অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। এছাড়া এতে ভারতীয় অনেক লোক কাজ করছিল। ফলে পুরো প্রকল্পে এর প্রভাব পড়েছে। এর আগেও এক দফা সংশোধন হয়েছে।

এবার দ্বিতীয়বারের মতো সংশোধন হতে যাচ্ছে। সোমবার পিইসি সভায় এ নিয়ে পর্যালোচনা হবে। সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, এ প্রকল্পে রূপসা নদীতে মেজর ব্রিজ নির্মাণসহ আনুষঙ্গিক কাজের জন্য ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি পাচ্ছে। লাইনের কাজ প্রায় শেষ। প্রায় ৮২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। তবে আমরা চাই বর্ধিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প সমাপ্ত হোক। সময় ও ব্যয় বৃদ্ধিতে উন্নয়ন কাজ ব্যাহত হয়।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, শুরু থেকেই প্রকল্পটি নানা ধরনের বাধার মুখে পড়ে। তিন বছর মেয়াদের কাজটির জন্য ঠিকাদার নিয়োগ দিতে লাগে দুই বছর। এর আগেই প্রথম দফায় সংশোধন করা হয়। নির্মাণ শুরুর পর মূল রেলপথ ছাড়াও রূপসা নদী রেল সেতুর নকশায় ত্রুটি ধরা পড়ে। এতে সময় ও ব্যয় বাড়াতে উঠেপড়ে লাগে সংশ্লিষ্টরা।

২০১৫ সালের মে মাসে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধিত ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) অনুমোদন করা হয়। তাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৮০১ কোটি ৬১ লাখ টাকা। আর সর্বশেষ হিসাবে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৪ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই দফা মিলিয়ে নির্মাণ ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে দুই হাজার ৬০৮ কোটি টাকা বা ১৫২ শতাংশ।

ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি গ্রহণের যৌক্তিকতা সম্পর্কে বলা হয়েছে, তিনটি প্যাকেজের আওতায় খুলনা-মোংলা বন্দর রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। প্রথম প্যাকেজের (ডব্লিউডি-১) আওতায় রয়েছে ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ ও দ্বিতীয় প্যাকেজের (ডব্লিউডি-২) আওতায় পাঁচ দশমিক ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রূপসা নদী রেল সেতু নির্মাণ ও তৃতীয় প্যাকেজের (ডব্লিউডি-৩) আওতায় ৬৪ দশমিক ৭৫ কিলোমিটার রেলপথে সিগন্যালিং ও টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থা স্থাপন।

দ্বিতীয়টি প্যাকেজের আওতায় রূপসা নদী রেল সেতু নির্মাণে নকশা জটিলতা দেখা দেওয়ায় আগের ডিজাইনে পাইল নির্ধারিত লোড বহনে সক্ষম নয়। ফলে পরামর্শককে দিয়ে পাইলের গভীরতা বাড়ানো হয়। এতে প্যাকেজটির ব্যয় বৃদ্ধি পায়। আর প্রথম প্যাকেজটির আওতায় ৩১টি ছোট ও মাঝারি সেতু এবং ১০৭টি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো নির্মাণ করতে গিয়ে মাটির গুণাগুণ খারাপ থাকায় পাইলের দৈর্ঘ্য বাড়াতে হয়েছে। এতে প্রথম প্যাকেজের ব্যয়ও বৃদ্ধি পেয়েছে।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রেলওয়ে প্রকৌশলী বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, প্রকল্প গ্রহণের সময়ই একটি বিশেষ চক্র এতে নানা ধরনের ফাঁকফোকর রাখে। নির্মাণকাজ শুরুর পর থেকেই চক্রটি নানা কৌশলে প্রকল্প বাস্তবায়নে সময় ও ব্যয় বাড়াতে উঠেপড়ে লাগে। রেল মন্ত্রণালয়ের অসাধু লোকজনের সমন্বয়ে বিশেষ চক্রটি গড়ে উঠেছে। কিছু প্রকল্পে শুরুতেই অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হয়। এমন একাধিক প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় ব্যয় কমানো হয়েছে। কিন্তু চক্রটি নানা কৌশলে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধিতে কাজ করছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরকালে ২০১০ সালের ১২ জানুয়ারি একটি যৌথ বিবৃতি ইস্যু করা হয়। এছাড়া সার্ক মাল্টি মোডাল ট্রান্সপোর্ট স্টাডি থেকে মোংলা পোর্টের মাধ্যমে নেপাল, ভুটান মালামাল আমদানি বা রপ্তানি বাণিজ্য করতে পারে বলে প্রস্তাব করা হয়।

তারই ফলে ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর খুলনা-মোংলা বন্দর রেলপথ নির্মাণসহ সম্ভাব্যতা যাচাই নামে একটি প্রকল্প ১৭২১ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমোদন দেওয়া হয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায়। এ প্রকল্পে অনুমোদিত ব্যয়ের মধ্যে ভারতীয় ঋণ ১২০২ কোটি ৩১ লাখ ১৪ হাজার টাকা ও বাংলাদেশ সরকারের ৫১৯ কোটি টাকা। সময়ের সঙ্গে ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ায় উভয় পর্যায়ে অর্থের জোগানও বাড়ানো হয়েছে।

আইএমইডির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী দ্বিতীয় সংশোধনীর পর ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৪৩২৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১ হাজার ৩২৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকা এবং ভারতীয় ঋণ থেকে ৩ হাজার ৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা জোগান দিয়ে কাজটি শেষ করা হবে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/428567/