৭ জুন ২০২১, সোমবার, ১:০৩

বিশিষ্ট নাগরিকদের অভিমত

এনআইডি হস্তান্তরে সৃষ্টি হবে সাংবিধানিক সঙ্কট

জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) নিবন্ধনকার্যক্রম নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পত্র কার্যকর করলে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হবে। এটা নিয়ে দেশ-বিদেশে সরকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং অপর দিকে ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও ব্যবহারে জটিলতা সৃষ্টি হবে। এই উদ্যোগ ইসির স্বাধীনতার ওপর নগ্ন হামলা বলে মন্তব্য করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের বিশিষ্ট নাগরিক ও বিজ্ঞজনেরা। তারা সরকারকে এ বিষয়ে আরো বিশদভাবে ভাবতে পরামর্শ দেন। বিশিষ্টজনরা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশ। তাদের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজ চলে গেলে তা আমাদের জন্য অনেক ভীতিকর। এটি পরবর্তী নির্বাচন ঘিরে নতুন তরিকার পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে।

নাগরিক সংগঠন সুজনের পক্ষ থেকে গতকাল ‘জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধনকার্যক্রম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করার উদ্যোগ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল নাগরিক সংলাপে বিশিষ্ট নাগরিকরা এই অভিমত ব্যক্ত করেন। সুজন কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য বিচারপতি এম এ মতিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন, সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শাহদীন মালিক, সাবেক মন্ত্রী শেখ শহীদুল ইসলাম, বিশিষ্ট সাংবাদিক সোহরাব হাসান ও আবু সাঈদ খান, সুজনের কোষাধ্যক্ষ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল, রাজনীতিবিদ রাজেকুজ্জামান রতন ও রুহিন হোসেন প্রিন্স, সুজনের জাতীয় কমিটির সদস্য একরাম হোসেন প্রমুখ। সুজন স¤পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় ড. এম সাখাওয়াত হোসেনের লিখিত প্রবন্ধ পাঠ করে শোনান সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন তার প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, নির্বাচন কমিশন এককভাবে ডিএফআইডির (ইউকে ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম) উদ্যোগে এবং ইউএনডিপির সমন্বয়ে দি প্রিপারেশন অব দি ইলেকটোরাল রোলস প্রজেক্টের আওতায় ভোটার তালিকা তৈরির তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা ২০০৭ সালে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনুমোদনে হাতে নিয়ে ছিল। প্রথমে একে ভোটার আইডি বলা হলেও পরে এর সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র যুক্ত করা হয়। ছবিসহ ভোটার তালিকার সাথে যুক্ত থাকায় শুধু প্রিন্ট এবং প্লাস্টিক কভারের যৎসামান্য খরচে যুগপৎভাবে ভোটার তালিকা এবং আইডিকার্ড প্রস্তুত করার পাইলট প্রকল্প শুরু করা হয় গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলায়। এই প্রকল্পটি যখন নেয়া হয় তখন কোনো সরকারি মন্ত্রণালয় আলাদাভাবে আইডিকার্ডের প্রকল্পে কোনো ধরনের আগ্রহ প্রকাশ করেনি। দ্বিতীয়ত, প্রকল্পটি প্রায় শতভাগ দাতাদেশগুলোর সহযোগিতায় স¤পন্ন করা হয় এবং ইউএনডিপির হস্তান্তরের পর নির্বাচন কমিশন গত ১৩ বছর যথেষ্ট দক্ষতার সাথে এত বড় আয়োজন স¤পন্ন করে আসছে। তৃতীয়ত, ২০১০ সালের আইনের পরিপ্রেক্ষিতে উপজেলা, জেলা এবং আঞ্চলিক পর্যায়ে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার সাথে জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকার সাথে যুক্ত জাতীয় পরিচয়পত্র কার্যক্রম মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পত্রানুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হাতে অর্পণ করা হলে নির্বাচন কমিশনের একটি বৃহৎ অংশ সরকারের উল্লিখিত মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত হবে। যা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হবে এবং নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনসত্তা খর্ব হবে। যা মোটেই গ্রহণযোগ্য হবে না। তিনি বলেন, এটা নিয়ে দেশ-বিদেশে সরকারের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এবং অপরদিকে ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও ব্যবহারে জটিলতা সৃষ্টি হবে। সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার দায়িত্ব কমিশনের। বিদ্যমান আইনে এর ভাগীদার অন্য কোনো সংস্থাকে করা যাবে না।

ড. সাখাওয়াত বলেন, আইনানুযায়ী নির্বাচনকালে কমিশন আসনভিত্তিক প্রতিযোগী প্রার্থীদের ওই আসনের ভোটার তালিকা প্রদান করে মাত্র। স¤পূর্ণ ভোটার তালিকা দলকেও দেয়া হয় না। কাজেই অন্য কোনো সংস্থাকে ভোটার তালিকা সরবরাহ সংবিধানসম্মত হবে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের পত্র কার্যকর করলে সাংবিধানিক সঙ্কট তৈরি হবে। কাজেই সরকারকে এ বিষয়ে আরো বিশদভাবে ভাবতে এবং অবশ্যই নির্বাচন কমিশনের সাথে আলোচনা করতে হবে। আমার মতে কমিশন থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র নিতে চাইলে একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গঠন করে স¤পূর্ণ আলাদা ভাবে অবকাঠামো তৈরি করে এটা করা উচিত।

বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এটা অনেকগুলো শঙ্কার উদ্রেক করে। সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন একটি প্রতিষ্ঠানকে দেশের সরকারপ্রধান এ রকম নির্দেশনা দিতে পারেন কিনা। এটি কমিশনের স্বাধীনতার ওপর নগ্নহামলা। আমাদের দেশে ভোটার ডাটাবেজ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি হয়েছে, অন্য দেশে বিষয়টা উল্টো। তাই এখানে এনআইডির সাথে ভোটার তালিকার বিষয়টি স¤পৃক্ত। তিনি বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ভোটার ডাটাবেজ যদি সরকারের নিয়ন্ত্রণে যায় সরকার বিভিন্ন রকম কারসাজির মাধ্যমে কাউকে ভোটার করতে পারে এবং কাউকে বাদ দিতে পারে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের একটা সুযোগ থেকে যায়। দুর্নীতিরও সুযোগ তৈরি হয়। ছবিসহ ভোটার তালিকা আমাদের গর্বের ধন। এটিতে কোনোভাবেই হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবে না। আর সরকার করতে চাইলে জন্ম নিবন্ধন থেকে শুরু করতে পারে।

ড. শাহদীন মালিক বলেন, বেশ কয়েকদিন বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে ¯পষ্ট করে জানানো হয়নি কী উদ্দেশ্যে এটা করা হচ্ছে। কমিশনের হাতে থাকলে কী অসুবিধা, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে গেলে কী সুবিধা? তাও জানানো হয়নি। এটি পরবর্তী নির্বাচনের নতুন তরিকার পদক্ষেপ বলে মনে হচ্ছে।

ড. আসিফ নজরুল বলেন, কমিশনের বুঝা উচিত তারা নিজেদের কোথায় নামিয়েছে। যেই সরকারের জন্য তারা একের পর এক অন্যায় করেছে তাদের কাছেই তারা কতটা মর্যাদাহীন সেটা যেন তারা একটু অনুধাবন করে। কমিশনের ওপর আমাদের আস্থা নেই, এটা ঠিক। কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়ে গেলে আরো বিপজ্জনক হবে। কারণ কমিশন তো নিজে সরাসরি জনগণকে নিপীড়ন করে নাই। গত নির্বাচনে এজেন্টদের, ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেয় নাই। এই কাজগুলো করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশ। তাদের হাতে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির কাজ চলে গেলে তা আমাদের জন্য অনেক ভীতিকর। প্রধান নির্বাচন কমিশনের প্রতি বলতে চাই, আপনাদের যে কিছু মেরুদণ্ড আছে এই ইস্যুতে দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন কমিশন নামে একটি নতুন স্বাধীন প্রতিষ্ঠান তৈরি করে এই দায়িত্ব দেয়া প্রয়োজন।
আবু সাঈদ খান বলেন, একটি দেশের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হয় কোন প্রতিষ্ঠান দিয়ে কী দায়িত্ব পালন করা হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কোনো কাজে সফলতা দেখায় সেটাও ধরে রাখা উচিত। জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির মতো একটি সফল প্রকল্প, যেটি দেশ-বিদেশে সমাদৃত। সেটাও আমাদের ধরে রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। সোহরাব হাসান বলেন, নির্বাচন কমিশনটা কোথায় এখন সেই প্রশ্ন থেকে যায়। তিন বছর ধরে আমরা দেখছি সরকার কমিশনকে অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বেশি কিছু মনে করে না। কমিশনকে আগে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে হতে হবে তারপর না হয় তার অধিকার।

রাজেকুজ্জামান রতন বলেন, পুলিশ ক্ষমতাসীন দলের সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার। তা কিভাবে ব্যবহৃত হয় তা তো দেখছি, এখন আরো ব্যাপক হবে। নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্ব বা প্রয়োজনীয়তা সরকার কি মনে করে না? পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে পুলিশি হয়রানি ও আার্থিক বাণিজ্য বাড়বে। ১৮ বছরের নিচে যারা তাদের নাগরিক কার্ড দেয়ার জন্য বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়া দরকার। নতুন প্রকল্পের নামে খরচের নতুন খাত সৃষ্টি করা হবে।

বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর কেউ আস্থা রাখতে পারছেন না। এখন যে ক্ষমতাটা সেটা সাংবিধানিক ক্ষমতা। আর আইন করে কোনো প্রতিষ্ঠানকে দিলে সেটা সাবঅর্ডিনেট হয়ে যাবে। বড় ক্ষমতা থাকতে ছোট ক্ষমতায় যাবো কেন সেটাও একটা বিষয়।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/586651/