৪ এপ্রিল ২০১৭, মঙ্গলবার, ১০:০১

স্বৈরতন্ত্র বাংলাদেশে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে

বাংলাদেশের শাসক দল আওয়ামী লীগের অবস্থা এখন দাঁড়িয়েছে যা ইচ্ছে তাই করার মতো। কারণ এদের এই যাচ্ছেতাই কাজকর্মের বিরুদ্ধে কোনো সক্রিয় প্রতিক্রিয়া ও প্রতিরোধ নেই। সুবিধাবাদের সে াতে গা ছেড়ে দেয়া শিক্ষিত মধ্যবিত্তেরা নিজেদের আখের গোছানোর চিন্তায় নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করে চোখের সামনে ঘটতে থাকা অন্যায়, অবিচার, হামলা ইত্যাদির প্রতি চোখ বুজেই থাকে। সাধারণ মানুষের মধ্যে এসবের বিরুদ্ধে কোনো উপযুক্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিরোধ নেই, কারণ তারা অসংগঠিত। অবশ্য অসংগঠিত থাকলে যে কোনো সময়েই কোনো প্রতিরোধ জনগণের দ্বারা হয় না, এমন নয়। কিন্তু সেটা ঘটতে পারে কোনো বিশেষ ও ব্যতিক্রমী পরিস্থিতিতে, যার হিসাব আগে থেকে করা যায় না।


ক্ষমতায় থেকে যাচ্ছেতাই করার মতো শাসনব্যবস্থাকেই রাজনৈতিকভাবে বলা হয় স্বৈরতন্ত্র। বাংলাদেশে এখন স্বৈরতন্ত্রই চলছে। এর সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত হল, রাজশাহী ও সিলেটের দুই মেয়রকে এবং সেই সঙ্গে হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়রকে বরখাস্ত করা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার সিটি কর্পোরেশন আইন করেছিল। তার ১২-এর উপধারা (১) অনুযায়ী সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হলে সাময়িক বরখাস্ত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু সিলেট ও রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের দুই মেয়র দীর্ঘদিন কারাগারে থাকার পর উচ্চ আদালতের রায়ে ২ এপ্রিল আবার কাজে যোগদান করার পরমুহূর্তেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্বাহী আদেশে তাদের আবার বরখাস্ত করা হয়েছে (প্রথম আলো, ০৩.০৪.১৭)।

আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে দেখা যাচ্ছে যে, বিভিন্ন নির্বাচনে তারা অদৃষ্টপূর্ব কারচুপি করে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জয়লাভ করছে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। বিরোধী পক্ষ কোনো আসনে জয়লাভ করলেও তারা বিজয়ী প্রার্থীদের চেয়ারে বসতে দিচ্ছে না। রাজশাহী, সিলেট, গাজীপুর, হবিগঞ্জসহ প্রায় সর্বত্রই এটা দেখা যাচ্ছে। এসব ক্ষেত্রে নির্বাহী আদেশের যথেচ্ছ ব্যবহার করে সমগ্র প্রশাসন ক্ষেত্রে এখন এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকার একদিকে জাতীয় সংসদকে রাবার স্ট্যাম্প সংস্থা হিসেবে ব্যবহার করছে এবং অন্যদিকে আইন কানুনের তোয়াক্কা না করে নিজেদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করছে!

সরকারের এই শাসননীতি ও আচরণের সব থেকে বিপজ্জনক দিক হচ্ছে এই যে, এর দ্বারা যে উচ্ছৃঙ্খলতা হয় সেটা দেশজুড়ে, সমাজের সর্বস্তরে উচ্ছৃঙ্খলতার বিস্তার ঘটায়। সরকার যেখানে নিজে কোনো প্রতিবন্ধকতা গ্রাহ্য না করে এবং তার বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপের পরোয়া না করে অপরাধের শাস্তির বিষয়টিকে শিকেয় তুলে যা ইচ্ছে তাই করছে, সেখানে অন্যসব কার্যক্ষেত্রে মানুষ যে আইনের শাসন মেনে চলবে এবং সামাজিক ও আইনের শৃৃংখলার বশবর্তী হয়ে চলবে এ চিন্তা অবাস্তব। বাংলাদেশেও এ ধরনের কোনো অবাস্তব অবস্থা নেই। যেখানে সরকারের দায়িত্ব-কর্তব্য হচ্ছে দেশে আইনশৃংখলা রক্ষা করা, জনগণকে আইনশৃংখলা মেনে চলতে উৎসাহিত ও বাধ্য করা, সেখানে সরকারের নিজের এই আচরণ এখন এমন এক সংকটের জন্ম দিয়েছে যা থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। উপরন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, অপ্রতিহতভাবে এর অবনতিই ঘটতে থাকবে।

১৯৭২ সাল থেকে দেশের জনগণের সম্পদ একের পর এক শাসক দলের লোকদের দ্বারা বেপরোয়াভাবে লুটপাট হতে থাকা এবং এই লুটপাটের প্রয়োজনে খুন-খারাবি চালিয়ে যাওয়ার পরিস্থিতিতে এখন বাংলাদেশে নৈতিকতার এমন অবক্ষয় হয়েছে যে চুরি, দুর্নীতি, লুটপাট, ভূমিদস্যুতা, খুন-খারাবি যারা করে তাদেরকে ঘৃণা এবং কোনো প্রকার সম্মানের অনুপযুক্ত আর মনে করা হয় না। উপরন্তু এই চোর, দুর্নীতিবাজ ও হত্যাকারীরা সমাজে এখন উচ্চ আসনে বসে থাকে সম্মানিত ও গণ্যমান্য লোক হিসেবে। লোকে তাদের সমীহ করে চলে। এই অসৎ, দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীরা অহরহ সততা, দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদি কথার খই ফোটাতে থাকলেও তার বিশেষ কোনো প্রতিবাদ শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের পক্ষ থেকে তো নয়ই, কোনো পক্ষ থেকেই হয় না। সংবাদ মাধ্যমেও তাদের কথাই গুরুত্বসহকারে প্রচার করা হয়। যেখানে সরকারই এ ধরনের লোকদের পৃষ্ঠপোষক, যেখানে সরকারি লোকরা নিজেরাই নানা অপরাধের নায়ক, সেখানে এর অন্যথা হবে এমন প্রত্যাশা সম্পূর্ণ অবাস্তব।

এক হিসেবে বলা চলে, ১৯৭২ সাল থেকে শাসক শ্রেণীর লোকেরা নানা ধরনের অপরাধমূলক কাজ করে এবং এর সঙ্গে জড়িত থেকে যে ‘ঐতিহ্য’ সৃষ্টি করেছে তার ফলে বাংলাদেশ এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে এক নৈরাজ্যের দেশ। দেশের শাসক শ্রেণীর সংস্কৃতি সাধারণভাবে যেমন সমাজের সংস্কৃতিতে আধিপত্য বিস্তার করে, তেমনি শাসক শ্রেণীর আচরণও সমাজের বিভিন্ন স্তরে মানুষের আচরণের ওপর প্রভাব বিস্তার করে থাকে। শুধু তাই নয়, বলা চলে আধিপত্য বিস্তার করে থাকে। এটাই যে এখন সমাজের বাস্তব অবস্থা এর প্রমাণের জন্য বেশি কাঠখড় পোড়ানোর প্রয়োজন নেই। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় চোখ রাখলেই এর ভূরিভূরি প্রমাণ পাওয়া যায়। কেউ যদি সংবাদপত্রে বিভিন্ন ধরনের ক্রাইমের রিপোর্ট লাল কালি দিয়ে দাগ দেন, তাহলে দেখবেন পাতার পর পাতা একেবারে লাল হয়ে আছে! গত কয়েক বছর ধরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের লোকদের নিজেদের দুর্নীতি এবং সরকারের যা ইচ্ছে তাই কাজকর্মের রিপোর্টের দিকে তাকালে দেখা যাবে, দেশে সাধারণ মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ-মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে, তাদের স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছে, তারা যেখানেই সভা-সমাবেশ-মিছিল করে সরকারবিরোধী কোনো কর্মসূচি পালন করছে, সেখানেই তাদের ওপর পুলিশ ঝাঁপিয়ে পড়ছে। এর ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের স্বাধীনতা বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সরকারের যা ইচ্ছে তাই করে যাওয়ার মতো স্বাধীন শক্তি জনগণের স্বাধীনতার ওপর খক্ষাঘাত করে তার অস্তিত্ব বিলোপ করেছে। এমনকি জনগণের যে ভোটের অধিকারের কথা তারা বলে, সেটা পর্যন্ত তারা হরণ করেছে জালিয়াতি ও পুলিশি নির্যাতনের মাধ্যমে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাতীয় সংসদে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অর্থাৎ জনগণের ভোট ছাড়া নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন সরকারকে আবার ক্ষমতায় বসানোর জন্য যে ব্যবস্থা করেছিলেন, তার চেয়ে গণতন্ত্রবিধ্বংসী ব্যাপার আর কী হতে পারে? এভাবে গণতন্ত্র ধ্বংস করে যে নির্বাচনের মহড়া দেয়া হয়েছিল, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশকে সর্বতোভাবে ব্যবহার করে, তার থেকেই প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশে নির্বাচনের কোনো কার্যকারিতা ও নির্ভরযোগ্যতা আর নেই। কাজেই বাংলাদেশে চুরি-দুর্নীতি আজ শুধু অর্থসম্পদ লুটপাটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, সরকার গঠন পর্যন্ত এখন এই একই প্রক্রিয়ায় হচ্ছে।

সর্বশেষে বলা দরকার, বাংলাদেশে চুরি, দুর্নীতি, লুটপাট ও সন্ত্রাস ১৯৭২ সাল থেকে অপ্রতিহতভাবে চলে আসার পর অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে, এ নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, মারামারি, খুন-খারাবি সরকার শুধু বিরোধী দলসমূহের লোকদের সঙ্গেই করছে না, তারা এখন নিজেদের মধ্যেও এ কাজ করছে। কাজেই নির্বাচন ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের লোকরা তাদের দলীয় শৃংখলা ও নির্দেশের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছে, পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ, খুন-খারাবিতে লিপ্ত হচ্ছে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ এবং তাদের অন্যান্য অঙ্গ সংগঠনের পারস্পরিক হত্যার সংবাদ এখন প্রতিদিনের সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায়। এটা শুধু শাসক দল আওয়ামী লীগের জন্যই বিপজ্জনক নয়, সারা দেশের জন্যও বিপজ্জনক। কারণ এর মাধ্যমে বোঝা যায় দেশে সরকারের শাসন, সে শাসন যত প্রতিক্রিয়াশীলই হোক, বাংলাদেশে এখন কার্যত বিলুপ্ত হওয়ার পথে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ইত্যাদির কথা বলে যারা প্রতিদিন নিজেদের মুখে ফেনা তুলছে, দেশকে তারা আজ যে পর্যায়ে এনে দাঁড় করিয়েছে তার চূড়ান্ত পরিণাম থেকে দীর্ঘদিন তারা রক্ষা পাবে এটা মনে করার কারণ নেই। ইতিহাসের কিছু নিয়মকানুন আছে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়, এমনটি ভাবা ঠিক নয়।

০৩.০৪.২০১৭

বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

 

http://www.jugantor.com/sub-editorial/2017/04/04/114893/