৬ জুন ২০২১, রবিবার, ২:৫৭

করোনার ভারতীয় ধরন মোকাবিলা

উদ্বেগ বাড়ছে, উদ্যোগ কম

সাতক্ষীরা ছাড়া সীমান্তের অন্য ছয় জেলায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লকডাউনের সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি

করোনার ভারতীয় ধরনের সংক্রমণ সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর বাইরেও ছড়িয়ে পড়ছে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং ইনস্টিটিউট ফর ডেভেলপিং সায়েন্স অ্যান্ড হেলথ ইনিশিয়েটিভসের (আইডিএসএইচআই) যৌথ জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ে ঢাকা, খুলনা, বাগেরহাট, গোপালগঞ্জ, পিরোজপুর ও গাইবান্ধায় ভারতীয় ধরন হিসেবে পরিচিত ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে। এতে দেশে উদ্বেগ বাড়লেও ভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ কম।

গত ২৯ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি সীমান্তবর্তী সাত জেলায় লকডাউনের সুপারিশ করলেও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি। সাত জেলার মধ্যে শুধু সাতক্ষীরায় গতকাল লকডাউন দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, নিজ নিজ এলাকার পরিস্থিতি সাপেক্ষে লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারবে স্থানীয় প্রশাসন। কিন্তু সুপারিশ করা জেলাগুলোতে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না স্থানীয় প্রশাসন।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, স্থানীয় প্রশাসনের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দায়মুক্ত থাকতে চাইছে কেন্দ্রীয় প্রশাসন। কিন্তু এর ফল ভালো হবে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম সমকালকে বলেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর বাইরে ভারতীয় ধরন শনাক্ত হওয়ার ঘটনায় স্বাস্থ্য বিভাগ উদ্বিগ্ন। বিষয়টি নিয়ে করণীয় নির্ধারণে আজ (শনিবার) ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে স্থানীয় প্রশাসনকে নিজ নিজ এলাকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ জারি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী কয়েকটি এলাকায় বিধিনিষেধ আরোপ করেছে স্থানীয় প্রশাসন।

লকডাউনে ধীরগতি :গত ৮ মে ভারত থেকে আসা তিন বাংলাদেশির শরীরে করোনার ভারতীয় নতুন ধরন শনাক্তের খবর জানায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর পর মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংক্রমণ হঠাৎ বাড়তে থাকে। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে সংক্রমণ পরিস্থিতি মারাত্মক আকার ধারণ করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ মে ওই জেলায় লকডাউন ঘোষণা করে স্থানীয় প্রশাসন।

গত দুই সপ্তাহ ধরে সীমান্তবর্তী সাতটি জেলায় সংক্রমণ পরিস্থিতি ক্রমেই নাজুক হতে থাকে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৯ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগতত্ত্ব ও জনস্বাস্থ্যবিদদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটি সীমান্তবর্তী সাত জেলা নওগাঁ, নাটোর, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া ও খুলনা কঠোর লকডাউনের আওতায় আনার সুপারিশ করে। এর মধ্যে শুধু সাতক্ষীরা জেলায় গতকাল শনিবার থেকে লকডাউন কার্যকর হয়েছে।

এ ছাড়া গত ২৮ মে গোপালগঞ্জের বৌলতলী ও সাতপাড় ইউনিয়নে ১১ জনের শরীরে করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ওই দিন এ দুই ইউনিয়নে লকডাউন ঘোষণা করে স্থানীয় প্রশাসন। পরে জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের পর তাদের মধ্যে সাতজনের শরীরে ভারতীয় ধরন শনাক্ত হয়। এর পর গতকাল শনিবার ওই দুই ইউনিয়নে আরও সাত দিন লকডাউন কার্যকরের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অন্য জেলাগুলোতে সে সুপারিশ এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। তবে ভারতীয় ধরন শনাক্ত না হলেও গতকাল থেকে নোয়াখালীর কাদির হানিফ, নোয়ান্নই, বিনোদপুর, নোয়াখালী, নেয়াজপুর ও অশ্বদিয়া ইউনিয়ন এবং নোয়াখালী পৌরসভার ৯টি ওয়ার্ডে এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদার দুটি ইউনিয়নের ৯টি গ্রামেও লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে গত এক সপ্তাহে শনাক্তের হার ২৩ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে। তা ছাড়া আইইডিসিআর এবং আইডিএসএইচআইর যৌথ গবেষণায় দেশে করোনা সংক্রমণের ৮০ শতাংশই ভারতীয় ধরন বলে শনাক্ত হয়েছে।
কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের (গোষ্ঠী সংক্রমণ) কথা উল্লেখ করে গবেষণায় বলা হয়, ভারতীয় ধরন শনাক্ত হওয়া ১৪ জন কখনও ভারতে যাননি এবং বিদেশ থেকে আগত রোগীর সংস্পর্শে আসারও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এ থেকে বলা যায়, ভারতীয় ধরনটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর সমকালকে বলেন, সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যন্ত জরুরি। সবার আগে সামাজিক দূরত্ব, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। মাস্ক ব্যবহারের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। এর বাইরে সংক্রমিত এলাকায় দ্রুততার সঙ্গে লকডাউন কিংবা কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন। অন্যথায় পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে।

বিলম্ব হলে বিপদ বাড়বে :ভারতীয় ধরনে সংক্রমিত এলাকায় লাকডাউনে বিলম্ব হলে বিপদ বাড়বে বলে মনে করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম। তিনি সমকালকে বলেন, সংক্রমণ বৃদ্ধির পর সীমান্তবর্তী সাত জেলায় আরও এক সপ্তাহের লকডাউনের সুপারিশ করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞ কমিটি। কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রশাসন থেকে বলা হলো, এলাকার পরিস্থিতি বিবেচনা করে স্থানীয় প্রশাসন লকডাউন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। অথচ সংক্রমণ বাড়লেও স্থানীয় প্রশাসন ওই জেলাগুলোতে লকডাউন দিচ্ছে না। এর মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়- স্থানীয় প্রশাসনের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে তারা দায়মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছেন।

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ভাইরাসটি বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। ধাপে ধাপে এটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। এতে ভয়ানক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। ওই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া স্বাস্থ্য বিভাগের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ সমকালকে বলেন, ভারতীয় ধরন সংক্রমিত এলাকাগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করছে সরকার। এখানে কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনের বিষয় নয়। ভারতীয় ধরনটি অধিক সংক্রমণপ্রবণ। এ বিষয়ে সরকারের উচিত ছিল দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। কারণ ভাইরাসটির কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটেছে। মানে এটি ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ নিয়ন্ত্রণে সরকারের উদ্যোগ নেই বললেই চলে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সমকালকে বলেন, লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধ আরোপ করা হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে। স্বাস্থ্য বিভাগ শুধু সুপারিশ করতে পারে। এক সপ্তাহ আগে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে উচ্চ সংক্রমিত ভারতের সীমান্তবর্তী সাত জেলায় লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করার সুপারিশ করা হয়েছে। এর কারণ ভারতীয় ধরনটি যাতে সারাদেশে ছড়িয়ে না পড়ে। এটি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করবে।

https://samakal.com/bangladesh/article/210664204/