রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকার সড়ক থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে সেই আগের চেনা রূপে ওই এলাকা। ছবি : কালের কণ্ঠ
৬ জুন ২০২১, রবিবার, ২:৫৫

তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে ইঁদুর-বিড়াল খেলা!

ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের দখলে রাস্তার উভয় লেন

দখল-উচ্ছেদ নিয়ে যেন চলে ইঁদুর-বিড়াল খেলা! সিটি করপোরেশন একদিকে উচ্ছেদ করে, অন্যদিকে দুর্বৃত্তরা করে দখল। এই শীতল লড়াইয়ে দখলবাজদেরই জয়জয়কার! ২০১৫ সালে রাজধানীর তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ ছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাড়া-জাগানো অভিযান। তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড দখলমুক্ত করার কারিগর প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের এই অসামান্য কাজটি এখনো রাজধানীবাসীর মুখে মুখে ফেরে। এই কাজে সফলতার মধ্য দিয়েই তিনি ঢাকাবাসীর মন জয় করেছিলেন। তিনি সে সময় তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড দখলমুক্ত করে যে বাহবা পেয়েছিলেন, শেষমেশ ২০১৮ সালে সড়কটিই মেয়র আনিসুলের নামে হয়ে যায়। এখন আনিসুল হক নেই, তাই তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড সেই পুরনো চেহারায়। ট্রাকস্ট্যান্ড সড়কটিতে এখন খেলছে দখলবাজরাই।

রাজধানী ঢাকাকে বিশ্বমানের শহর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সে সময় নানা উদ্যোগ নিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আনিসুল হক। এর মধ্যে রাজধানীবাসীর হৃদয়ে দাগ কেটে যাওয়া উদ্যোগটি ছিল তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ। তবে ২০১৭ সালে আনিসুল হকের মৃত্যুর পর ফের দখল হয়ে যায় ওই এলাকা।

গত ২৫ মে দুপুরে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশ জরিপ অধিদপ্তরের সামনে থেকে টেলিগ্রাফ ওয়ার্কশপ এবং তেজগাঁও রেলগেট পর্যন্ত (মেয়র আনিসুল হক সড়ক) রাস্তার উভয় লেন দখল করে আছে প্রায় ৪০০ ট্রাক ও বড় কাভার্ড ভ্যান। মেয়র আনিসুল হক সড়কের দুই পাশে প্রায় ৫০০ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান প্রতিদিন অবৈধভাবে রাস্তা দখল করে রাখে। এ ছাড়া নিত্যদিন প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ট্রাক এখানে যাওয়া-আসা করে। এই রাস্তা ধরে তেজগাঁও রেলগেটের দিকে কিছুটা এগিয়ে যেতেই বাঁ পাশে প্রস্তাবিত আব্দুর রাজ্জাক ট্রাক টার্মিনাল। সেখানেও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় প্রায় ২০০ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান।

বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির প্রধান কার্যালয়ও তেজগাঁওয়ে। সংগঠনটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসেন মো. মজুমদার বলেন, ‘এটা মূলত লকডাউনের কারণে হয়েছে। এক দিকে রেলগেট বন্ধ ছিল, আরেক দিকে পণ্য পরিবহন চালু থাকায় অনেক ট্রাক এসে জমা হতো। আবার বেশির ভাগ গাড়িই ট্রিপ পেত না। এতেই এ জটলা তৈরি হয়েছে। স্ট্যান্ডের ভেতর জায়গা দিতে না পারায় ট্রাকগুলো রাস্তায় থাকত। গাড়িগুলো এক সারিতে থাকলে তেমন অসুবিধা হতো না। অনেক সময় তিন সারিতেও চলে যায় এবং বিশৃঙ্খলার কারণেই এমন অবস্থা হচ্ছে। তবে এখন লকডাউন ছেড়ে দিয়েছে। খুব দ্রুতই সড়কটি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। আমরা সেই চেষ্টাই করছি।’

এদিকে শনিবার ফের সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, দিনের বেলা সাতরাস্তা থেকে রেলগেট যাওয়ার সড়কটি কিছুটা ফাঁকা থাকলেও সন্ধ্যা থেকে তা আবার ট্রাকের দখলে চলে যায়। সড়কে দিনের বেলা বড় ট্রাকের উপস্থিতি কিছুটা কম থাকলেও ছোট পিকআপ ভ্যান রাস্তায়ই দাঁড়িয়ে ছিল। তবে ট্রাকস্ট্যান্ডের দক্ষিণ পাশ দিয়ে এফডিসি যাওয়ার সড়কটি গতকালও ছিল ট্রাকে ভরপুর।

এ নিয়ে ট্রাকস্ট্যান্ডের দায়িত্বশীল একজন বলেন, ‘গত মঙ্গলবার উত্তরের মেয়রের সঙ্গে আমাদের বৈঠক হয়েছে। আমরা মাইকিং চালিয়ে যাচ্ছি। সাতরাস্তা থেকে রেলগেটের সড়কটি খালি রাখার জন্য আমরা কথা দিয়েছি। সোমবার সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আমাদের আরেক দফা বৈঠক হবে। ট্রাক টার্মিনাল এখান থেকে সরিয়ে নেওয়ার বিষয়েও আলাপ হচ্ছে। আমাদের ১০-১২ একরের মতো একটি বড় জায়গার প্রয়োজন, তা পেলেই এখান থেকে ট্রার্মিনাল সরিয়ে নেওয়া হবে।’

এখানে নতুন করে ট্রাক টার্মিনাল করার জন্য ডিএনসিসির বর্তমান মেয়র আতিকুল ইসলাম সরকারি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের ফাঁকা জমি অধিগ্রহণের জন্য চেষ্টা করছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা। তিনি বলেন, ‘আসলে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। তবে এই জায়গাটা রেল কর্তৃপক্ষের। তারা এটা দিতে চাচ্ছে না। আমরা অন্য কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের ফাঁকা জমি অধিগ্রহণের জন্য চেষ্টা করছি। সেটা পাওয়া গেলেই নতুন করে ট্রাক টার্মিনাল করার উদ্যোগ নেব। প্রয়াত মেয়রের আলোচনা যেন মাঠে মারা না যায়, সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।’

এদিকে সড়কটি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের দখলে থাকার কারণে পথচারীদের চলাচল করতে সমস্যা হয়। পাশাপাশি এই রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী গাড়িগুলোও ট্রাকের কারণে যাতায়াত করতে পারে না। দিনের বেশির ভাগ সময়ই লেগে থাকে তীব্র যানজট।

মানিকগঞ্জ থেকে ট্রাক নিয়ে ঢাকায় এসেছেন সবুজ আলী। তিনিও গাড়ি রেখেছেন এই রাস্তার ওপর। এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াতের সময় কথা হয় খাদ্য অধিদপ্তরের ফুড ইন্সপেক্টর সালমা আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘চালকরা ওদের খুশিমতো এই রাস্তা দিয়ে ট্রাক ঢোকায়, বের করে। ফলে অনেক সময় আমাদের দপ্তরের জরুরি কাজে নিয়োজিত ট্রাকগুলো এখানে ঢুকতে পারে না। যানজট তৈরি হয়। এ নিয়ে অনেকবার বাগবিতণ্ডাও হয়েছে। চালকদের ব্যবহারও খুব খারাপ। ওদের নেতারা বলে, এখান থেকে কেউ তাদের উচ্ছেদ করতে পারবে না।’

কাভার্ড ভ্যানের চালক হৃদয় বলেন, ‘রাতে গাড়িগুলো এখানে থাকে। তবে করোনার কারণে এখন অনেক দিন ধরেই গাড়িগুলো এখানে পড়ে আছে। টার্মিনাল পুরো ভরা। সেখানে রাখা যায় না। তাই এ জায়গায় রাখি।’

বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভারস ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ও তেজগাঁও থানা জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি মো. আবুল কাসেম বলেন, ‘আমরা এই জায়গা দখলমুক্ত রাখতে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমাদের দিক থেকে এরই মধ্যে মাইকিং শুরু হয়েছে। পুলিশও তাদের কাজ করছে। এই এলাকা আর আগের রূপে ফিরে যাবে না। এই রাস্তাটা স্বাভাবিক হওয়ার পর মানুষের চলাচল সহজ হয়েছে।’

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/06/06/1040303