৬ জুন ২০২১, রবিবার, ২:৪৯

ভারত প্রেমের খেসারত

সিনোফার্মের টিকার দাম প্রকাশ করায় বেইজিংয়ের অসন্তোষ দিল্লিকে খুশি করতে ‘সেরামের টিকা’ এখনো কিছু আমলার পছন্দ চীনকে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশের দুঃখ প্রকাশ

‘ঘুড়ি তুমি কার আকাশে উড়ো/ তার আকাশ কি আমার চেয়ে বড়ো’ এই গানটি তরুণ-তরুণীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এই গানের মতোই বাংলাদেশের প্রশাসনে কর্মরত উচ্চ পর্যায়ের কিছু আমলার কর্মকাণ্ডে মানুষ প্রশ্ন তুলেছে বাংলাদেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভুক্ত ওই কর্মকর্তারা কার স্বার্থ প্রাধান্য দিচ্ছেন। তারা কার আকাশে উড়ছেন, দেশের স্বার্থের চেয়ে কার স্বার্থ তাদের কাছে বড়? প্রশাসনযন্ত্রের লাটাই হাতে নিয়ে দেশের স্বার্থে না ভারতের স্বার্থ রক্ষা করছেন? গোটা বিশ্বে যখন করোনার টিকা সংগহে উদগ্রীব তখন চীনের টিকা বাদ দিয়ে ভারতের সেরামের টিকা ক্রয়; পরবর্তী সময়ে ভারতের স্বার্থে চীনের সঙ্গে গোপন চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশ করায় বাংলাদেশ টিকা সংগ্রহে অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেছে। কিছু আমলার দিল্লির এজেন্ডা বাস্তবায়নের কারণে দেশের ১৬ কোটি মানুসের টিকা গ্রহণ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গেছে।

বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে গত ১২ মে চীন সিনোফার্মের ৫ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। আর ৬ লাখ ডোজ উপহারের টিকার চালান আসবে আগামী ১৩ জুন। উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে চীন উপহার হিসেবে ১৩ লাখ টিকা দিলেও বাণিজ্যিক পর্যায়ে চীনের সিনোফার্মার টিকা বাংলাদেশের পেতে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আশবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘চীন থেকে আমরা ৫ কোটি ডোজ কিনব। জুলাই মাস থেকে সে টিকা পর্যায়ক্রমে আসতে শুরু করবে’। বাস্তবতা হলোÑ বাংলাদেশ-চীনের মধ্যে টিকা ‘ক্রয়-বিক্রয়’ ইস্যুতে একজন আমলা সিনোফার্মের টিকার দাম প্রকাশ করায় চীনা কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের প্রতি নাখোশ হয়েছেন। উপহারের টিকা বাংলাদেশে যথাসময়ে পাঠালেও বাংলাদেশের কাছে চীনের টিকা বিক্রি প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দিয়েছে।

দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনে কর্মরত কিছুৃ আমলার ভারতের স্বার্থ রক্ষার নির্লজ্জ চেষ্টা এবং কূটনৈতিক ব্যর্থতায় টিকা আমদানিতে বাংলাদেশ বারবার হোঁচট খাচ্ছে। করোনা সংকট মোকাবিলায় চীনের প্রতিষ্ঠান সিনোফার্মের সঙ্গে টিকা নিয়ে আলোচনা শুরু হয় বেশ কয়েক মাস আগে। কিন্তু কিছু আমলার দিল্লিকে খুশি করার মানসিকতায় সে প্রক্রিয়া থেমে যায়। অতঃপর ভারতের সেরামের সঙ্গে টিকা চুক্তি করা হয়। বাংলাদেশের কাছে ৬শ’ কোটি টাকা নেয়ার পরও সেরামের টিকার আমদানি মোদি আটকে দেয়ার পর আবার চীন থেকে টিকা সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু করে বাংলাদেশ। কিন্তু এর মধ্যেই একজন শীর্ষস্থানীয় আমলা দিল্লিকে খুশি করতে চীনা টিকা ক্রয়ের শর্তভঙ্গ করেন।

এর কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ-চীনের টিকা কূটনীতির প্রক্রিয়ার মাঝেই বাংলাদেশে নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত লি: জিমিং দাবি করেন, বাংলাদেশের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে না পারা ও সময়ক্ষেপণের কারণে টিকা পেতে বিলম্ব হচ্ছে। চীন উপহার হিসেবে ৫ লাখ ডোজ টিকা বাংলাদেশকে দেয়ার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসের ৩ তারিখে চিঠি দেয়। অথচ সে চিঠির উত্তর দিতে বাংলাদেশ তিন মাস সময় নিয়েছে। অতঃপর টিকা নেয়ার প্রক্রিয়ায় আলোচনায় আসে অপ্রকাশযোগ্য চুক্তি। যার জন্য চীনা ভাষায় লেখার জায়গায় সই করে ফেলা একধরনের চাহিদাপত্র দিয়ে পরে তা কমানোসহ আমলাদের প্রশাসনিক নানা দুর্বলতা ও দিল্লিপ্রেমের চিত্রই উঠে আসে জনসম্মুখে। ফলে চীনের টিকা বিলম্বের খেসারত দিতে হচ্ছে নাগরিকদের।

জানা গেছে, চীনের কাছ থেকে বাংলাদেশের টিকা ক্রয়ের চুক্তির শর্তই ছিল সিনোফার্মের টিকার দামের ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী একাধিকবার চীনের সঙ্গে টিকা চুক্তির গোপনীয়তা প্রকাশ হলে টিকা পাওয়া অনিশ্চিত হতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু মন্ত্রী পরিষদের অতিরিক্ত সচিব ড. শাহিদা আকতার চীনের টিকার দাম জনসম্মুখে প্রকাশ করেন। এতে বাংলাদেশের আচরণে অসন্তোষ প্রকাশ করে চীন। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ জন্য দুঃখ প্রকাশ করে চীনের কাছে চিঠিও পাঠানো হয়। সার্বিক চিত্র তুলে ধরে গতকাল পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, ‘চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে চুক্তিতে সিনোফার্মের টিকার বিক্রয়মূল্য প্রকাশ না করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তারপরও তা প্রকাশ করায় বিরক্তি প্রকাশ করেছে চীন। এজন্য আমরা চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছি। তবে, এ ঘটনায় আমাদের অবস্থান বেশ খানিকটা খারাপ হয়েছে। ভবিষ্যতে সরকার আর ওই দামে টিকা কিনতে পারবে না। চীন অন্য দেশে যে দামে টিকা বিক্রি করে, সে দামেই এখন আমাদের কিনতে হবে। তা দ্বিগুণ বা তিন গুণও হতে পারে।’

সারাবিশ্বে করোনার টিকার জন্য হাহাকার চলছে। চীন সবার আগে বাংলাদেশকে টিকা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু সে প্রস্তাব চাপা দিয়ে অক্সফোর্ড অ্যাস্ট্রাজেনেকার উদ্ভাবিত ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটে উৎপাদিত টিকার জন্য ৬শ’ কোটি টাকা অগ্রিম দেয়া হয়। কিন্তু মোদি সরকার সেরামের টিকা বাংলাদেশে রফতানি নিষিদ্ধ করে দেয়। বিপদে পড়ে বাংলাদেশ চীন-রাশিয়া-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশের টিকা ক্রয়ের চেষ্টা শুরু করে। এর মধ্যে চীনের সঙ্গে টিকা ক্রয়ের গোপন চুক্তিও হয়।

গত ২৭ মে মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে চীন থেকে সিনোফার্মের করোনা টিকার দেড় কোটি ডোজ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন হয়। চীন আগেই জানিয়েছিল তারা টিকা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করছে। ব্যবসায়িক কারণে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন মূল্যে টিকা বিক্রি করছেন। উন্নয়ন সহযোগী বাংলাদেশের কাছে সবার চেয়ে কম দামে টিকা বিক্রি করবেন, তবে সেটা প্রকাশ করা যাবে না। বাংলাদেশ টিকা ক্রয়ের গোপনীয়তা রক্ষায় রাজী হয়। কিন্তু প্রশাসনের ভিতরে থাকা ভারতপ্রেমী আমলাদের একটি অংশ চীনের টিকা ক্রয়ে বাগড়া দিতে নানার ফন্দিফিকির করেন। চীন যাতে বাংলাদেশকে টিকা না দেয় সে লক্ষ্যে টিকা ক্রয়ের গোপন শর্ত ভঙ্গ করেন। মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর গোপনীয়তা রক্ষার নির্দেশনা থাকার পরও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. শাহিদা আকতার ব্রিফিং করে সাংবাদিকদের জানান সরকার চীনের কাছ থেকে প্রতি ডোজ টিকা ১০ ডলারে কিনতে যাচ্ছে। সিনোফার্মের টিকার দাম প্রকাশ করায় চীনের প্রশাসন বিরক্তি প্রকাশ করার পর স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম জানান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস (ডিজিএইচএস) ঢাকায় কর্মরত চীনা দূতাবাসকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করা হয়। কিন্তু চিঠির জবাব এখনো দেয়নি চীন।

বেইজিংকে দেওয়া চিঠিতে টিকার দাম জানাজানি অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়েছে উল্লেখ করে দুঃখ প্রকাশ করে ঢাকা। স্বাস্থ্য অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, টিকার দাম গণমাধ্যমে আসার কারণে প্রস্তাবিত চুক্তি অনুযায়ী ১০ ডলারে টিকা পাওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে। আমরা বেইজিংকে এ বিষয়ে একটি চিঠি দিয়েছি। এতে বেইজিংয়ের কাছে দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এবং ইচ্ছাকৃতভাবে টিকার দাম প্রকাশ করা হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে চিঠিতে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক খুরশিদ আলম বলেন, চীন প্রতি ডোজ ভ্যাকসিন শ্রীলঙ্কার কাছে ১৪ ডলার ও ইন্দোনেশিয়ার কাছে ১৭ ডলারে বিক্রি করছে। বাংলাদেশে সিনোফার্মের বিক্রয়মূল্য জানার পর, সেসব দেশ চীনকে কম দামে ভ্যাকসিন বিক্রির জন্য চাপ দিচ্ছে। এনিয়ে চীন আমাদের ওপর বেশ বিরক্ত হয়েছে।

করোনা প্রতিরোধে চীনের সিনোফার্মের দেড় কোটি ডোজ টিকা কিনছে বাংলাদেশ। মন্ত্রিপরিষদের ভ্যাকসিন ক্রয় কমিটি চীনের এই টিকা কেনার অনুমোদন দিয়েছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে চীনা ভ্যাকসিন কেনার বিষয়টি অনুমোদন দেয়। প্রস্তাবিত চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশকে প্রতি চালানে ৫০ লাখ করে তিন ধাপে দেড় কোটি ডোজ টিকা দেওয়ার কথা হয় চীনের সঙ্গে। এই টিকার ডোজপ্রতি দাম ধরা হয়েছিল ১০ ডলার। বাংলাদেশের কাছ থেকে টিকার চাহিদাপত্র পাওয়ার পর বাণিজ্যিক স্বার্থে টিকার দাম যেন কোনোভাবে প্রকাশ করা না হয়, সেটি বলে দেয় চীন।

ভারতের স্বার্থে চীনের টিকার দাম প্রকাশ করায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. শাহিদা আকতারের বিরুদ্ধে দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডের অধিযোগ তোলা হয়নি; রাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁসের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেনি। লোক দেখানোর জন্য বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করেছে। অথচ কয়েকদিন আগেও রাষ্ট্রের গোপন তথ্য প্রকাশের চেষ্টার অভিযোগে একজন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩ আইনে মামলা হয়েছে।

চীনের টিকা পেতে বাংলাদেশ সরকার উদগ্রীব হয়ে উঠেছে। চীনও উন্নয়ন সহযোগী বাংলাদেশকে টিকা দেয়ার ব্যাপারে আন্তরিক। অন্যদিকে সেরামের টিকা বাংলাদেশকে দেবে না জানিয়ে গত ৪ জুন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপত্র অরিন্দম বাগচী সংবাদ সম্মেলন করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘ভারত নিজের চাহিদা না মিটিয়ে এখন দেশের বাইরে টিকা যেতে দেবে না’। তারপরও দিল্লির তাঁবেদার বাংলাদেশের কিছু আমলা রাখঢাক না করেই ‘ভারতের টিকা বেশি পছন্দ’ জানিয়েছেন। বাংলাদেশ টিকাদান কর্মসূচি অব্যাহত রাখার অজুহাত দেখিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক বলেছেন, চীনের তৈরি করোনা ভ্যাকসিন কেনার সিদ্ধান্ত নিলেও এখনো ভারতের তৈরি এস্ট্রাজেনেকা টিকা বাংলাদেশের পছন্দ। ভারতের বার্তা সংস্থা আইএএনএস এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। কর্মকর্তার মিডিয়ায় কথা বলার অনুমতি নেই বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ওই কর্মকর্তা আইএএনএসকে বলেন, ‘পুনের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ভ্যাকসিন পেতে ব্যর্থ হওয়ার পরেই শুধু আমাদের চীনা এবং রাশিয়ান বিকল্পের সন্ধান করতে হয়েছিল। আমরা ভারতের ভয়াবহ করোনা পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত এবং প্রতিশ্রুতি করা সরবরাহের ক্ষেত্রে সেরামের বর্তমান অক্ষমতাও উপলব্ধি করছি। বাংলাদেশ সরকার অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে যৌথ উৎপাদনে যেতে ‘খুব বেশি আগ্রহী’ ছিল। সেক্ষেত্রে সেরাম বাংলাদেশের কোনো কোম্পানি বেছে নিলে সরকারের কোনো আপত্তি ছিল না। ভারত ও বাংলাদেশ একত্রে মিলে দক্ষিণ এশিয়াকে বিশ্বের ফার্মেসী বানাতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রী (স্বাস্থ্যমন্ত্রী), পুনাওয়ালার মতো সেরামের শীর্ষ কর্তাদের সাথে এই চুক্তির ব্যাপারে সরাসরি আলোচনা করতে প্রস্তুত। আমরা বাংলাদেশে সেরামের টিকা উৎপাদন করতে পারলে খুব খুশি হবো। শর্তের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নমনীয় এবং আমরা নিশ্চিত যে আমাদের বিশাল চাহিদা পূরণের পর একটা ভালো পরিমাণ টিকা অন্যান্য দেশে রফতানি করা যেতে পারে। কারণ ভারতে তৈরি দামের তুলনায় এই দাম প্রতিযোগিতামূলকই হবে’। ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘মন্ত্রণালয় রাশিয়ার এবং চীনা টিকা যৌথ উৎপাদন করতে কেবল ইনসেপ্টা ফার্মা, পপুলার ফার্মা এবং ওয়ান ফার্মার সাথে তিনটি ‘অপ্রকাশযোগ্য’ চুক্তি অনুমোদন করেছে। তবে কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। আমাদের বড় আশা সেরাম ইনস্টিটিউট বাংলাদেশে যৌথ উৎপাদনে যাবে।’

সারাবিশ্ব টিকার জন্য উদগ্রীবের মধ্যে ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট চীনা কোম্পানির তৈরি টিকা ট্রায়ালের সম্মতি দিয়েছিল বাংলাদেশ। ওই বছরের ২০ আগস্ট ‘করোনাভাইরাসের টিকার ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বাংলাদেশে হওয়া উচিত’ জানিয়ে বিবৃতি দেয় বাংলাদেশের করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। অতঃপর স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা চীনের টিকা ট্রায়াল চালাতে দেব’। হঠাৎ প্রশাসনের দায়িত্বশীল আমলাদের কয়েকজন চীনের টিকা ট্রায়ালের বিরোধিতা করে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট উৎপাদিত টিকা ক্রয়ের প্রক্রিয়া শুরু করে। প্রশাসনে কর্মরত দিল্লির তাঁবেদার আমলাদের ম্যারপাঁচে চীনের টিকা ট্রায়াল বন্ধ রেখে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার (এসআইই) সঙ্গে টিকা কেনার ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করা হয়। টিকা নেয়ার লক্ষ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া প্রাইভেট লিমিটেড এবং বাংলাদেশের বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেডের চুক্তিতে সই করেন। অতঃপর ৪ জানুয়ারি সেরামের কাছে অগ্রিম পাঠানো হয় তিন কোটি ডোজ টিকার মূল্য হিসেবে ৬শ’ কোটি টাকা। চুক্তি হয় ভারত প্রতিমাসে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন বাংলাদেশে পাঠাবে। ঘোষণা দেয়া হয় ভারত ও বাংলাদেশের মানুষকে একই দিনে টিকা প্রয়োগ শুরু হবে। কিন্তু সেরামের ক্রয় করা টিকার প্রথম চালান ৫০ লাখ ডোজ ও দ্বিতীয় চালান ২০ লাখ ডোজ দেয়ার পর টিকা দেয়া বন্ধ করে দেয়। গত ২৪ এপ্রিল বেক্সিমকো ফার্মাসিটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান পাপন স্বীকার করেন ভারত সরকারের অনুমোদন না পাওয়ার অজুহাতে দুই মাস ধরে বাংলাদেশের টিকার চালান আটকে রেখেছে সেরাম ইনস্টিটিউট।

মূলত বাংলাদেশকে টিকা না দেয়া মোদির চক্রান্তের অভাস পাওয়া যায় সেরাম ইনস্টিটিউটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আদার পুনেওয়ালারের বক্তব্যে। তিনি রয়টার্স, এপিসহ একাধিক সংবাদ সংস্থাকে জানান সেরাম এই মুহূর্তে টিকা রফতানি করতে পারবে না।

এদিকে সর্বশেষ বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের ডেপুটি চিফ অব মিশন হুয়ালং ইয়ান গতকাল নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া পোস্টে জানান, ‘চীন সরকার তো দূরের কথা, সিনোফার্মের সঙ্গেই এখনো টিকা কেনার কোনো চুক্তি হয়নি বাংলাদেশের’। স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, চীনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে চিঠি দিলেও চীন এখনো কোনো প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে চীনের সঙ্গে টিকার ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত চুক্তি হয়নি।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে দেশের এক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, আমরা চীনের টিকা উপহার হিসেবে পেয়েছি হয়তো সামনে আরো পাব। কিন্তু উপহারের টিকা দিয়ে বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীকে টিকার আওতায় আনা যাবে না। চীনের সঙ্গে চুক্তি করে টিকা কেনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে আমরা কিন্তু দুই দেশের মধ্যে কোনো মতপার্থক্য দেখছি না। চীন চাচ্ছে তারা টিকা বিক্রি করতে আর বাংলাদেশ সেখান থেকে আমদানি করতে চাচ্ছে। বাংলাদেশের এ মুহূর্তে অন্য কোনো সোর্স নেই তাই চুক্তি করে চীনে টিকা নিতে হবে। কিন্তু আমলাদের মধ্যে দায়িত্বশীলরা যদি দেশের স্বার্থের চেয়ে ভারতের স্বার্থকে বেশি প্রাধান্য দেন; তাহলে বাংলাদেশের জন্য টিকা সংগ্রহ দূরূহ হয়ে পড়বে। চীনের টিকা প্রথমে না নিয়ে ভারতের সেরামের টিকা নেয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। এখন দ্বিতীয় দফায় দিল্লিকে খুশি রাখতে ভারতের ভূরাজনৈতিক প্রতিপক্ষ চীনের টিকা গ্রহণে গরিমসি করলে বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্যে করোনার টিকা জুটবে না।

https://www.dailyinqilab.com/article/387199