৬ জুন ২০২১, রবিবার, ২:৪৭

ফ্রি ফায়ার আর পাবজির মাধ্যমে টাকা যাচ্ছে বিদেশে

অনলাইন গেম ফ্রি ফায়ার আর পাবজির মাধ্যমে বিদেশে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা। এসব টাকার বেশির ভাগ খরচ করছে কিশোর ও তরুণরা। শুধু খেলার নেশায় অভিভাবকদের পকেট থেকে এসব টাকা খরচ করছে তারা। অনলাইন দুনিয়ায় বিভিন্ন পেজ খুলে ওই দুটি গেমের জন্য নানা অফারের ছড়াছড়ি। ফ্রি ফায়ার ও পাবজির মতো খেলায় যারা আসক্ত তাদের বেশির ভাগ সময় কাটে অনলাইন দুনিয়ায়। নিজেরা গেমের সরঞ্জামাদি কেনার পাশাপাশি অন্যদেরও উৎসাহিত করছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, অনেক কিশোর ও তরুণ ওই দুটি গেম খেলতে গিয়ে নিজেরাও ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। পড়ার টেবিল ছেড়ে তারা মত্ত অনলাইন দুনিয়ায়।

সম্প্রতি ফেসবুক পেজে একজন লিখেছেন, কমার্স পরিচালনা করছেন এবং ব্যাংকিং সেক্টরে কাজ করেন এরকম কেউ থাকলে দয়া করে পরামর্শ দিবেন। আমার ডিজিটাল গিফট কার্ডের অনলাইন শপ আছে। শপের নাম মেনশন করছি না। গত মাসে এক কাস্টমার তার বাবাকে না জানিয়ে বাবার কার্ড দিয়ে আমার সাইটে পরপর আটদিন ১২টা অর্ডার করেন। পাবজি ইউসির অর্ডার ছিল। পুরো এমাউন্ট প্রায় ২ লাখ টাকা। আটদিন পর বাবার টনক নড়ায় তিনি ব্যাংকে চার্জব্যাক ক্লেইম করেন। ব্যাংকে অভিযোগ করেন যে, তার মোবাইল হ্যাক হয়েছিল। এরপর পেমেন্ট গেটওয়ে থেকে নোটিফিকেশন আসায় আমি সব অর্ডারের ইনভয়েস ইমেইল করি। আমার কাছে সার্ভিস ডেলিভারির সব প্রুফ আছে। কাস্টমারকে ফোন করেও রিকুয়েস্ট করেছি যেন বাবাকে বলে ব্যাংক থেকে চার্জব্যাক ক্লেইম তুলে নেন। তিনি লিখেন, এরকম পরিস্থিতিতে আমার টাকা ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু? ব্যাংক যদি আমার টাকা আটকেও রাখে আমার কি করা উচিত? আমার ওয়েবসাইটে টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশন এবং রিফান্ড পলিসি সব উল্লেখ আছে। ই-কমার্সের ট্রেড লাইসেন্সও করা আছে। অভিজ্ঞদের পরামর্শ চাইছি। এটা একটা উদাহরণ। এরকম অনেক উদাহরণ রয়েছে। অনেক কিশোর ও তরুণ অভিভাবকের বিকাশ, নগদ, রকেট, ইউপে ও বিভিন্ন ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ডের পিন নাম্বার নিয়ে ফ্রি ফায়ার ও পাবজি খেলার জন্য খরচ করছে। অনলাইনে একেকটি পেজ খেলোয়াড়দের জন্য একেক রকম প্যাকেজ অফার দিয়ে থাকে। কেকেআর নামের গেমিং পেজে পাবজি খেলার জন্য ৫৫ টাকা থেকে শুরু করে ৪০ হাজার ৫শ’ টাকার ইউসি (খেলার সরঞ্জামাদি কেনার মুদ্রা) কেনার প্যাকেজ রয়েছে। অফারে বলা হয়েছে- ৩২ ইউসির দাম ৫৫ টাকা, ৬০ ইউসির দাম ৯৫ টাকা, ৬৩ ইউসির দাম ১০০ টাকা, ৭৪ ইউসির দাম ১২০ টাকা, ১২০ ইউসির দাম ১৯০ টাকা, ১২৬ ইউসির দাম ২০০ টাকা, ১৪৮ ইউসির দাম ২৪০ টাকা, ১৯৮ ইউসির দাম ৩০০ টাকা, ৩২৫ ইউসির দাম ৪৩৫ টাকা, ৩৯৬ ইউসির দাম ৬০০ টাকা, ৬৬০ ইউসি (রয়েল পাস) দাম ৮৭০ টাকা, ৬৯০ ইউসির দাম ৯২০ টাকা, ৭৫৫ ইউসির দাম ১০২০ টাকা, ৭৮৬ ইউসির দাম ১০৬০ টাকা। এভাবে ৪০ হাজার ৫শ’ ইউসির দাম ৪০ হাজার ৫শ’ টাকা। অন্যদিকে একইভাবে ফ্রি ফায়ার গেমের জন্য বিক্রি হয় ডায়মন্ড (সরঞ্জামাদি কেনার মুদ্রা)। দরবার গেমিং নামের একটি পেজে ফ্রি ফায়ার ডায়মন্ডের বিশেষ অফার দেয়া হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- ১০০ ডায়মন্ডের দাম ৮০ টাকা, ২০০ ডায়মন্ডের দাম ১৬০ টাকা, ৩১০ ডায়মন্ডের দাম ২৪০ টাকা, ৫২০ ডায়মন্ডের দাম ৪০০ টাকা, ১০৬০ ডায়মন্ডের দাম ৮০০ টাকা, ২১৮০ ডায়মন্ডের দাম ১৬০০ টাকা, ৫৬০০ ডায়মন্ডের দাম ৪০০০ টাকা, ১১,২০০ ডায়মন্ডের দাম ৮ হাজার টাকা। বিশেষ অফারে আরো আছে লেভেল আপ পাস ১৬০ টাকা, সাপ্তাহিক মেম্বারশিপ ১৬০ টাকা, মাসিক মেম্বারশিপ ৬৪০ টাকা। এসব প্যাকেজের জন্য টাকা পাঠাতে বলা হয়েছে বিকাশ, রকেট, নগদ ও ইউপের মাধ্যমে। অনলাইন গেমের মুদ্রা ব্যবসায়ীরা জানান, দুটি গেমের জন্য বিভিন্ন প্যাকেজে মুদ্রা বিক্রি করলেও আমাদের লাভ থাকে কম। মূলত নিজেদের গেমের টাকা তুলতে বেশিরভাগই ওই মুদ্রার ব্যবসায় নামেন। একটি পেজের এডমিন ও মালিক মানবজমিনকে বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সার্ভার থেকে গেম দুটির মুদ্রা কিনতে হয়। এজন্য আমাদের ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার কার্ডের ব্যবহার করতে হয়। ডলার পেমেন্টের মাধ্যমে আমাদের ওই মুদ্রা কিনতে হয়। হাজারে ৫ থেকে ১০ টাকা লাভ থাকে। বাকি টাকা পাঠিয়ে দিতে হয় বিদেশে। বর্তমানে বাংলাদেশে যারা ফ্রি ফায়ার ও পাবজি খেলছেন তারা বেশিরভাগ মালয়েশিয়ার সার্ভার থেকে নেয়া মুদ্রা ব্যবহার করছেন। কারণ অন্যান্য দেশের তুলনায় মালয়েশিয়ার সার্ভারের দাম অনেক কম। একেকটি পেজ থেকে দিনে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার অনলাইন গেম মুদ্রা বিক্রি হয়। দেশে বর্তমানে এরকম কয়েক হাজার পেজ রয়েছে। এদিকে গেম দুটি বন্ধের জন্য এরই মধ্যে রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দাবি জানানো হয়েছে। গত মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে দুটি সংগঠনের পক্ষ থেকে মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। একটি মানববন্ধনে বাংলাদেশে ফ্রি ফায়ার ও পাবজি গেম বন্ধের দাবি জানিয়ে বাংলাদেশ ন্যাপ মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভূঁইয়া বলেন, ওই দুটি গেম কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে আসক্তি তৈরি করেছে। যা মাদকের চাইতে ভয়াবহ। আমাদের প্রজন্মকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। স্বেচ্ছাসেবক পথের আলো ফাউন্ডেশন আয়োজিত মানববন্ধন কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ফ্রি ফায়ার আর পাবজি গেম বন্ধে সরকারের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বারের বক্তব্য হতাশাজনক। তার সাম্প্রতিক বক্তব্য সমগ্র জাতিকে হতাশ করেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তিনি দেশের জনগণের প্রতিনিধি নন, এই সকল গেম ব্যবসায়ীদের প্রতিনিধি। মন্ত্রী জনগণের স্বার্থ নয়, লুটেরাদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত। তিনি আরো বলেন, এ ধরনের গেম খেলার ফলে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে। অনলাইনে গেম খেলার পাশাপাশি ভার্চ্যুয়ালি অর্থ লেনদেন হচ্ছে এমএমএস প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। আর এতে করে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি ও পরিবার। তিনি বলেন, সমপ্রতি নেপালে পাবজি নিষিদ্ধ করেন দেশটির আদালত। একই কারণে ভারতের গুজরাটেও এ গেম খেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছিল। এমনকি গেমটি খেলার জন্য কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছিল। বাংলাদেশেও পাবজি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়েছিল, পরে আবার চালু করা হয়। কাদের স্বার্থে চালু করা হলো? একই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনা মহামারিতে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার ফলে অনলাইনভিত্তিক ক্লাসের জন্য অভিভাবকরা সন্তানদের হাতে ল্যাপটপ, মোবাইল ডিভাইস তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ সুযোগে তরুণ প্রজন্ম এ গেম দুটির প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, আমরা যখন আগামীর তরুণ প্রজন্মকে সহজলভ্য দ্রুতগতির ইন্টারনেট প্রাপ্তির জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছি, ঠিক তখন তারা প্রযুক্তির অপব্যবহার করে বিপথগামী হয়েছে, যা আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। টেলিযোগাযোগ ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং নিয়ন্ত্রক কমিশনকে দ্রুত এবং দ্রুততার সহিত এ গেমগুলোর অপব্যবহার বন্ধ এবং প্রযুক্তির ভালো দিক তুলে ধরতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের পাশাপাশি জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। একইদিন অভিভাবক-ছাত্র-শিক্ষক জাতীয় মঞ্চ নামের আরো একটি সংগঠন রাজধানীতে ফ্রি ফায়ার ও পাবজির মতো গেম বন্ধের দাবি জানায়। পাশাপাশি অবিলম্বে স্কুল ও কলেজ খুলে দেয়ার দাবি তুলে ধরেছে।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=277097&cat=2