৬ জুন ২০২১, রবিবার, ২:৪৬

বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২ লাখ শিক্ষার্থী টিকা পাবে কীভাবে?

করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাখাত। দিনের পর দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ অবস্থায় উচ্চ শিক্ষালয়ে শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করোনার টিকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দেয়ার চিন্তা করছে। তবে সেটি কবে থেকে শুরু হবে তার কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করেনি। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, বর্তমানে পাবলিক, প্রাইভেট ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট ১১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৬৭ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছেন। সরকার যদি শুধু শিক্ষার্থীদেরই টিকাকরণের উদ্যোগ নেয় তাহলে প্রায় সাড়ে ২৩ লাখ ডোজ টিকার দরকার। যদিও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিতে চাইলে শিক্ষার্থী ছাড়াও শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও টিকার আওতায় আনতে হবে। সেক্ষেত্রে টিকার চাহিদা আরও অনেক বাড়বে।
এদিকে টিকাকরণের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি কি প্রথম ডোজ দেয়ার পর খুলে দেয়া হবে না দুই ডোজের টিকাকরণ সম্পন্ন করেই খুলে দেয়া হবে তা স্পষ্ট নয়। আবার সরকার টিকা প্রদানের পরই বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া হবে বলে ঘোষণা দিলেও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের টিকাকরণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি এখনো। ইউজিসি’র নির্দেশিকা অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের নিবন্ধনের জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র থাকা জরুরি। কিন্তু দেশের সকল শিক্ষার্থীর জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। তাদের জন্য বিকল্প কোনো চিন্তা এখন পর্যন্ত করা হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসি সচিব ফেরদৌস জামান বলেন, শিক্ষার্থীদের বৃহৎ একটি অংশ জাতীয় পরিচয়পত্র পাননি। তাদের কথা চিন্তা করে আলাদা একটি অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যয়নের ভিত্তিতে আবেদনের জন্য টিকার ব্যবস্থা করা হবে। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তালিকা দিলেও টিকার ব্যবস্থা করা হবে। ইউজিসি থেকে প্রকাশিত সর্বশেষ ২০১৯ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে উচ্চ শিক্ষা পর্যায়ে মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ১১ লাখ ৬৬ হাজার ৮৬৭ জন। যার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ ৪৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ৮ লাখ ১৭ হাজার ৭০৭ জন। আর ১০৫টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩ লাখ ৪৯ হাজার ১৬০ জন। সেক্ষেত্রে শুধু উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলতে গেলেই প্রায় ২৫ লাখ টিকার প্রয়োজন। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, যতদ্রুত শিক্ষার্থীদের টিকাকরণ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যায় ততই হবে মঙ্গল। কারণ করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাখাত।

এদিকে ইউজিসি’র নির্দেশনার আগেই টিকা পেতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের তালিকা করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার মো. এনামউজ্জামান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে করোনাভাইরাসের টিকা পেতে আগ্রহী শিক্ষার্থীদের ৩১শে মার্চের মধ্যে নিবন্ধন করার নির্দেশনা দেয়া হয়। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী টিকা পেতে নির্দিষ্ট ফরমে নিবন্ধন করেছে বলে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেল এর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমাদের নির্ধারিত ফরমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী টিকা পেতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমরা চূড়ান্ত তালিকা করে সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি।’ শিক্ষার্থীদের টিকা দেয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়ে শিক্ষার্থীদের তালিকা পাঠিয়েছি। আমরা অনুরোধ করেছি যেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য সরকার টিকার ব্যবস্থা করে।’ টিকা পেতে অনলাইনে আবেদন করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরাও। বিশ্ববিদ্যালয়টির ওয়েবসাইটে সাব-ডোমেইন করে আবেদন নেয়া হয়। মোট ৩৫ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৪ হাজার শিক্ষার্থী টিকার জন্য আবেদন করেছেন। আবেদন করার সময় ছিল ১০-২৪শে মে পর্যন্ত। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেল থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, মোট শিক্ষার্থী ১৫ হাজার ৩৮৪ জন। এদের মধ্যে করোনা টিকার জন্য আবেদন করেছেন ৬ হাজার ৬০৭ জন অর্থাৎ ৪৩ শতাংশ। তবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকা নিয়ে কোনো অগ্রগতি নেই। করানো হয়নি কোনো রেজিস্ট্রেশন। এ বিষয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (ভারপ্রাপ্ত) প্রফেসর খান গোলাম কুদ্দুস বলেন, এরই মধ্যে আমরা প্রত্যেক ডিসিপ্লিন থেকে শিক্ষার্থীদের নামের তালিকা সংগ্রহ করেছি। বাকিটা নির্ভর করছে সরকারের ওপর। আমরা নির্দেশনার জন্য অপেক্ষা করছি। ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও ////(ডুয়েট) নেই কোনো কার্যক্রম, উদ্যোগ। এই বিষয়ে জানতে চাইলে ডুয়েটের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মো. আনোয়ারুল আবেদীন বলেন, আপাতত এ ব্যাপারে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই। তবে একবার শিক্ষার্থীদের কাছে তথ্য চাওয়া হয়েছিল। আমরা কিছু শিক্ষার্থীর তথ্য নিয়েছি এবং পাঠিয়েছি। তবে এর কোনো উত্তর মেলেনি। এ বিষয়ে বিস্তারিত আর কিছু জানি না।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদেরও তথ্য নেয়া হয়েছিল অনেক আগে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এই বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। রেজিস্ট্রেশন করা হয়নি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও। এখন কোনো ধরনের তথ্য চাওয়া হয়নি। তবে গণটিকা প্রদানের শুরুতে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের সঙ্গে কিছু শিক্ষার্থীও টিকা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও আগে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কোনো অগ্রগতি নেই। জানা যায়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশ শিক্ষার্থী টিকা পেতে রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছেন। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শতভাগ শিক্ষার্থীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি টিকা প্রদানের জন্য শিক্ষার্থীদের আবেদন করতে বলা হয়েছে। এদিকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষার্থীদের আবেদন ফরম দেয়া হয়েছে। আহ্‌ছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নেয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ-এ টিকার জন্য সকল শিক্ষার্থীর তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এছাড়াও সরকারি তিতুমীর কলেজে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই কলেজের শিক্ষার্থীদের টিকার কোনো আলোচনা কিংবা রেজিস্ট্রেশনের কোনো ব্যবস্থা এখন পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়নি। কারমাইকেল কলেজেও এখন পর্যন্ত নেয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। এদিকে শিক্ষার্থীদের জরুরি ভিত্তিতে টিকা প্রদানের কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়াও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিও ঘোষণা দিয়েছেন তাদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা দেয়া হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খুলে দিতে সোমবার মন্ত্রণালয়, ইউজিসি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে চার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়ার কথা বলা হয়। টিকা প্রদান শেষ হলেই আবাসিক হলগুলো খুলে দেয়া হবে এবং এরপর সশরীরে শিক্ষা কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হবে। এ মাসেই চীন থেকে ছয় লাখ ডোজ টিকা আসার কথা রয়েছে। এই টিকা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা প্রদানের কথা রয়েছে। ইউজিসি থেকে জানানো হয়, যোগ্য শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তালিকা চাওয়া হয়েছে। এসব শিক্ষার্থীকে টিকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে কিংবা সাধারণ টিকা কেন্দ্রে সুবিধা বুঝে টিকা দেয়া হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল মানবজমিনকে বলেন, করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিক্ষাখাত। যেটি হয়তো আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়। তবে এর যে ক্ষতি হয়ে গেছে তা অন্য কোনো খাতের সঙ্গে তুলনীয় নয়। সরকার হয়তো অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম চালু রেখেছেন, তবে সেটি ফেস টু ফেস (মুখোমুখি) শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনীয় নয়। তাই আমি মনে করি যতদ্রুত সম্ভব শিক্ষার্থীদের টিকা দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত। তাহলে শিক্ষার যে ঘাটতি তৈরি হয়েছে তা কিছুটা হলেও কাটিয়ে উঠতে পারবো আমরা। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বর্তমানে যে হতাশা ও বিষণ্নতা বিরাজ করছে তাও কেটে যাবে বলে মনে করি। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের সাবেক এই সভাপতি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী টিকা দেয়ার ক্ষেত্রে এবার শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও টিকা প্রদান করে যতদ্রুত সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া উচিত। এ বিষয়ে ইউজিসি’র সদস্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, আগামী সপ্তাহ থেকে টিকা প্রদান কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হলে ঈদুল আজহার পর আগস্টের শুরুর দিকে সব বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেয়া যাবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে আগের মতো সরাসরি পরিচালিত হবে শিক্ষা কার্যক্রম, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন। ইউজিসি’র সচিব (চলতি দায়িত্ব) ফেরদৌস জামানও একই সুরে কথা বলেন। তিনি বলেন, আগামী সপ্তাহ থেকে আবাসিক শিক্ষার্থীদের টিকা প্রদান শুরু হলে এক মাসের মধ্যে মোট ১ লাখ ১০ হাজার শিক্ষার্থীকে দ্বিতীয় ডোজ টিকা প্রদান সম্ভব হবে।

https://mzamin.com/article.php?mzamin=277100&cat=2