৬ জুন ২০২১, রবিবার, ২:৩৭

চীনের দেড় কোটি টিকা নিয়ে লেজেগোবরে অবস্থা

যথাসময়ে সরবরাহ নিয়ে সংশয়

চীন থেকে করোনার টিকা আনতে গিয়ে লেজেগোবরে অবস্থায় পড়েছে সরকার। প্রথমে ইংরেজির পরিবর্তে চীনা ভাষায় লেখা ডকুমেন্টে সই করে টিকা আমদানি প্রক্রিয়ায় অযথা বিলম্ব সৃষ্টি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এরপর উপহার হিসেবে পাওয়া টিকা থেকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে টিকা দিতে গিয়ে চীনা নাগরিকদের পরিচয়ের ক্ষেত্রে তাইওয়ান, হংকং ও মেকাও লেখায় বেজায় ক্ষুব্ধ হয়েছে দেশটি। সর্বশেষ অপ্রকাশযোগ্য চুক্তি থাকা সত্ত্বেও চীন থেকে বাণিজ্যিকভাবে বাংলাদেশে আমদানির জন্য টিকার মূল্য সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তা কর্তৃক জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেয়ায় বেকায়দায় পড়েছে চীন। কেননা শ্রীলঙ্কা, ইন্দোনেশিয়াসহ অন্যান্য দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মূল্যে সিনোফার্মের টিকা কিনতে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে। এখন এসব দেশ বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দামে চীন থেকে একই ধরনের টিকা কেনা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি দেয়া হলেও ক্ষুব্ধ চীন এর কোনো উত্তর দেয়নি। এই পরিস্থিতিতে সরকারের ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি জুন থেকে প্রতি মাসে ৫০ লাখ করে মোট দেড় কোটি সিনোফার্মের টিকার সরবরাহ পাওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।

এ ব্যাপারে ঢাকায় চীনা দূতাবাসের উপ-প্রধান হুয়ালং ইয়ান গতকাল নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছেন, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সব সময় এত বিভ্রান্তিকর তথ্য আসছে কেন, তা চিন্তা করে অবাক হচ্ছি। প্রথমত. সিনোফার্ম ও বাংলাদেশের মধ্যে আজ পর্যন্ত টিকা কেনা নিয়ে কোনো চুক্তি সই হয়নি। দ্বিতীয়ত. বাণিজ্যিক চুক্তি নিয়ে বাংলাদেশ সরকার ও সিনোফার্মের মধ্যে সমঝোতা হচ্ছে, চীন সরকারের সাথে নয়। বাংলাদেশের ভাইবোনেরা প্রয়োজনীয় টিকা যত দ্রুত সম্ভব পেয়ে যাবে বলে আমি আন্তরিকভাবে আশা করি।

অপর এক স্ট্যাটাসে ইয়ান লিখেছেন, বাংলাদেশকে উপহার হিসেবে দেয়ার চীন সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী সিনোফার্মের দ্বিতীয় চালানোর ছয় লাখ টিকা সরবরাহের জন্য আগামী ১৩ জুন প্রস্তুত থাকবে।

প্রসঙ্গত, উপহার হিসেবে দেয়া চীনের সিনোফার্মের পাঁচ লাখ টিকা গত ১২ মে বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) অনুমোদন পাওয়া এই টিকা করোনাভাইরাসের সংক্রমণের বিরুদ্ধে ৭৯ শতাংশ সুরক্ষা দিতে পারে। সিনোফার্মের টিকা ১৮ বছরের বেশি বয়সীদের দুই ডোজ করে দিতে হয়। প্রথম ব্যাচে চীনের উপহার হিসেবে দেয়া টিকা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মরত চীনের নাগরিক, সরকারি-বেসরকারি মেডিক্যাল ও ডেন্টাল কলেজের শিক্ষার্থী, নার্সিং শিক্ষার্থী এবং মেডিক্যাল টেকনোলজি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।

গত ২৭ মে মন্ত্রিসভা কমিটি সিনোফার্মের দেড় কোটি টিকা প্রতিটি ১০ ডলারে কেনার প্রস্তাবে সম্মত হয়। এর পরপরই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. শাহিদা আখতার প্রেস ব্রিফিংয়ে সিনোফার্মের টিকা কী পরিমাণে কত দামে কেনা হচ্ছে তা প্রকাশ করেন। অপ্রকাশযোগ্য চুক্তির শর্ত ভেঙ্গে টিকার দাম প্রকাশ করে দেয়ায় বিষয়টি নিয়ে তদন্তের এক পর্যায়ে ড. শাহিদা আখতারকে মন্ত্রিপরিষদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সিনোফার্মের টিকার দাম প্রকাশ করে দেয়ায় চীন বিরক্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন। তিনি বলেছেন, আমরা চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছি। তবে এ ঘটনায় আমাদের অবস্থান বেশ খানিকটা খারাপ হয়ে গেল। ভবিষ্যতে সরকার এত কম দামে চীনের কাছ থেকে টিকা কিনতে সক্ষম নাও হতে পারে। চীন অন্য দেশের কাছে যে দামে টিকা বিক্রি করে, সে দামেই এখন আমাদের কিনতে হবে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম জানান, স্বাস্থ্য অধিদফতরের ডাইরেক্টর জেনারেল অব হেলথ সার্ভিসেস (ডিজিএইচএস) ঢাকায় চীনা দূতাবাসকে একটি চিঠি দিয়ে বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেছে। আমরা বলেছি, সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে জনসমক্ষে দাম প্রকাশ করেনি। তবে কোনোভাবে তা প্রকাশিত হয়ে গেছে। আমরা তাদের চিঠি দিয়েছি, কিন্তু তার উত্তর এখনো পায়নি। অধ্যাপক খুরশিদ আলম বলেন, চীন প্রতি ডোজ টিকা শ্রীলঙ্কার কাছে ১৪ ডলার ও ইন্দোনেশিয়ার কাছে ১৭ ডলারে বিক্রি করছে। বাংলাদেশে সিনোফার্মের বিক্রয়মূল্য গণমাধ্যমে জানার পর এ সব দেশ চীনকে কম দামে টিকা বিক্রি করতে চাপ দিচ্ছে। চীন এ নিয়ে আমাদের ওপর বেশ বিরক্ত হয়েছে।
সম্প্রতি ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পেয়েছে করোনা প্রতিরোধী চীনের অপর টিকা সিনোভ্যাক। সিনোভ্যাক গত বছর বাংলাদেশে বিনামূল্যে তৃতীয় দফা ট্রায়াল করার জন্য সরকারের অনুমোদন চেয়েছিল। কিন্তু এটা নিয়ে কালবিলম্ব করায় একপর্যায়ে কোম্পানিটি ক্ষুব্ধ হয়ে বিনামূল্যে ট্রায়ালের প্রস্তাব ফিরিয়ে নিয়ে এ জন্য মূল্য দাবি করে বসে। কিন্তু সরকার মূল্য দিয়ে টিকার ট্রায়ালে রাজি হয়নি। ট্রায়ালে অংশ নিলে বাংলাদেশ অগ্রাধিকারভিত্তিতে এই টিকা পেত। ডব্লিউএইচওর অনুমোদন পাওয়ায় চীনের সিনোফার্ম এবং সিনোভ্যাকের চাহিদা বিশ্বব্যাপী অনেক বেড়ে গেছে। এ ছাড়া টিকা দু’টি চীনের অভ্যন্তরেও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

কেবল তা-ই নয়, স্পুটনিক-ভি টিকা কেনার ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রক্রিয়াগত জটিলতার বিরক্ত হয়েছে রাশিয়া। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় প্রথম এক কোটি টিকার চাহিদার কথা জানালেও পরে ৬০ লাখের কথা বলেছে। এখন আবার এক কোটির কথাই শোনা যাচ্ছে। ডব্লিউএইচওর অনুমোদন না পেলেও স্পুটনিক-ভি করোনভাইরাসের বিরুদ্ধে ৯৭ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দিতে পারে বলে রাশিয়া দাবি করেছে। বিষয়টি তথ্য-উপাত্ত দিয়ে ডব্লিউএইচওতে প্রতিষ্ঠিত হলে তা যুক্তরাষ্ট্রের যেকোনো টিকার চেয়ে বেশি সুরক্ষা দিতে সক্ষম বলে প্রমাণিত হবে।
টিকা কেনার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রক্রিয়াগত জটিলতায় চীন ও রাশিয়ার বিরক্তির কথা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন দেশ দু’টিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতরা। রাষ্ট্রদূতদের এ সংক্রান্ত বার্তা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. আব্দুল মোমেন।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/586526