৬ জুন ২০২১, রবিবার, ২:৩৬

দেশে বজ্রপাতের ভয়ঙ্কর রূপ প্রতিকারের ব্যবস্থাই নেই

গতকাল শনিবার একদিকে পালিত হচ্ছিল বিশ্ব পরিবেশ দিবস। অন্যদিকে শরীয়তপুর, মাদারীপুর এবং ঢাকায় বজ্রপাতে সাতজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিহতরা হলেন, শরিয়তপুরের মূলনা ইউনিয়নের জয়সাগর গ্রামের ফেলু খলিফার ছেলে তাইজুল ইসলাম খলিফা (৬২), পালেরচর ইউনিয়নের ডা. মফিজুল ইসলাম রাড়ী কান্দি গ্রামের হুজুর পেয়াদার ছেলে আব্দুল মালেক পেয়াদা (৪০), মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার সন্ন্যাসিরচর ইউনিয়নের পশ্চিম সন্ন্যাসীরচর গ্রামের সোলেম বেপারীর ছেলে ইব্রাহিম বেপারী (৫০), ঢাকার ধামরাই উপজেলার কুল্লা ইউনিয়নের বড় কুশুরিয়া এলাকার বাবু ব্যাপারীর ছেলে আব্দুল খালেক (৪৫)। এছাড়া রাজধানীর মালিবাগে মারা গেছে ৩জন। রাজধানীতে বজ্রপাতে দুই শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। মালিবাগের চৌধুরীপাড়ার সোনা মিয়া গলি এলাকায় শনিবার দুপুরে এ ঘটনা ঘটে।নিহতরা হলেন- আবুল হোসেন (৬৫), সাবিয়া পাখি (১০) ও জুমা (১২)।

বজ্রপাতে গত মাসেই প্রায় অর্ধশত মানুষ মারা যায়। বজ্রপাতে এতো মানুষের মৃত্যু ঘটলেও তা প্রতিকারের কোনো ব্যবস্থাই নেই। এমনকি সরকারের হুঁশও হচ্ছেনা। বজ্রপাতের এই সময়ে কিছু দিক নির্দেশনামূলক বক্তব্য দিয়েই সরকার তাদের দায় শেষ করছে। বছরে দেড়শ’র মতো লোকের মৃত্যুর খবর বিচ্ছিন্নভাবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা ‘পাঁচ শতাধিক’ বলে আবহাওয়াসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলে থাকে। বজ্রপাত-ভয়াবহতার এমন প্রেক্ষাপটে টেকসই দৃষ্টিকোণ থেকে শিক্ষাসচেতনতা, বনায়ন, নির্মাণশিল্প, বিদ্যুৎ ও টেলিকম অবকাঠামোর সমন্বিত ও ঝুঁকিপূর্ণ দিকগুলোর ওপর নজর দেওয়ার সমন্বিত প্রয়াস জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। আবহওয়াবিদরা বলেন, বেশি গাছপালা থাকলে বজ্র গাছের মধ্যে পড়লে জানমালে ক্ষতি কম হতো। বিষয়টি যে পরিবেশ বিপর্যয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

গবেষণা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বজ্রপাত আরও ঘন ঘন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বজ্রপাত আরও ঘনঘন হবে। এমনকি বায়ুদূষণেও বজ্রপাত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোর ভূমির উষ্ণতা পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অন্তত ৬ থেকে ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি, বাতাসের উষ্ণতাও তেমনই বেশি। নিরন্তর জ্যামে জ্বালানির দহন, অত্যধিক গরমের শহরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের অতি ব্যবহার, শক্তির যাবতীয় রূপান্তর, এনার্জি কনভারশন এসব মিলে উষ্ণতা ও দূষণ দুটোই বাড়াচ্ছে।

বজ্রপাত হবার কারণ হিসেবে জানা যায়, বাংলাদেশের দক্ষিণ থেকে আসা গরম আর উত্তরের ঠান্ডা বাতাসে সৃষ্ট অস্থিতিশীল আবহাওয়ায় তৈরি হয় বজ্র মেঘের। এ রকম একটি মেঘের সঙ্গে আরেকটি মেঘের ঘর্ষণে হয় বজ্রপাত। এ সময় উচ্চ ভোল্টের বৈদ্যুতিক তরঙ্গ যখন মাটিতে নেমে আসে, তখন সবচেয়ে কাছে যা পায় তাতেই আঘাত করে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে বজ্রপাতের মূল কারণ ভৌগলিক অবস্থান। একদিকে বঙ্গোপসাগর, এরপরই ভারত মহাসাগর। সেখান থেকে আসছে গরম আর আর্দ্র বাতাস। আবার উত্তরে রয়েছে পাহাড়ি এলাকা। কিছু দূরেই হিমালয় পর্বত। যেখান থেকে ঠান্ডা বাতাস বয়ে আসে। এই দুই জায়গা থেকে আসা বাতাসের সংমিশ্রণ বজ্রপাতের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করে। গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রা ১ ডিগ্রি বাড়লে বজ্রপাতের সম্ভাবনা ৫০ ভাগ বেড়ে যায়। গত কয়েক দশকে বড় বড় গাছ কেটে ফেলাও তার একটি কারণ। উঁচু গাছপালা বজ্রনিরোধক হিসেবেও কাজ করে। খোলা স্থানে মানুষের কাজ করা এবং বজ্রপাতের বিষয়ে অসচেতনতাও বজ্রপাতে প্রাণহানি বৃদ্ধির জন্য দায়ী। বাংলাদেশে বজ্রপাতের কারণগুলোর মধ্যে আপাতদৃষ্টিতে প্রথম ও প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি। যদিও অনেক জলবায়ু বিজ্ঞানী এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেন।

আবহাওয়াবিদ উইং কমান্ডার মো. মোমেনুল ইসলাম (অব.) বলেন, এপ্রিল থেকে জুন এর মধ্যেই বেশি বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে। বনাঞ্চল ধ্বংস হওয়ার সঙ্গে বজ্রপাতের সম্পর্ক রয়েছে। বৈশ্বিক উষ্ণায়ন হলে বায়ুমণ্ডল বেশি জলীয়বাষ্প ধারণ করতে পারে, তাই বেশি বজ্রঝড় তৈরি হতে পারে। বনায়ন কমে গেলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পায়। কারণ হিসেবে বলা যায়, গ্রিন হাউস কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে গাছপালার খাদ্য উৎপাদনে ব্যবহার করে। বর্তমান সময়ে বজ্রপাত বেড়েছে উল্লেখ করে এই বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, ইদানীং বজ্রপাত অনেক লোক মারা যাচ্ছে। আমরা সাধারণত দেখতে পাই যে তাপমাত্রা বেড়েছে। বজ্রপাত বাড়ার ক্ষেত্রে বলা যায় যে, আমাদের ইকনোমিক অ্যাক্টিভিটি বেড়েছে। এছাড়াও বলা যায়, বজ্রপাতের যে তীব্রতা ছিল তাও কিছুটা বেড়েছে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে যেখানে বেশি লোক বজ্রপাতে মারা যায়, তাদের কার্যক্রম বৃদ্ধি পাওয়াও এর একটি কারণ হতে পারে। আর আগের চেয়ে বজ্রপাত রিপোর্টিং সিস্টেমটাও বেড়েছে’ যোগ করেন তিনি।

বজ্রনিরোধক ব্যবস্থাপনার একটা বিকল্প সমাধান হতে পারে প্রতিটি মোবাইল টাওয়ারের সঙ্গে অন্তত ৪৫ থেকে ৫০ মিটার উচ্চতায় থাকা বজ্রনিরোধক (লাইটনিং এরেস্টার) বসানোর বাধ্যবাধকতা। দেশে টেলিকমের টাওয়ার বসানোর পরিবেশবান্ধব টেকসই পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। বাড়ির ছাদে কিংবা উঁচু দালানের সাইড ওয়ালে বড় বড় অ্যানটেনা মাউন্টেড টাওয়ার করার কারণে এগুলো বজ্রপাত আকর্ষণ করে, ফলে বাড়িগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। সাধারণত, এসব টাওয়ারের নিজস্ব আর্থিং ব্যবস্থা থাকে (ছোট লাইটনিং অ্যারেস্টার), যা পার্শ্ববর্তী এলাকার বজ্রনিরোধনে কাজে আসে না। বরং ঘনঘন বজ্রপাতে টাওয়ারসংযুক্ত বাড়ির বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিই নষ্ট হচ্ছে। মূলত, উপযুক্ত ভবনের অভাবে কিংবা উচ্চ ক্ষমতার জন্য গ্রিনফিল্ড টেলিকম টাওয়ার হয়, বাদবাকি টাওয়ার যেনতেনভাবে বসতবাড়ির ছাদে বসানো হয়। এই বাড়িগুলো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং গাইডলাইন ও নকশা দিয়ে বানানো নয় বলে বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তরঙ্গ দূষণরোধে বিটিআরসিকে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবান্ধব তড়িৎ-চুম্বকীয় তরঙ্গ সঞ্চালন ও রেডিও অ্যানটেনা স্থাপনের সমন্বিত পরিবেশবান্ধব নীতিমালা তৈরি করতে হবে। যত্রতত্র বাড়ি ছাদে, উঁচু বাড়ির সাইড ওয়ালে টেলিকমের অ্যানটেনা মাউন্ট করে একদিকে নাগরিকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়াচ্ছে, অন্যদিকে এগুলো বজ্রপাতেও ঝুঁকিও তৈরি করছে। একইভাবে গত দশকে নগর বনায়ন একেবারেই অবহেলিত থেকেছে। দুর্বৃত্তরা শুধু গাছই কেটেছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ওসমানী উদ্যান, বনানী, গুলশান ও বিমানবন্দর সড়কের উন্নয়নের নামে নির্বিচার বৃক্ষনিধন হয়েছে। সড়কের পার্শ্ব ও সড়কদ্বীপের বনায়ন যা ছিল, তাও ধীরে ধীরে কমে আসছে। বজ্রঝুঁকি মাথায় রেখে এলাকাভিত্তিক নতুন বনায়ন উদ্যোগ দরকার, যেখানে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর একটি সুউচ্চ গাছ রাখার পরিকল্পনা হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্ট স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিপার্টমেন্ট অব জিওগ্রাফির অধ্যাপক ড. টমাস ডব্লিউ স্মিডলিনের ‘রিস্ক ফ্যাক্টরস অ্যান্ড সোশ্যাল ভালনারেবিলিটি’ শীর্ষক গবেষণা মতে, বাংলাদেশে বছরে ৮০ থেকে ১২০ দিন বজ্রপাত হয়। এর মধ্যে প্রতিবছর মার্চ থেকে মে পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রতি বর্গকিলোমিটার এলাকায় ৪০টি বজ্রপাত হয়। উপরন্তু এ সময়ে কালবৈশাখী হয়। গবেষণায় মে মাস পর্যন্দ ধরা হলেও গত কয়েকবছর ধরে জুন-জুলাই মাসেও বজ্রপাতে মানুষ মারা যাচ্ছে।

বজ্রপাত নিরোধক করতে বৃক্ষায়ন করার উপর জোর দিয়ে আবহাওয়া বিদরা বলছেন,আমাদের গ্রামগুলোয় উঁচু গাছ কমে যাচ্ছে। মধ্যবয়স থেকে একটি গাছের মোটাসোটা ও লম্বা হতে সময় বেশি লাগে বলে ব্যবসায়িক বনায়ন মডেলে দ্রুত বাড়ন্ত মাঝারি গাছ কেটে ফেলা হয়। নির্দিষ্ট দূরত্বে উঁচু গাছ রাখার মতো সচেতনতা ও পরিবেশবিষয়ক জ্ঞান লোপ পেয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থা, সমাজব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার পরিবেশ সংরক্ষণ ও সুরক্ষার প্রাকৃতিক জ্ঞান বিস্তারে নিদারুণ অযোগ্যতা দেখাচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা পরিবেশ সংরক্ষণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার প্রাকৃতিক জ্ঞানে পশ্চাৎপদ, যাদের সঙ্গে টেকসই পরিবেশবিষয়ক জ্ঞানের দূরতম সম্পর্ক নেই। তারাই রাতের আঁধারে সড়ক ও সামাজিক বনায়নের উঁচু–লম্বা গাছ চুরি করে বিক্রি করেন। গৃহায়ণ ও নৌকার ধরন পরিবর্তন হয়ে যাওয়ায় তালগাছের চাহিদাও কমেছে।

সূত্র মতে, প্রতিকার হিসেবে গত বছর সরকার সারা দেশে ১০ লাখ তালগাছ লাগানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। পরে শোনা গিয়েছে, তালগাছ লাগানো হয়নি, কয়েক লাখ তালের আঁটি রোপণ করে দায়িত্ব সারা হয়েছে। দুর্নীতিপ্রবণ বাস্তবায়নের কালে গাছ দৃশ্যমান করা বেশ ঝামেলার বলে আঁটিতেই লুটের খোয়াব মিটেছে সম্ভবত! গাছগুলো সত্যি সত্যি রক্ষণাবেক্ষণ করে বড় করলেও প্রশাসনের বজ্রনিরোধন পরিকল্পনা কাজে আসতে আরও ১৫ থেকে ২০ বছর লাগতে পারে, যদি গাছগুলো অসময়ে চুরিতে না পড়ে! তথাপি এই দীর্ঘ মধ্যবর্তী সময়ে বিকল্প পরিকল্পনা চাই। গ্রাম ও শহরের আবাসিক এলাকাগুলোর প্রতি ৫০ বর্গমিটার এলাকায় অন্তত একটি করে ৪০ মিটার বা তার কাছাকাছি উচ্চতার গাছ থাকা চাই। বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ, জলাশয় কিংবা হাওরে কাজ করা কৃষক-জেলের নিরাপত্তা সতর্কতা বিষয়েও ভাবতে হবে। কাজগুলো বন ও পরিবেশ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ যৌথভাবে করতে পারে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের সামাজিক বনায়ন টিকিয়ে রেখেছে ব্যক্তি খাতের নার্সারিকেন্দ্রিক চারা উৎপাদনব্যবস্থা। যেহেতু আমাদের নার্সারিতে বীজ থেকে চারা তৈরির প্রক্রিয়া খুবই বাণিজ্যিক এবং স্থানসংকটে আবর্তিত, তাই এখানে চারা গাছে প্রধান মূল থাকল কি না, এটা একেবারেই বিবেচ্য নয়। নিতান্তই সামান্য মাটি ও অবলম্বনের খুঁটিতে গাছ বড় করে পরিবহন ও বিক্রি করা হয়। এ কারণে প্রধান মূলহীন গাছ একটু বড় হলে সহজেই ঝড়ে উপড়ে পড়ে। মানুষ কিংবা স্থাপনা বাঁচিয়ে বজ্রের আধানকে নিরপেক্ষ (চার্জ নিউট্রালিটি) করতে দরকার অনেক উঁচু গাছ। গতানুগতিক চারায়নের বিপরীতে নার্সারির চারা উৎপাদকে প্রধান মূল রেখেই টেকসই করতে বন বিভাগের বোধোদয় ও কারিগরি সহায়তা একান্ত প্রয়োজন। নির্দিষ্ট দূরত্বে রোপিত বজ্রপাত ব্যবস্থাপনার গাছগুলোকে প্রধান মূলসহ উৎপাদন এবং রোপণ–পরবর্তী বিশেষ সংরক্ষণের ব্যবস্থাটা করা হোক। তারা আরও বলছেন, শহরে উঁচু গাছ খুবই কম। তবে শহরে বজ্রনিরোধ ব্যবস্থাপনা খুবই সহজ। শহরে উঁচু ভবন আছে, কিন্তু ভবনের ওপরে বজ্রনিরোধক টাওয়ার রাখার সমন্বিত ও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা নেই। শহরের উঁচু দালানে বজ্রনিরোধক লাইটনিং সার্জ এরেস্টার টাওয়ার বসানো বিশ্বের বড় বড় শহরে বেশ প্রচলিত। একটি নির্দিষ্ট দূরত্বে উঁচু শহুরে দালানে বজ্রনিরোধক টাওয়ার স্থাপন করে বজ্রপাতের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়, এসব টাওয়ারে অনেক দীর্ঘ উল্লম্ব উচ্চতার লাইটনিং অ্যারেস্টার থাকবে, যা বজ্রপাত কিংবা বৈদ্যুতিক আধানকে নিরপেক্ষ বা নিউট্রালাইজ করবে। সাধারণত শহুরে ভবনে ইচ্ছামাফিক বৈদ্যুতিক আর্থিং ব্যবস্থা থাকে, নকশামাফিক টেকসই আর্থিং থাকে না বলে বজ্রপাতে ওই সব ভবনে আগুন ধরতে পারে এবং না ধরলেও বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি বিকল হয়।

আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, কালবৈশাখীসহ বজ্রপাতের স্থানভিত্তিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস বিষয়ে মানুষ সচেতন নয়। বর্তমানে কোন এলাকায় কোন সময়ে ঠিক কতটি সম্ভাব্য বজ্রপাত হবে, তা সহজেই আবহাওয়াবিষয়ক অনলাইন সফটওয়্যারের মাধ্যমে জানা যায়। বজ্রপাতের পূর্বাভাস নিখুঁতভাবে মোবাইল সেবাদাতা কোম্পানির ‘লোকেশন এরিয়া’ তথ্যশালা অনুসারে মোবাইল খুদে বার্তায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা খুবই সহজ কাজ। অর্থাৎ দ্বিতীয়–তৃতীয় প্রজন্মের ‘ল্যাক কোড’ ও চতুর্থ প্রজন্মের ‘ট্যাক কোড’–এর সব গ্রাহককে স্থানভিত্তিক পূর্বাভাস ও সতর্কতা খুদে বার্তায় পাঠানোর ব্যবস্থা হবে একটা টেকসই কাজ। জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র ঝুঁকির মুখে আবহাওয়া গবেষণা অতি প্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে। জানা গেছে, দুঃখজনকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র আবহাওয়া ও জলবায়ুবিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান সার্ক আবহাওয়া গবেষণা কেন্দ্র (শেরেবাংলা নগর, ঢাকা) বন্ধ করে এর গবেষক ও বিজ্ঞানীদের চাকরিচ্যুত করার ঘটনা ঘটেছে।

সূত্র মতে, শহুরে আবাসিক এলাকাসহ দেশের বিতরণ লাইনের সিংহভাগ এখনো ওভারহেড, যা বজ্রপাতের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। এসব বিতরণ লাইনের আর্থিং ব্যবস্থাপনা মান প্রশ্নাতীত নয়, কেননা উচ্চ লোডের কারণে এমনিতেই সময়ে–সময়ে ট্রান্সফরমার, এমনকি লাইনগুলোয় স্পার্কিং দেখা যায়। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের জাতীয় গ্রিড লাইনে উচ্চমান বজ্রনিরোধক ব্যবস্থা থাকার কথা, তথাপি সেগুলো ডিজাস্টার ক্যাপাবল কি না, তা পুনর্মূল্যায়ন করা দরকার। কেননা, বজ্রপাতের হার সময়ের সঙ্গে বেড়েছে। নতুবা অবকাঠামোগত বড় ক্ষতি হওয়ার সুযোগও থেকে যাচ্ছে। বজ্রপাতের সময় এবং সম্ভাব্য সময়ে কী কী কাজ করণীয় এবং কী কী বর্জনীয়, তা নিয়ে প্রতিষ্ঠানিক স্কুলশিক্ষা কিংবা অপ্রতিষ্ঠানিক বয়স্ক শিক্ষায় আনা যায়। আবহাওয়া অফিস থেকে বজ্রপাতবিষয়ক সতর্কতা নিয়ে তৈরি একটা পিকচার বুলেটিন ফেসবুকে থাকলেও সাধারণ নাগরিক পর্যায়ে পৌঁছানোর ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেই।

সূত্র মতে, গেল মে মাসেই বজ্রপাতে অর্ধশত মানুষের অকাল মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে গত ২০ মে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলায় মাঠে ধান কাটার সময় বজ্রপাতে ছয়জন কৃষক প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়া চাঁপাইনবাবগঞ্জে বজ্রপাতে প্রাণ হারিয়েছে এক শিশুসহ তিনজন। গত ১৮ মে বজ্রপাতে ১৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে নেত্রকোনা জেলার চার উপজেলায় বজ্রপাতের ঘটনায় ৮ জন, ফরিদপুরে ৪ জন, মানিকগঞ্জে ২ জন, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে ১ জন করে মারা যান। ১১ মে রাজশাহী বিভাগে বজ্রপাতে পাঁচ কৃষকসহ ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। ১০ মে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বজ্রপাতে একদিনে ৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আর ৪ মে সকাল থেকে বিকেলের মধ্যে বজ্রপাতে একদিনে ছয়জনের মৃত্যু হয়েছে। বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কিন্তু কম শঙ্কার নয়। প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন হওয়ার পরও এমন মৃত্যু কাম্য হতে পারে না।
দক্ষিণ এশিয়ায় বজ্রপাতপ্রবণ দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। বিগত বছরগুলোতে দেশে বজ্রপাতের তীব্রতা বেড়েছে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলে বজ্রপাতে বেশি মানুষ মারা যাচ্ছেন। ২০১৩-২০ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে ১ হাজার ৮৭৮ জন মারা গেছেন। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ২০১০ থেকে ২০১৯ এই এক দশকে দেশে বজ্রপাতে মোট মৃতের সংখ্যা ২ হাজার ৮১। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে ২০১৮ সালে। ওই বছর বজ্রপাতে মারা গেছে ৩৫৯ জন। এর আগের বছর মারা যায় ৩০১ জন, যা গত এক দশকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ২০১৬ সালে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা ছিল ২০৫। এ ছাড়া ২০১৫ সালে ১৬০, ২০১৪ সালে ১৭০, ২০১৩ সালে ১৮৫, ২০১২ সালে ২০১, ২০১১ সালে ১৭৯ ও ২০১০ সালে ১২৩ জনের মৃত্যু ঘটে বজ্রপাতে।

বজ্রপাতের সময় করণীয়, আহতদের চিকিৎসা এবং প্রাণহানি কমানোর উপায় নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এম এ ফয়েজ বলেন, বজ্রপাত একটি কমিউনিটি স্বাস্থ্য সমস্যা। বজ্রপাতে শরীরে বৈদ্যুতিক শক হয়। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয় হার্ট এবং ব্রেইন। অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং অনেকেই অবশ হয়ে যেতে পারে। শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ হয়ে যেতে পারে প্যারালাইজড। যারা মারা যান, তার চেয়ে কয়েকগুণ জটিলতায় ভোগেনে বেঁচে যাওয়ারা। ডা. এম এ ফায়েজ বলেন, কেউ যখন বজ্রপাতে আক্রান্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে, তাকে বাঁচানোর জন্য প্রাথমিক কিছু বিষয় করা যেতে পারে। যদি শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়, তাকে সিপিআর চালিয়ে রাখতে হবে। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। তিনি বলেন, বজ্রপাত প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়। এ অবস্থায় কী করা যাবে আর যাবে না তা গুরুত্বপূর্ণ। মাঠে-ঘাটে, নদীতে-পানিতে, বাইরে যারা কাজ করেন, বিশেষ করে যারা গ্রামে কৃষিকাজ করেন, তারা বজ্রপাতে আক্রান্ত হতে পারেন। তাই নিরাপদ স্থানে অবস্থান করতে হবে।

আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু গবেষকদের মতে, বাংলাদেশে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার কমাতে সরকারের পাশাপাশি সচেতন হতে হবে জনগণকেও। ঝড়-বৃষ্টির সময় বাইরে যাওয়া থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি বজ্রপাত প্রতিরোধের নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। আর বেশি করে তালগাছসহ বিভিন্ন গাছপালা লাগাতে হবে। তাহলে অনেকাংশে কমে আসবে বজ্রপাতে মৃত্যু।

https://dailysangram.com/post/454602