শাহ্ আব্দুল হান্নান
৬ জুন ২০২১, রবিবার, ২:৩৫

অবলোকন

ছায়াটি সরে গেল

শাহ আব্দুল হান্নানের ব্যাপারে শুনি কলেজের পর্ব শেষ করে যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরু করি। তখন চট্টগ্রাম শহরের এক প্রান্ত, খতিবের হাটে থাকি। দুপুরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে আসি আর বিকেল বেলা আমার বড় ভাইতুল্য ডা: আবদুল মান্নানের চেম্বারে গল্প করতে যাই। এই আবদুল মান্নান এক সময় ছিলেন চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ছাত্রনেতা। কর্মজীবনে কিছু ব্যবসাবাণিজ্য করার চেষ্টা করে খানিকটা ব্যর্থ হয়ে হোমিও ডিগ্রি নিয়ে ডাক্তারি শুরু করেন। মান্নান ভাইয়ের ছিল অভূতপূর্ব এক সম্মোহনী শক্তি। ডাক্তার হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন অল্প দিনের মধ্যেই। শাহ আব্দুল হান্নান চট্টগ্রামের ডেপুটি কালেক্টর থাকাকালে ‘শাহিন ফৌজ’ নামের একটি শিশু সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন। সেই সুবাদে মান্নান ভাইয়ের সাথে তার ছিল বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ যোগাযোগ। আর মান্নান ভাইয়ের কাছে শাহ আব্দুল হান্নানের গল্প শুনে আমার মনের মধ্যে এই ব্যক্তি সম্পর্কে বিশেষ এক রকম সত্যনিষ্ঠ বড় মাপের সরকারি কর্মকর্তার ভাবমর্যাদা তৈরি হয়। এ সময় আরেক তরুণের কথা মান্নান ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম যিনি শাহিন ফৌজের সাথে যুক্ত ছিলেন আর চট্টগ্রাম কলেজের উচ্চমাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন। তার বাবা ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজের ভাইস প্রিন্সিপ্যাল এবং জনপ্রিয় শিক্ষক। যতদূর মনে পড়ে তার নাম ছিল ফওজুল কবির খান।

এরপর ১৯৮৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের ছাত্র থাকাকালে কিছুটা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঢাকায় আসি। একটি বিশেষ প্রকাশনার কিছু কাজের দায়িত্ব আসে আমার ওপর। এই কাজের অংশ হিসেবে বন্ধু সুুহৃদ আবু জাফর মোহাম্মদ ওবায়েদ উল্লাহর সাথে সৌদি দূতাবাসে শাহ আবদুল হালিমের সাথে দেখা করতে যাই। হালিম ভাই তখন সৌদি দূতাবাসের অনেক উচ্চ পদে কাজ করতেন, কিন্তু আমার কাছে তখন বড় আকর্ষণের বিষয় ছিল আমি শাহ আব্দুল হান্নানের ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। সে দিন সৌদি দূতাবাসের ভেতরের একটি লনে হালিম ভাইয়ের সাথে আমাদের অনেক কথা হলো। তার ব্যক্তিত্বে আপ্লুত হই, হান্নান পরিবারের প্রতি সম্মান আরো বেড়ে যায়।

পরে সেই ওবায়েদ ভাইয়ের সাথেই একদিন শাহ আব্দুল হান্নানের কাকরাইলের সরকারি বাসায় সাক্ষাৎ করতে যাই। তখন সম্ভবত শাহ আব্দুল হান্নান ঢাকার কাস্টমস কালেকটরের পাশাপাশি কাস্টমস ইন্টেলিজেন্সের দায়িত্বও পালন করছিলেন। একেবারে সাদামাটা জৌলুসহীন তার সুপরিসর বাড়িতে পৌঁছার একটু পরেই আসেন জনাব হান্নান। চা বিস্কিটের সাথে সাথে যে কাজে আমরা গিয়েছিলাম তার জন্য সুনির্দিষ্ট পরামর্শ দেন। তার কথায় ছিল অন্য রকম এক স্নেহ, দরদ। এর কিছু দিন পর, তখন ওবায়েদ ভাই শিশু কিশোর সংগঠন ফুলকুঁড়ি আসরের প্রধান পরিচালক আর আমি মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার পর স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসি। এ সময় ওবায়েদ ভাই, আমি ও ডা: বুলবুল সারওয়ার ‘অঙ্গীকার’ নামে একটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করি। কবি আল মাহমুদ ছিলেন এই পত্রিকার উপদেষ্টা। আমরা পত্রিকাটিকে এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে পরামর্শের জন্য আর একবার বেইলি রোডের কাস্টমস ইন্টেলিজেন্স অফিসে শাহ হান্নানের সাথে দেখা করতে যাই। নানা ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি বেশ কিছু সময় দেন এবং কিভাবে সামনে এগুতে হবে তা নিয়ে পরামর্র্শ দিলেন।

ঢাকায় দুয়েকটি ম্যাগাজিনে কাজ করার পর ১৯৮৫ সালে একটি দৈনিকে পূর্ণকালীন সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেই। বছর খানেক সহসম্পাদক হিসেবে কাজ করার পর রিপোর্টিংয়ে বদলি হলে আমার কর্মক্ষেত্র হয় বহির্মুখী। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন ব্যুরোর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করার পর আবার শাহ আব্দুল হান্নান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য কাস্টমস পদে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সরকারের রাজস্ব আহরণে নতুন শুল্কব্যবস্থা প্রবর্তনের ব্যাপারে গঠিত, ভ্যাট সেলের প্রধানের দায়িত্ব আসে তার ওপর। নতুন এই কর ব্যবস্থা নিয়ে বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রস্তুতিমূলক কর্মকাণ্ডে
কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হয়ে পড়েন তিনি।

এ সময় পর্যন্ত আমার পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামে অর্থনৈতিক বিট কাভার করতেন অগ্রজ সাংবাদিক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু। মঞ্জু ভাই বিশেষ সংবাদদাতা হওয়ার পর বাজেট কাভার করার মতো বড় বড় ইভেন্ট ছাড়া অন্যান্য দায়িত্ব জুনিয়রদের ওপর অর্পিত হয়। এর মধ্যে চিফ রিপোর্টার বাবর ভাই দৈনন্দিন অর্থনৈতিক বিট কাভার করার দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করেন। এ সময় শুনি শাহ আব্দুল হান্নান জাতীয় রাজস্ব বোর্র্ডের চেয়ারম্যান হতে পারেন। কিন্তু সিনিয়রিটি নির্ধারণে সিএসপি কর্মকর্তাদের এক বিশেষ ব্যাখ্যার কারণে সেবার তাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয়নি। ঢাকা কলেজের অধ্যাপনা ছেড়ে শাহ আব্দুল হান্নান ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান ফিন্যান্স সার্ভিস ক্যাডারে যোগদান করেন। সিএসপি অফিসাররা ব্যাখ্যা দেন যে, পাকিস্তানের অন্যান্য সেন্ট্রাল সার্ভিসের তুলনায় সিএসপি অফিসাররা দুই বছর সিনিয়র হিসেবে গণ্য হবেন এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সদস্য পদটি অতিরিক্ত সচিবের সমমর্যাদার হলেও আনুষ্ঠানিকভাবে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে সিনিয়র সার্ভিস পুলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে সচিব পদে দায়িত্ব লাভ করতে বা পদোন্নতি পেতে হবে।

ব্যাখ্যার এই টানাপড়েনে শাহ হান্নানের জুনিয়র একজন সিএসপি কর্মকর্তা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হলে তাকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর পদে বদলি করা হয়। এর মধ্যে পত্রিকায় অর্থনৈতিক বিটের মূল কাজটি আমার ওপর অর্পিত হলো আর সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং চেম্বার ও অ্যাসোসিয়েশনগুলো হয় আমার কাজের মূল ক্ষেত্র। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার মূল বিষয় অর্থনীতি ছিল না; ফলে অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলোর প্রায়োগিক ধারণা আমার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এক্ষেত্রে মঞ্জু ভাইয়ের সহযোগিতা বেশ কাজে লাগত। বড়সড় বিষয়গুলো বোঝার জন্য এর সাথে যুক্ত বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিদের শরণাপন্ন হতাম। তখন বাংলাদেশ ব্যাংকে বিশ্ব ব্যাংকের সহযোগিতায় ব্যাংক ও আর্থিক খাতে সংস্কারের একটি প্রকল্প চলমান ছিল। ফরেস্ট এম কুকসন বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পের কনসালটেন্ট ছিলেন আর এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত ডেপুটি গভর্নর ছিলেন শাহ আব্দুল হান্নান। এর আগে এরশাদ সরকারের সময় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের কালচার চরম এক অবস্থায় চলে গিয়েছিল। বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের চাপ ছাড়াও অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা আনার জন্য তদানীন্তন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান বিশেষভাবে এই প্রকল্পের বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছিলেন।

এই সময়টাতে বাংলাদেশের ব্যাংক এবং আর্থিক ব্যবস্থা কিভাবে কাজ করে তার খুঁটিনাটি বিষয়গুলো শাহ আব্দুল হান্নান একজন ছাত্রের মতো করে বুঝিয়ে দিতেন। অর্থনীতির অভ্যন্তরীণ কাঠামো এবং এর আন্তঃসম্পর্কের বিষয় তার কাছ থেকে যত সহজভাবে বুঝতে পেরেছি, এরপর সচিব পর্যায়ের অনেকের সাথে হৃদ্যতা তৈরি হয়েছে কিন্তু এরকমটি আর কাউকে পাইনি। সম্ভবত একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের দ্রষ্টা, কাজের ব্যাপারে নিষ্ঠা এবং শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করার প্রভাব তার কর্মদক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংকে ডেপুটি গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হিসেবে বদলি হন শাহ হান্নান। সম্ভবত ফজলুর রহমান পটল ছিলেন এই মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী। প্রতিমন্ত্রী ফজলুর রহমান যথেষ্ট সম্মান এবং গুরুত্ব দিতেন তাকে। এখান থেকে শাহ হান্নান বদলি হয়ে যান অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগের সচিব হিসেবে। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে যে কাজ তিনি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে করেছিলেন, সেটি আরো বড় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে দেখার দায়িত্ব অর্পিত হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ে। তত দিনে সিনিয়র অর্থনৈতিক রিপোর্টার হিসেবে আমার কাজের ব্যাপ্তি আর গভীরতাও বৃদ্ধি পায়। ব্যাংকিং বিভাগের সচিব হিসেবে শাহ হান্নানের ব্যস্ততা অনেক বৃদ্ধি পায়। ফলে আগের মতো প্রয়োজন হলেই সাক্ষাৎ করাটা আর হয়ে উঠত না। ফোন করে অথবা পিএসের মাধ্যমে সময় নিয়ে কথা বলতাম। তখন তার পিএস ছিলেন ১৯৮৫ ব্যাচের মেধাবী কর্মকর্তা সিরাজ ভাই। ব্যাংকিং বিভাগ থেকে শাহ আব্দুল হান্নানকে তার পুরনো কর্মক্ষেত্র জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব হিসেবে বদলি করা হয়। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন শাহ এএমএস কিবরিয়া। আমরা অর্থনৈতিক সাংবাদিক হিসেবে তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। তার মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার ধরনটি সাইফুর রহমানের মতো ছিল না। তবে তিনি অসততা এবং চাপের কাছে নতি স্বীকার না করার ব্যাপারে বেশ সাহসী ছিলেন। সরকারি দলের সংশ্লিষ্টতার চেয়েও মেধাকে বেশি মূল্য দিতেন। সম্ভবত এই কারণেই তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের বেছে নেয়ার চেষ্টা করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রীকে সেভাবে তিনি কনভিন্স করতে পেরেছেন। এভাবেই হয়তো শাহ আব্দুল হান্নান জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে নিযুক্ত হয়েছেন এবং স্বাভাবিক অবসরের পরে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও পেয়েছেন। অনেকে অবশ্য মনে করতেন, শাহ আব্দুল হান্নানের মামা শামসুল হক গোলাপের আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতা ও ৫ বারের এমপি হওয়া এবং তদানীন্তন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ার কারণেই এটি হয়েছে। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের একই সময়ের অন্যান্য নিয়োগে সেটি মনে হয়নি।

১৯৯৮ সালে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় শাহ আব্দুল হান্নান তার আমলা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটান। তখনো তার চুক্তির কিছু সময় বাকি ছিল। কিন্তু বাংলাদেশের একটি প্রভাবশালী শিল্প গ্রুপকে উচ্চপর্যায়ের চাপে নিয়মনীতির বাইরে গিয়ে কর সুবিধা দেয়ার চেয়ে তিনি দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাওয়াটাকেই শ্রেয় মনে করেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সরকারের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের সবচেয়ে সংবেদনশীল পদগুলোর মধ্যে একটি। রাষ্ট্রের রাজস্ব নীতিনির্ধারণে যুক্ত বাজেট প্রণয়নের মূল কাজটি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড সম্পন্ন করে থাকে। একই সাথে প্রতিষ্ঠানটির ছোটখাট সিদ্ধান্তে অনেকের শত কোটি টাকার লাভ লোকসানের বিষয় নির্ধারিত হয়।

শাহ আব্দুল হান্নানের দায়িত্ব পালনের বড় অংশ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অত্যন্ত মেধাবী একজন ছাত্র হিসেবে সিএসপি কর্মকর্তা হওয়াকে বেছে নিতে পারতেন। সম্ভবত তার মরহুম পিতা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে কাজ করার স্মৃতি তাকে এই ক্যাডার পছন্দ করতে ভূমিকা রেখেছে। শুধু জাতীয় রাজস্ব বোর্ডেই নয়, দুর্নীতি দমন ব্যুরো অথবা বাংলাদেশ ব্যাংকে দায়িত্ব পালনের সময়ও সততা ও কর্তব্যনিষ্ঠার সাথে তিনি কখনো আপস করেননি। তবে ক্ষমা করা, সুযোগ দেয়ার পাশাপাশি প্রান্তিক অবস্থান না নেয়াটাকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন।

৮০ বছর বয়স পার হওয়ার পর তিনি ‘আমার জীবনের উপলব্ধি’ নামে ২০ দফা পরামর্শ সংবলিত একটি ছোট লেখা লিখেছিলেন। এতে তিনি বলেছিলেন, ‘মধ্যপন্থাই উত্তম। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে মধ্যপন্থার কথা বলেছেন। মুসলিম জাতিকে তিনি ‘মধ্যপন্থী’ উম্মত বলেছেন। আর হঠকারিতা ও বাড়াবাড়ি ভালো নয়। কুরআনের বিভিন্ন জায়গায় বাড়াবাড়ির নিন্দা করা হয়েছে। সূরা নাহলের ৯০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বাড়াবাড়ি করতে নিষেধ করেছেন।’ প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনে তার এই নীতির অনুসৃতি আমরা দেখতে পেতাম। হয়তো এ কারণে পরবর্তীতে শুধু আদর্শগত কারণে অনেকে তার প্রতি ব্যক্তিগত শত্রুতায় যুক্ত হতে চেয়েছেন। কিন্তু এতে তার ক্ষতি হয়নি অথবা তার সম্মান ও মর্যাদা কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকে তিনি সম্ভবত বছর তিনেক ছিলেন। এ সময় তাকে অপছন্দ করতেন এমন কাউকে আমি দেখিনি। তার জীবনের একবারে শেষ দিকের বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ঘটনা আমার মনে পড়ে। একটি ব্যক্তিগত কাজে তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকে যান এবং গিয়ে তদানীন্তন ডেপুটি গভর্নর সীতাংশু সুর চৌধুরীর চেম্বারে গিয়ে বসেন। তার কাজটি এস কে সুর চৌধুরী নিজে উদ্যোগী হয়ে দ্রুত সম্পন্ন করে দেন। এরপর তিনি চলে যান। ঘটনাক্রমে সে দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের চল্লিশ তলা ভবনে ছোট একটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। কিছু লোক প্রচারণা চালাতে থাকে, শাহ সাহেব বাংলাদেশ ব্যাংকে গিয়ে নাশকতার পুরো ঘটনা ঘটিয়ে চলে গেছেন। এ জন্য বেশ দৌড়ঝাঁপও শুরু হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকে আসা যাওয়া ও একেবারে অল্প সময়ের অবস্থানের পুরো ঘটনা ডেপুটি গভর্নর সুর বাবুর সাথে হওয়ায় শেষ পর্যন্ত কাহিনীটি তৈরি করা সম্ভব হয়নি। শাহ আব্দুল হান্নান নিজেও জানতেন না, তাকে নিয়ে এত বড় এক ষড়যন্ত্র করা হয়েছিল।

শাহ আব্দুল হান্নান সরকারি দায়িত্ব পালনের সময় মনে হয়েছে, ব্যক্তিগত পর্যায়ে সততার ব্যাপারে সামান্যতম আপসও করেননি। তবে রাষ্ট্রীয় নীতি প্রণয়নের ব্যাপারে এর সাথে সাংঘর্ষিক কিছু মনে হলে তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন। এরপর যে সিদ্ধান্ত আসত তা নিজের মনঃপূত না হলেও বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াতেন না। ফলে কোনো সরকারের সময় দায়িত্ব পালনে শাহ আব্দুল হান্নানের বড় ধরনের সমস্যা তৈরি হয়নি যদিও সব সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ জানতেন তিনি একজন প্র্যাকটিসিং মুসলিম এবং সৎ ও কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি। একই সাথে তিনি বেশ কিছু দাতব্য শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত ছিলেন যেগুলোর বিশেষ পরিচিতি রয়েছে। শাহ আব্দুল হান্নান একটি বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনকে গন্তব্যে পৌঁছানোর স্বপ্ন দেখতেন। এ লক্ষ্যে তিনি ‘পাইওনিয়ার’ প্রতিষ্ঠিত করেন যুবকদের শিক্ষা ও গাইড দেয়ার জন্য। আর উইটনেস’ প্রতিষ্ঠা করেন মেয়েদের জন্য। এর সাথে নিয়মিত কুরআন ক্লাসের মাধ্যমে সর্বস্তরের আমলা ও পেশাজীবীদের সত্য ও কল্যাণের পথে আহ্বান করে গেছেন। শাহ আব্দুল হান্নান একাধারে ছিলেন চিন্তাবিদ, প্রায়োগিক অর্থনীতিবিদ এবং একজন সংস্কারকামী ব্যক্তিত্ব। তিনি ইসলামী অর্থনীতি, ব্যাংকিং, সামাজিক সংস্কার এবং ইসলামের বিভিন্ন দিকের ওপর বই ও অসংখ্য প্রবন্ধ লিখে গেছেন। উসুলে ফেকাহর ওপর তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বই তিনি লিখেছেন। এই বিষয়ে তিনি আমাদের এক সভায় আলোচনা করেন। এই বিষয়ে তিনি কতটা পারদর্শী, তা আমরা সাধারণ শিক্ষিতরা অতটা বুঝতে পারার কথা নয়। মাদরাসার কামেল পাস করা দু’জন আলেম বলেছেন, উসুলে ফেকাহর ওপর তিনি যে উচ্চ মার্গের আলোচনা তাদের একটি ক্লাসে করেছেন তা মাদরাসার সর্বোচ্চ শ্রেণীতেও কোনো ওস্তাদের কাছে তারা কোনো দিন শুনেননি। তিনি আমাদেরকে বলতেন, কুরআন হাদিস গভীরভাবে বুঝতে হলে উসুলে ফেকাহ জানতে হবে।

শাহ আব্দুল হান্নান বাংলাদেশে ইসলামী ব্যাংকিং প্রবর্তন এবং এর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছেন। অবসরের পর দেশের বৃহত্তম বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের চেয়ারম্যান হিসেবে সরাসরি প্রতিষ্ঠানটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি, দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম এবং মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠায় তার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও নেতৃত্ব ছিল। দেশে বিদেশে হাজার হাজার শিক্ষিত পেশাজীবী আমলা ও শিক্ষকের নির্দেশকের ভূমিকা রেখেছেন তিনি। তার উত্তর গোড়ানের বাসায় যখনই গেছি, কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অথবা সাবেক বা বর্তমান আমলাকে পেয়েছি যারা শাহ হান্নানের কাছে গাইডলাইন বা পরামর্শের জন্য এসেছেন।

২০০৪ সালে দৈনিক নয়া দিগন্ত আত্মপ্রকাশ করলে এই প্রতিষ্ঠানে চিফ রিপোর্টার হিসেবে যোগ দেই। নয়া দিগন্তের স্বত্বাধিকারী প্রতিষ্ঠান দিগন্ত মিডিয়া করপোরেশনের তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বোর্ড চেয়ারম্যান। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সচিব বা বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হিসেবে তাকে যেভাবে দেখেছিলাম, এবার দেখার সুযোগ হয় বেশ খানিকটা অন্য রকম। তিনি পত্রিকার নীতিনির্ধারণের দৈনন্দিন কাজের সাথে সম্পৃক্ত হতেন না। নিত্য প্রশাসনিক বিষয়গুলোও তিনি দেখতেন না। শুধু কনটেন্টের ব্যাপারেই তিনি কথা বলতেন এবং পরামর্শ দিতেন। সপ্তাহে বা মাসে একবার সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে তিনি বসতেন। বার্তা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেয়া, এরপর সম্পাদকীয় বিভাগের দায়িত্বে যাওয়া, আবার শেষে ডেপুটি এডিটর হিসেবে বার্তা বিভাগে ফিরে আসার পরে জনাব শাহ হান্নানের যোগাযোগটি অনেকটাই নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়। তিনি ফোন করেই আগে সালাম দিয়ে বলতেন, আমি কি কয়েক মিনিট কথা বলতে পারব? তিনি ছিলেন আমাদের বোর্ড চেয়ারম্যান; কিন্তু কথা বলতেন এটি কি করা যাবে বা এভাবে করলে কি ভালো হবে- ভেবে দেখো। এ ধরনের একটি নির্দেশনার ব্যাপারে শেষ দিকে একবার ফোন করলে তখন আমি জানাই যে, এখন চট্টগ্রামে আছি; আম্মাকে নিয়ে ঢাকায় ফেরার পর অফিসে গিয়েই কাজটি দেখব, ইনশা আল্লাহ। তখন আম্মার বয়স আর শরীরের কী অবস্থা, তার খুঁটিনাটি জিজ্ঞেস করেন। আমি বলি যে, আম্মার বয়স এখন ছিয়াশির কোটায়, তখন তিনি বলেন উনি আমার চেয়ে চার বছর বড়। এর পর যত বারই তিনি ফোন করেছেন প্রায় প্রতিবারই আম্মা কেমন আছেন সেটি আগে জিজ্ঞেস করতেন। সর্বশেষ করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠার পর যখন হান্নান ভাইয়ের আওয়াজ আবার ফোনে ভেসে আসে, তখন তার কণ্ঠটা একবারে ম্রিয়মাণ মনে হয়। তিনি কাজের কথাটি বলে জানান যে, শরীরটা বেশ দুর্বল হয়ে গেছে। আমার জন্য দোয়া করো।’

হান্নান ভাইয়ের শরীরের কথা বিবেচনা করে ফোন করার কথা ভাবতাম না। হালিম ভাইয়ের কাছ থেকে জেনে নিতাম, কী অবস্থা। সর্বশেষ শারীরিক অবস্থার অবনতি এবং হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং সেখানে পিছলে পড়ে পা ভেঙে যাওয়া আর শেষ পর্যন্ত লাইফ সাপোর্টে যাওয়ায় আমরা দু’হাত তুলে হান্নান ভাইয়ের জন্য দোয়া করেছি। কিন্তু পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালাই জানেন কিসে তার বান্দার মঙ্গল। সর্বশক্তিমান নিজের কাছেই নিয়ে গেছেন সৎ ও কল্যাণের পথে চির আহ্বানকারী মানুষটিকে। শিশুকালের অতিদুষ্ট হীরা নামের এই ছেলেটি হীরকের চেয়ে দামি এক ব্যক্তি হয়ে ফিরে গেলেন প্রভুর কাছে। বায়তুল মোকাররমে মরহুমের তৃতীয় নামাজে জানাজা শেষে শেষ বারের মতো এই মহান মানুষটির নিষ্প্রাণ উজ্জ্বল চেহারা দেখে মনে হয়েছে জান্নাতের অনেক উচ্চ কোনো স্থান পরম করুণাময় ও সর্বশক্তিমান তার জন্য নির্ধারণ করে রেখেছেন। মহাপ্রভু আমাদের প্রিয় মানুষটির জন্য স্থায়ী জীবনে জান্নাতুল ফেরাদাউস মঞ্জুর করুন- এই আমাদের প্রার্থনা।
mrkmmb@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/586423/