৬ জুন ২০২১, রবিবার, ২:২৮

হান্নান ভাই-নয়ন সমুখে তুমি নাই নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই

শাহ্ আব্দুল হান্নান। আমার সাথে তার জিন বা রক্তের কোনো সম্পর্ক ছিলো না। কিন্তু বাস্তবে তিনি ছিলেন আমার বড় ভাই, রক্তের সম্পর্কের না হলেও। সেই সাথে আমার বন্ধু। তার সাথে আমার পরিচয় ঘটে ছাত্রজীবনে। অনেক দিন আগের কথা। তাই সালটা আমার মনে নাই। স্থানটি ছিলো সম্ভবত এস এম হলের অর্থাৎ সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ক্যান্টিনে। পরবর্তীকালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের নাম ‘মুসলিম’ শব্দটি ছেঁটে ফেলে দেয়া হয়েছে। প্রিয় পাঠক, যা কিছুই লিখছি সব কিছুই স্মরণ থেকে লিখছি। তাই স্থান ও কালে কিছু উনিশ বিশ হতেও পারে। তাই আপনারা এধরনের ছোট খাট ভুল ত্রুটি পেলে ক্ষমাসুন্দর চোখে গ্রহণ করবেন। তবে যে দু চারটি ঘটনার কথা বলছি, সেখানে কোন উনিশ বিশ নাই।

সেই বহু বছর আগে সম্ভবত তৎকালীন এস এম হলের ক্যান্টিনের এক কোণায় আমি সকালের নাস্তার টেবিলে বসেছিলাম। তখনও আমার টেবিলে নাস্তা সার্ভ করা হয়নি। আমি অপেক্ষমান। এমন সময় আমার টেবিলের সামনে তিনি এলেন। তিনি নিজ থেকে আমার নাম ধাম এবং পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন। জানলেন যে আমি অর্থনীতিতে অনার্সে সবেমাত্র ভার্তি হয়েছি। আমি জানলাম যে উনি মাস্টার্সের শেষ বর্ষের ছাত্র অথবা ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে রেজাল্টের জন্য বসে আছেন। আমার নাস্তা এলো। একটু পর তারটাও। দুজনেরটাই অত্যন্ত সাধারণ নাস্তা। নাস্তা শেষ করে এক সঙ্গেই হলে ফিরলাম এবং যে যার রুমে ফিরে গেলাম।

এভাবেই হান্নান ভাইয়ের সাথে আমার পরিচয়। তখনও যে রেওয়াজ ছিলো সম্ভবত এখনো সেই রেওয়াজ আছে যে জুনিয়ররা সিনিয়রদেরকে ভাই বলে সম্বোধন করেন। যেমন হান্নান ভাই, মওদুদ ভাই, কাজী জাফর ভাই ইত্যাদি। ইসলামী মূল্যবোধ তখন থেকেই তার মধ্যে প্রোথিত ছিলো। সেটা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছি। কোনো ছাত্র সংগঠনে তাকে এ্যাক্টিভিস্ট হিসাবে দেখিনি। তবে মাঝে মাঝে যখন কথা হতো তখন উনি বোঝাতে চেষ্টা করতেন যে পবিত্র ইসলাম শুধুমাত্র ব্যক্তিজীবনে পালনীয় একটি ধর্মই নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রও ইসলামের মূলনীতির ভিত্তিতে গঠিত হতে পারে। গঠিত হলে সাম্য ও সম্প্রীতি আসবে।

এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পার হয়ে গেলেন। তখন আর নিয়মিত যোগাযোগ হতো না। কিন্তু শুনতাম যে তিনি নাকি কোন একটি কলেজে জয়েন করেছেন। তখন ক্যাডার সার্ভিসে জয়েন করতে হলে সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিস বা সিএসএস পরীক্ষায় পাশ করতে হতো। সেই পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে নির্ধারিত হতো আপনি কোন সার্ভিস পাবেন। সেটা হতে পারতো সিভিল সার্ভিস (সিএসপি), ফরেন সার্ভিস (পিএফএস), পুলিশ সার্ভিস (পিপিএস), অডিট এ্যান্ড এ্যাকাউন্ট সার্ভিস ইত্যাদি। হান্নান ভাইও সিএসএস পরীক্ষায় অংশ নেন এবং সম্ভবত অডিট এ্যান্ড এ্যাকাউন্টস সার্ভিস পান। সেই ল্যাডার বা মই বেয়েই তিনি কাস্টমসের কালেক্টর হন, বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর হন এবং সব শেষে বাংলাদেশ সরকারের সচিব হন।

এগুলো তো গেল তার চাকরি জীবনের দিক। এই দিকটি আমার আলোচ্য বিষয় নয়। তবে এখানেও একটি উল্লেখ করার বিষয় আছে। সেটি হলো এই যে চাকরি জীবনে তিনি যে র‌্যাঙ্কে বা যে স্ট্যাটাসেই থাকুন না কেন, অহংকার তার জীবনকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি। এর প্রমাণ হিসাবে আজকের যে ঘটনাটি সবশেষে বলতে চেয়েছিলাম সেটি এখন বলছি। ১৯৯৬ সাল। তখন আমি দৈনিক ইনকিলাবে কর্মরত। মার্কিন দূতাবাস থেকে ফোন পেলাম। আমাকে তারা চায়ের দাওয়াত করেছে। যথারীতি গেলাম। আামাকে একটি চিঠি দেয়া হলো। চিঠিতে বলা হয়েছে যে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট আমেরিকা সফরের জন্য আমাকে দাওয়াত করেছে। আমি দাওয়াত কবুল করলাম। এর কিছুদিন পর আবার আমাকে দূতাবাসে ডাকা হয়, প্রয়োজনীয় ব্রিফিং দেয়া হয় এবং একটি প্যাকেট আমেরিকার ইতিহাস ভূগোল সম্পর্কে কিছু লিটারেচার দেয়া হয়। ঐ ব্রিফিং সেশনেই আমি জানতে পারি যে আমার সফরটি শুরু হবে ওয়াশিংটন থেকে এবং তারপর নিউইয়র্ক টেকসাস এবং আরো বেশ কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে নিয়ে যাওয়া হবে।

॥ দুই ॥
এর কয়েক দিন পর হান্নান ভাই হঠাৎ আমাকে ফোন করেন। জানতে চান যে আমি আমেরিকায় যাচ্ছি কিনা। আমি বললাম যে যাচ্ছি ঠিকই, তবে আমার কিছু দ্বিধা দ্বন্দ্ব রয়েছে। কারণ আমার ভাঙা হাত কেবল জোড়া লেগেছে। জুতা মোজা পরতে অসুবিধা হয়। উনি বললেন, আপনাকে যেতেই হবে। কারণ আমি তো আপনার নাম রেকমেন্ড করেছি। আপনি না গেলে আমি তো মুখ খাওয়া হয়ে যাবো। তখন আমি বুঝতে পারলাম, মার্কিন দূতাবাস আমাকে কেন সিলেক্ট করেছে। ওরা তো আমাকে চিনতো না এবং আমার নাম ধাম পরিচয়ও তাদের জানার কথা নয়। পরে জানতে পেরেছি যে মার্কিন দূতাবাস প্রায় দেড় মাসের আমেরিকা সফরের জন্য সিভিল সার্ভিস থেকে হান্নান ভাইকে সিলেক্ট করেছে। অতঃপর উনার কাছ থেকেই চেয়েছে এমন একটি নাম যিনি সিনিয়র সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী। আমি নিজেকে কোন দিন বুদ্ধিজীবী মনে করি না। কিন্তু সেদিন জানলাম, হান্নান ভাই আমাকে একজন শক্তিশালী কলামিস্ট এবং বুদ্ধিজীবী মনে করেন। এবং মনে করেন বলেই আমার নাম তিনি সেখানে দিয়েছেন। এরপর ওরা গোপনে আমার সম্পর্কে খোঁজ খবর করে এবং কনভিন্সড হয় যে শাহ্ আব্দুল হান্নান সঠিক ব্যক্তিকেই নির্বাচন করেছেন। ওপরে আল্লাহর ইচ্ছা এবং নীচে হান্নান ভাইয়ের বদৌলতেই আমি জীবনে প্রথমবার একসাথে আমেরিকার ওয়াশিংটন, ম্যারিল্যান্ড, নিউইয়র্ক ডালাস, ইলিনয়, নিউজার্সি, টেকসাস, ক্যালিফোর্নিয়া, অর্থাৎ আমেরিকার ইস্ট কোস্ট থেকে শুরু করে ওয়েস্ট কোস্ট পর্যন্ত প্রলম্বিত আমেরিকার সম্ভবত ১২ টি অঙ্গরাজ্য সফর করার সুযোগ লাভ করি। পরে আমি আমেরিকার গ্রীনকার্ড লাভ করি এবং আরো তিনবার আমেরিকায় যাই। প্রায় দেড় মাস ব্যাপী আমেরিকা সফরের সময় হান্নান ভাই আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যে সাহায্য করেন সেটি জীবনে ভুলবার নয়। হান্নান ভাইয়ের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার ঋণ অশেষ।

॥ তিন ॥
দ্বিতীয় ঘটনা হলো আমার ‘দৈনিক সংগ্রামে’ খণ্ডকালীন কাজ করা। এটাও অন্তত ২১/২২ বছর আগের ঘটনা। তখন আমি ‘দৈনিক ইনকিলাবে’ এ্যাসোসিয়েট এডিটর বা সহযোগী সম্পাদক। দৈনিক সংগ্রামের সম্পাদক জনাব আবুল আসাদ আমাকে কয়েকবার ফোন করে অনুরোধ করেন, সংগ্রামে নিয়মিত সাপ্তাহিক কলাম লিখতে। আমি সবিনয়ে এ কারণে অপারগতা প্রকাশ করি যে একটি দৈনিকে ফুল টাইম কাজ করে আরেকটি দৈনিকে কিভাবে কাজ করবো এবং বেতন নেবো।

বিষয়টি হয়তো এখানেই থেমে যেত। কিন্তু এর কয়েকদিন পর একদিন হান্নান ভাইয়ের ফোন। তিনি তখন সম্ভবত সরকারের সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব। বললেন, তাঁর বাসায় তাঁর সাথে এক কাপ চা খেতে। চায়ের দাওয়াত কবুল করলাম। তার বাসায় গিয়ে দেখি, মধ্যবিত্তের মত অতি সাধারণ গৃহশয্যা। ওয়াল টু ওয়াল কার্পেট নাই। নাই কোনো মর্ডান আভিজাত্যের ছাপ। ছোট্ট একটি পাটের কার্পেটের ওপর সেন্টার টেবিল। সেখানে গিয়ে দেখি সংগ্রাম সম্পাদক জনাব আবুল আসাদ আগে থেকেই বসা। বুঝলাম, আমাদের দুজনকেই উনি ডেকেছেন। হান্নান ভাইয়ের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল অনন্য। অনন্য এই অর্থে যে তিনি যা বলবার তিনি সরাসরি বলে ফেলতেন। কোনো ভূমিকা করতেন না। তেমনি উনার মূল বক্তব্য শেষ হলে কথাবার্তা ওখানেই শেষ করে দিতেন। টেলিফোন সংলাপেও এটাই তিনি মেইনটেন করতেন। Come to the point straight. তার কথা শেষ হলে বলতেন আসসালামু আলাইকুম এবং টেলিফোন রেখে দিতেন বা কেটে দিতেন। আমাকে তিনি ছোট ভাইয়ের স্নেহে ঠাট্টা করে বলতেন, ‘এই যে বড় সাংবাদিক’ অথবা ‘এই যে বড় কলামিস্ট’। শুরু করলেন এই ভাবে, ‘এই যে বড় কলামিস্ট, সংগ্রামে আপনার একটি কলাম চাই’। আমি আমার অসুবিধার কথা বললাম। উনার সরাসরি কথা, ‘ছদ্মনামে লিখুন এবং ছদ্ম নামেই বেতন গ্রহণ করুন। তবু আপনাকে লিখতেই হবে।’ এরপর আর কোনো কথা চলে না। সংগ্রামে জন্ম নিলো এক নতুন কলামিস্ট। তার নাম আসিফ আরসালান। সেই থেকে সংগ্রামে আসিফ আরসালান নিয়মিত লিখে চলেছে এবং আজও লিখছে।

এখন বলবো তৃতীয় ঘটনা। এটি আমার জন্য চিরদিন একটি সুখের স্মৃতি হয়ে থাকবে। সনটি সঠিক মনে নাই। ২০১১ সালের আশে পাশে হবে। একদিন ইনকিলাবে আমার কামরায় বসে কাজ করছি। এমন সময় এক তরুণ যুবা আমার কামরায় প্রবেশ করলো। অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল যে আপনার গুরুত্বপূর্ণ কলামগুলো নিয়ে শাহ্ আব্দুল হান্নান সাহেব একটি পুস্তক প্রকাশ করতে চান। আমি বললাম, আমি তো বিভিন্ন বিষয়ে কলাম লিখি। কোন বিষয়গুলো নিয়ে বই হবে? ছেলেটি বিনয়ের সাথে বলল, তাহলে আপনি স্যারের সাথে কথা বলুন।

এরপর হান্নান ভাইয়ের সাথে কথা বললাম। তখন শীত কাল। লম্বা কথা হলো। সাব্যস্ত হলো যে আইন ও সংবিধান সম্পর্কে আমার যেসব কলাম রয়েছে সেগুলো নিয়ে একটি বই প্রকাশিত হবে। যেহেতু এটি হবে আইন ও সংবিধান সম্পর্কিত বই তাই এটি প্রকাশ করবে ‘বাংলাদেশ ইসলামিক ল’রিসার্চ এ্যান্ড এইড সেন্টার’। তার সাথে বৈঠক হওয়ারর সপ্তাহ খানিক পর আমার সাথে যোগাযোগ করলেন এ্যাডভোকেট নজরুল ইসলাম। জানলাম তিনি এই সেন্টারটির প্রেসিডেন্ট বা সেক্রেটারি। তিনি একজন আইনজীবীকে ডেপুট করলেন এই বিষয়ে আমার সাথে যোগাযোগ করতে। আমি সংবিধান ও আইন সম্পর্কিত ৪৮ টি কলাম বা নিবন্ধ তার হাতে দিলাম।

চমৎকার প্রচ্ছদে ৪৮ টি নিবন্ধ নিয়ে প্রকাশিত হলো আমার সেই গ্রন্থটি। নাম ‘পঞ্চম সপ্তম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল এবং প্রাসঙ্গিক জটিলতা’। এই গ্রন্থে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মাইনুল আহসান খান চার পৃষ্ঠাব্যাপী ঐ গ্রন্থ এবং গ্রন্থের লেখক আমার সম্পর্কে প্রশংসার যে ফুলঝুরি রচনা করেছেন তাতে আমি অভিভূত। আমি সেই প্রশংসার মোটেই যোগ্য নই। কিন্তু এই পুস্তকটি গ্রন্থনা এবং প্রকাশের একশত ভাগ কৃতিত্ব মরহুম শাহ্ আব্দুল হান্নান ভাইয়ের। অথচ এই গ্রন্থটি প্রকাশের ব্যাপারে তিনি নিজেকে চিরদিন আড়ালে রেখে গেলেন।

হান্নান ভাইয়ের সাথে আমার এ ধরণের অসংখ্য স্মৃতি রয়েছে। তার সাথে আমার পরিচয় কম করে হলেও ৬০ বছরের। ৬০ বছরের সেই স্মৃতি আজও অমলিন এবং অম্লান। সেগুলো গ্রন্থিত করলে আরেকটি গ্রন্থ রচিত হবে। এক কথায় বলা যেতে পারে, তিনি ছিলেন একজন মহাপুরুষ। এক কথায় আমার হৃদয়ের সমস্ত শ্রদ্ধা তার কাছে নিবেদন করছি নীচের কবিতার কয়েকটি চরনের মাধ্যমে। পত্রিকায় যখন তার ছবি দেখি তখন স্মৃতিপটে অনুরণন তোলে নীচের কয়েকটি পংক্তি।

নয়ন সমুখে তুমি নাই
নয়নের মাঝখানে নিয়েছো যে ঠাঁই।
আজি তাই শ্যামলে শ্যামল তুমি
নীলিমায় নীল।
আমারো নিখিল তোমাতে পেয়েছে
তার অন্তরের মিল।
নাহি জানি, কেহ নাহি জানে
তবে সুর বাজে মোর গানে
কবির অন্তরে তুমি কবি
নও ছবি, নও ছবি, নও ছবি।
Email: asifarsalan15@gmail.com

https://dailysangram.com/post/454597