৫ জুন ২০২১, শনিবার, ২:২০

সীমান্তের ৭ জেলায় করোনা বিপর্যয়

রাজশাহী মেডিক্যালে একদিনে ১৬ জনের মৃত্যু : কেউ মানছে না স্বাস্থ্যবিধি

রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালের করোনা ইউনিটে একদিনে সর্বোচ্চ ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ড ও আইসিইউতে তাদের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে গত ২৪ মে থেকে গতকাল পর্যন্ত ১২ দিনে হাসপাতালের করোনা ইউনিট ও আইসিইউতে মারা গেছেন ৯৩ জন। শুধু রাজশাহী নয়, সীমান্তের করোনার হটস্পট সাতটি জেলাতেই করোনা পরিস্থিরি ক্রমে অবনতি হচ্ছে। বাড়ছে সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা। এসব জেলায় স্বাস্থ্যবিধি মানছে না কেউ। এ কারণে সংক্রমণ ও শনাক্তের হারও ঊর্ধ্বমুখী। সংক্রমণরোধে ইতোমধ্যে কোনো কোনো এলাকায় স্থানীয়ভাবে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। তবে প্রশাসনের উদাসিনতায় সে লকডাউনও সঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে না।

রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক সাইফুল ফেরদৌস জানান, রামেক হাসপাতালে একদিনে করোনায় ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড। গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়া ১৬ জনের ১০ জনই করোনা পজিটিভ ছিলেন। পাশাপাশি উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ছয়জন। তিনি বলেন, মৃতদের মধ্যে আইসিইউতে পাঁচজন, ২৫ নম্বর ওয়ার্ডে তিনজন, ২২ নম্বর ওয়ার্ডে দুইজন, তিন নম্বর ওয়ার্ডে তিনজন, ২৯ নম্বর ওয়ার্ডে দুইজন ও ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডে একজন মারা গেছেন। এদের মধ্যে চাপাইনবাবগঞ্জের নয়জন, রাজশাহীর ছয়জন ও নওগাঁর একজন। হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডগুলোতে ভর্তি আছেন ২২৫ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন রোগী ভর্তি হয়েছেন ৩২ জন। এর মধ্যে ১৩ জন রাজশাহীর, ১৫ জন চাঁপাইনবাবগঞ্জের, পাবনার তিনজন ও একজন নাটোরের বাসিন্দা। এদিকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডগুলোতে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আগের দিনের তুলনায় রোগী বেড়েছে ২২৫ জন। করোনার সংক্রমণ কমাতে রাজশাহীতে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বিশেষ বিধিনিষেধ চলছে। প্রথমদিন গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। এতে সন্ধ্যার পর নগরী ফাঁকা হয়ে যায়।

গত বুধবার করোনা সংক্রমণের হার বেড়ে যাওয়ায় ১৫ দফা নির্দেশনা দিয়ে জেলার পৌরসভা এলাকা ও নিয়ামতপুর উপজেলায় এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করা হয়। জেলা প্রশাসক মো. হারুন-অর-রশীদ বলেন, নওগাঁয় জনসাধারণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধির প্রতি অনীহা দেখা যাচ্ছে। তাই প্রশাসনের একাধিক দল মাঠে থাকবে। জনসমাগমে নজরদারি করা হবে। জেলার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. মঞ্জুর এ. মোর্শেদ বলেন, ঈদুল ফিতরের পর থেকে করোনা সংক্রমণের হার ৩০ শতাংশের বেশি। নওগাঁ পৌরসভা ও সীমান্তবর্তী নিয়ামতপুরে দুই সপ্তাহ ধরে সংক্রমণের হার প্রায় ৫০ শতাংশ। এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৪৩ জন। কোয়ারেন্টিনে নেওয়া হয় ২২ হাজার ২৪৯ জনকে। মোট আক্রান্ত ২৩ হাজার ১৬ জন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১১ জন এবং আইসোলেশনে আছে ৯ জন।

অন্যদিকে, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্বদ্যিালয়ের (যবিপ্রবি) জিনোম সেন্টার থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ২ মে যশোরের ২৮৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৭০ জনের পজিটিভ পাওয়া গেছে। ৩১ মে ২২০ জনের নমুনায় পজিটিভ ছিল ২৯ জন। স্থানীয়রা জানান, মানুষ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। মূলত সরকারি-বেসরকারি অফিসে ঢুকতেই মাস্ক পরেন সবাই। গণপরিবহনেও স্বাস্থ্যবিধি মানা হচ্ছে না। বেনাপোলের অবস্থাও একই। ভারতফেরত পাসপোর্টযাত্রীরা শারীরিক দূরত্ব মানছেন না। পণ্য নিয়ে আসা ভারতীয় ট্রাক চালকদেরও মুখেও দেখা যায়নি মাস্ক। এতে ওই যাত্রীদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ডাক্তার, প্রশাসন ও পুলিশের কর্মীরা পড়েছেন স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। কারণ তাদের কারোরই পিপিই নেই। মাস্ক ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারই ভরসা। যশোরের সিভিল সার্জন ডা. শেখ আবু শাহীন বলেন, করোনা শনাক্তের হার বুধবার একটু বেশি। কিন্তু একদিনের ফলাফলের ওপর কিছু অনুমান করা যায় না।

অন্যদিকে রাজশাহী জেলার ২৩ লাখ ৭৮ হাজার মানুষের বেশিরভাগই পরিস্থিতির ভয়াবহতা অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। প্রশাসন প্রচারণার পাশাপাশি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা ও দন্ড প্রদান করে যাচ্ছে। রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মুহাম্মদ শরীফুল হক বলেন, সুপার মার্কেট ও অফিসে স্বাস্থ্যবিধি মানা হলেও খোলাবাজারে একেবারেই মানছে না কেউ। সিটি করপোরেশন এলাকায় ৪টি ও ৯টি উপজেলায় প্রতিদিনই দুটি করে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ লাগোয়া গোদাগাড়ী উপজেলার রাজাবাড়ি হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক মশিউর রহমান বলেন, গোদাগাড়ী উপজেলার অবস্থাও ভয়াবহ। কিন্তু কেউ কিছু মানছে না। তাদের কথা হলো মানুষ সময়ে সময়ে মারা যায়। এখনও যাচ্ছে। মাস্ক পরে কী হবে। এসব চিন্তা নিয়ে সবাই ইচ্ছামতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বানেশ্বর হাট ইজারদার ওসমান আলী বলেন, আমের মৌসুম শুরু হওয়ায় লোকজন বেশি। হাট কমিটি বাজারে আসা সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলেছে। ক্রেতা-বিক্রেতারাই কথা শোনে না। রাজশাহী বিভাগের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী জেলা চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। আমের বাজারে অবাধ চলাচল বন্ধ করতে না পারলে পরিস্থিতি ভয়ানক আকার নিতে পারে বলে মনে করছে প্রশাসন।

করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুতে খুলনা জেলা শীর্ষে। মে মাসে এ জেলায় মারা গেছেন ৪০ জন। এপ্রিলে সংক্রমণের গড় হার ছিল ২০ শতাংশ এবং মে মাসে এ হার দাঁড়ায় ২১ শতাংশে। এক মাসের ব্যবধানে সংক্রমণের গড় হার ১ শতাংশ বেড়েছে। খুলনার সিভিল সার্জন ডা. নিয়াজ মোহাম্মদ বলেছেন, ঈদুল ফিতরের আগমুহূর্তে আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার উদ্বেগজনক হারে বাড়ে। ঈদের পর থেকে এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি স্থিতিশীল। খুলনার বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. রাশিদা সুলতানা বলেন, এপ্রিলের শুরু থেকে সংক্রমণ বেড়ে চলছে। মে মাসের শুরুতে কিছুটা কম থাকলেও শেষে বেড়েছে। খুলনার সিভিল সার্জন দফতরের সূত্র জানায়, খুলনায় ভারতফেরত ১৬ জনের নমুনা নিয়ে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পরীক্ষার জন্য ঢাকার আইইডিসিআর-এ নমুনা পাঠানো হয়েছে। এখনও রিপোর্ট আসেনি। বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের সূত্র জানায়, সংক্রমণের শুরু থেকে ৩১ মে পর্যন্ত বিভাগের ১০ জেলায় শনাক্ত হয় ৩৪ হাজার ২৯১ জনের। মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬৪৫ জনে।

খুলনা বিভাগের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা য়ায়, সাতক্ষীরায় আক্রান্ত ১ হাজার ৫৯৬ জন এবং মারা গেছেন ৪৭ জন। যশোরে আক্রান্ত ৬ হাজার ৯৩০ জন, মারা গেছেন ৮১ জন। নড়াইলে আক্রান্ত ১ হাজার ৮৭৩ জন, মারা গেছেন ২৭ জন। মাগুরায় আক্রান্ত ১ হাজার ২৫৩ জন, মারা গেছেন ২৩ জন। ঝিনাইদহে আক্রান্ত ২ হাজার ৯০৮ জন, মারা গেছেন ৫৫ জন। কুষ্টিয়ায় আক্রান্ত ৪ হাজার ৯৪৬ জন, মারা গেছেন ১১২ জন। চুয়াডাঙ্গায় আক্রান্ত ১ হাজার ৯৬৮ জন, মারা গেছেন ৬১ জন। সবচেয়ে কম আক্রান্ত মেহেরপুরে-৯৯০ জন। মারা গেছেন ২৩ জন। এদিকে, সাতক্ষীরায় ৯৪ জনের নমুনা পরীক্ষায় ২৯ জনের শনাক্ত হয়েছে। উপসর্গ নিয়ে তিন ঘণ্টার ব্যবধানে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুই নারীসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত¡াবধায়ক কুদরত-ই-খোদা বলেন, এ পর্যন্ত হাসপাতালে করোনার উপসর্গ নিয়ে ২১৭ জন এবং করোনা পজিটিভ হিসেবে ৩৩ জন মারা গেছে। কুষ্টিয়ায় এক সপ্তাহে জেলায় ১৬৫ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। জেলা প্রশাসকের অফিস সূত্রে জানা যায়, ২৬ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত ২১৯ জন শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ২ জুন শনাক্ত হয়েছে ৫৪ জন এবং মারা গেছেন দু’জন। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১১৬ জন।

সাতক্ষীরা জেলার নাগরিক কমিটির আহবায়ক আনিসুর রহিম বলেন, ইয়াসের পর কয়েকটি উপজেলা ঘুরে দেখলাম কারও মুখে মাস্ক নেই। ভারত থেকে অনেকে আসছেন। তারা মাস্ক পরছেন না। এ কারণে পরিস্থিতির এত অবনতি। সিভিল সার্জন ডা. মো. হুসাইন শাফায়াত বলেন, ১৬ মে থেকে ৩০ মে পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১২৬২ জনের। পজিটিভ পাওয়া গেছে ২৭০ জনের। সংক্রমণের হার ২১ দশমিক ৩৯ শতাংশ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ৩০ মে ৮৯ জনের নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ আসে ৩৭ জনের। গতবছর থেকে এ পর্যন্ত জেলায় মারা গেছে ৪৭ জন।
সীমান্তে নজরদারির ওপর গুরুত্বারোপ করে জনসচেতনতা বৃদ্ধির আহবান জানিয়েছেন সাতক্ষীরার জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল। সাতক্ষীরার ২২৮ কিলোমিটার সীমান্ত গলিয়ে বৈধপথে আসা মানুষকে কোয়ারেন্টিনে নেওয়া এবং অবৈধভাবে আসাদের আটক করে কোয়ারেন্টিনে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে, দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী হিলিতে বেড়ে চলেছে সংক্রমণের হার। ১-২ জুন নতুন করে আরও ৫ জন আক্রান্ত হয়েছেন। দু’দিনে ১০ জন আক্রান্ত হয়েছেন। আতংক বাড়ছে স্থানীয়দের মধ্যে। হাকিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. তৌহিদ আল হাসান বলেন, হিলিতে সংক্রমণ কমই ছিল। কয়েকদিন ধরে হঠাৎ বাড়ছে। আমাদের হাসপাতালের আউটডোর ও ইমারজেন্সিতে এখন প্রায়ই জ্বরের রোগী পাওয়া যাচ্ছে। নাটোর জেলা প্রশাসন ও স্বাস্থ্যবিভাগের কঠোর পদক্ষেপে নাটোরে ৫ দিনের ব্যাবধানে সংক্রমণ অর্ধেকে নেমেছে। ২৮ মে’র পরীক্ষায় ৪৬ জন সংক্রমিত দেখা গেলেও ২ জুন সংক্রমণ নেমেছে ২৩ জনে। সংক্রমণ আরও কমাতে চলমান কঠোর অবস্থান বজায় রাখবে প্রশাসন। সিভিল সার্জন ডাক্তার মিজানুর রহমান জানান, ৫ মে নাটোরে করোনা পজিটিভ হন ৫ জন। ১২ মে ২ জন। কিন্তু ২৬ মে ৯ জন ও ২৮ মে একলাফে ৪৬ জনে দাঁড়ায়। এমন অবস্থায় শহরের প্রবেশমুখগুলোতে জনচলাচল সীমিত করা ছাড়াও মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। পরিচালনা করা হয় ভ্রাম্যমাণ আদালত।

https://www.dailyinqilab.com/article/386904