৫ জুন ২০২১, শনিবার, ২:১৬

মাছ ধরায় ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা

উপকূলে অভাবের থাবা স্থবির ব্যবসা-বাণিজ্য

বেকার হাজার হাজার জেলে - ১৫ দিনেও মেলেনি সরকারি সহায়তার চাল

‘এটা হচ্ছে সাগর পাড়ের এলাকা। এখানে সবকিছুই নির্ভর করে মাছের ওপর। মাছ থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, না থাকলে নেই। জেলেরা সাগর থেকে ট্রলার ভর্তি করে মাছ নিয়ে এলেই জমজমাট থাকে সবকিছু। বেচা-বিক্রি বাড়ে দোকানপাটে। চলে বরফ কল। বিক্রি হয় জাল, সুতা আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য। সচল থাকে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা। মাছ ছাড়া যেখানে সবকিছুই অচল সেখানে ১৫ দিন ধরে বন্ধ সাগরে মাছ ধরা। এটা চলবে আরও ৫০ দিন। তার ওপর চলছে লকডাউন। কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছি না। বকেয়া পড়ছে দোকানের ভাড়া ও বিদ্যুৎ বিল।’ কথাগুলো বলছিলেন পাথরঘাটা বন্দর বাজার ব্যবস্থাপনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক অরুন কর্মকার। শুক্রবার দুপুরে যখন কথা হয় তখন তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। তিনি হতাশার সুরে বলেন, ‘সরকার প্রণোদনা-ঋণ অনেক কিছুর কথা বলছে, কিন্তু আমাদের মতো তৃণমূলে কিছুই পৌঁছাচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত হয়তো পথে বসতে হবে।’

জানা গেছে, সাগরঘেঁষা পাথরঘাটা উপজেলার মানুষের আয়ের প্রধান উৎস মাছ শিকার। বরগুনার এই উপজেলায় মাছের ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে ছোট-বড় কয়েক হাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আর ২৭টির মতো বরফকল। গড়ে উঠেছে ট্রলার নির্মাণ ও জাল-সুতার ব্যবসা। দেশের অন্যতম মৎস্যবন্দর হিসেবেও পরিচিত এই পাথরঘাটা। ভরা মৌসুমে এখান থেকে সারা দেশে যায় হাজার হাজার মণ ইলিশের চালান। ব্যস্ত এই বন্দরে এখন খাঁ খাঁ শূন্যতা। প্রজনন মৌসুমে সাগরে মাছ ধরার ওপর সরকারের দেওয়া ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা চলছে। এ কারণে শত শত ট্রলার নোঙর করে আছে পাথরঘাটার খালে। মাছ ধরা বন্ধ থাকায় একদিকে যেমন বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার জেলে, তেমনি পুরো পাথরঘাটাজুড়েই ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতা নেমে এসেছে।

পাথরঘাটা বরফকল মালিক সমিতির অর্থ সম্পাদক মিহির কান্তি বলেন, সাগরে মাছ শিকার চালু থাকলে একেকটি ট্রলারেই যেখানে দৈনিক দরকার পড়ে ৩৫০ ক্যান বরফ সেখানে এখন পুরো সপ্তাহ মিলেও ৩৫০ ক্যান বিক্রি হচ্ছে না।পাথরঘাটায় বর্তমানে ২৭টি বরফকল রয়েছে। শ্রমিকের সংখ্যা ১ হাজারের ওপরে। বলতে গেলে সবাই বেকার। তিনি বলেন, এক বছর ধরে করোনা সংক্রমণের কারণে এমনিতেই চরম বিপদে রয়েছি আমরা। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া তো দূরে থাক, বিদ্যুৎ বিল পর্যন্ত দিতে পারছি না।এ রকম সংকটের মধ্যে ইলিশের ভরা মৌসুমে বন্ধ রাখা হচ্ছে সাগরে মাছ ধরা। বিষয়টি নিয়ে অনেক আন্দোলন সংগ্রাম হলেও সিদ্ধান্তে অটল সরকার।মাছ ধরা বন্ধ থাকায় চোখে অন্ধকার দেখছি আমরা। পাথরঘাটা উপজেলার হরিণঘাটা এলাকার বাসিন্দা ট্রলার মালিক আবুল ফরাজী, পৌর এলাকার বাসিন্দা হেমায়েত মল্লিক, চরদোয়ানী খলিফার হাট এলাকার বাসিন্দা বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘মাছ ধরা বন্ধ থাকায় সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছি আমরা ট্রলার মালিকরা। কর্মহীন হয়ে পড়া জেলেরা কোনো না কোনোভাবে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করলেও কিছুই করতে পারছি না আমরা। মধ্যবিত্তের আত্মসম্মান বোধের কারণে না পারছি কারও কাছে হাত পাততে, না পারছি অন্য কোনো কাজ করতে।’

হাশেম মাঝি নামে একজন ট্রলার মালিক বলেন, ‘আমার ৪টি ট্রলারের জেলেরা বালুর জাহাজে চাকরি নিয়েছে। অনেকে রিকশা ভ্যান চালাচ্ছে। কেউ আবার করছে মাটি কাটার কাজ। আড়তদারদের থেকে দাদন নিয়ে জেলেদের দিয়েছি। শর্ত হচ্ছে মাছ ধরে সেই টাকা শোধ দিতে হবে। কিন্তু যেসব জেলে অন্য পেশায় চলে গেছে তারা যে আবার ফেরত আসবে তেমন কোনো সম্ভাবনা দেখছি না। শেষ পর্যন্ত হয়তো ট্রলার বিক্রি করে দেনা শোধ করতে হবে।’

সরকারি নির্দেশনায় ২০ মে থেকে মাছ ধরা বন্ধ থাকলেও বেকার হয়ে পড়া জেলেদের জন্য সরকারিভাবে যে চাল দেওয়ার কথা তাও এখন পর্যন্ত পায়নি জেলেরা। কেবল পাথরঘাটাই নয়, উপকূলবর্তী কলাপাড়া, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, চরফ্যাশন ও মনপুরাসহ প্রায় সব জায়গা থেকেই মিলেছে একই খবর। দুই ধাপে মাথাপিছু মোট ৮৬ কেজি করে চাল দেওয়ার কথা থাকলেও তা পায়নি অধিকাংশ জেলে। এসব এলাকার বেশ কয়েকজন জেলে যুগান্তরকে বলেন, ‘একেকটি জেলে পরিবারে কম করে হলেও ৬-৭ জন করে ‘খানেওয়ালা’ রয়েছে। ৬৫ দিন যেখানে কাজ বন্ধ সেখানে ৮৬ কেজি চালে কিছুই হবে না। তারপরও এটুকু পেলেও অনেকটাই সহজ হতো পেট চালানো। কিন্তু ১৫ দিনেও সেই চাল দেওয়া হয়নি।’

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে পাথরঘাটার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু বলেন, ‘বৃহস্পতিবার বরাদ্দের চিঠি পেয়েছি আমরা। এই উপজেলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১১ হাজার ৪৩৮ জন। প্রথম পর্যায়ে মাথাপিছু ৫৬ কেজি করে চাল দেব। আশা করছি রোববার থেকে বিতরণ শুরু করতে পারব।’ পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, ‘এখানে ১৮ হাজার ৩০৫ জেলে সহায়তা পাবে। বরাদ্দ আসতে একটু দেরি হওয়ায় ১২ ইউনিয়ন ও ২ পৌরসভার মধ্যে ৪ ইউনিয়নে বিতরণ করা গেছে। বাকিগুলোতেও খুব শিগগিরই বিতরণ হয়ে যাবে।’ বাংলাদেশ ফিশিং বোট ওনার্স ফেডারেশনের সভাপতি মোস্তফা চৌধুরী বলেন, ‘৬৫ দিনের এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে গত বছর থেকে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের বহু চেষ্টা করেছি। প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরার পক্ষে নই আমরা। প্রশ্ন হচ্ছে প্রজনন মৌসুমের সময় নিয়ে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের অভিন্ন সমুদ্রসীমা রয়েছে। সেখানে প্রজনন মৌসুমের নিষেধাজ্ঞার সময়সীমা শেষ হয়ে যাওয়ার পর শুরু হয় আমাদের নিষেধাজ্ঞা। এটা কী করে সম্ভব? সামান্য দূরত্বের একই সমুদ্রে প্রজননের সময় আলাদা হয় কী করে? আমরা চাইছি দুই দেশের নিষেধাজ্ঞা হোক একই সময়ে। তাছাড়া নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে শুধু জেলেদের চাল দিলেই কি সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? মাছের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে উপকূলের শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। মাছ বন্ধ মানে সব বন্ধ। সরকারের উচিত নিষেধাজ্ঞার এই সময়ে সবার জন্য কিছু না কিছু করা।’

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/427901