৫ জুন ২০২১, শনিবার, ২:১৬

পুরো রাজশাহী অঞ্চলে করোনার ভারতীয় ধরন সংক্রমণের শঙ্কা

রোগীর চাপে হিমশিম খাচ্ছে রামেক হাসপাতাল

দেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার বেড়েই চলেছে। সংক্রমণের হার ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখীর পরিপ্রেক্ষিতে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় সরকারি হাসপাতাল রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ব্যাপক চাপ বেড়েছে। ঈদের পর থেকে হাসপাতালে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ভর্তি হওয়ার হার যেমন বেড়েছে, তেমনি সংক্রমণের পাশাপাশি বেড়েছে মৃত্যুও। এ অবস্থায় দেখা দিয়েছে চিকিৎসক সঙ্কটও। করোনা রোগীদের সামাল দিতে গিয়ে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পুরো রাজশাহী অঞ্চলে করোনার ভারতীয় ধরন সংক্রমণের আশঙ্কা করছেন।

রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা: সাইফুল ফেরদৌস জানান, ঈদের পর থেকে হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়তে শুরু করেছে। বেশ কিছুদিন ধরেই চাপ বেড়েই চলেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহীতে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ও করোনা উপসর্গে এক দিনে সর্বোচ্চ ১৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা সবাই রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে গতকাল শুক্রবার সকাল ৮টার মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়। রামেক হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় অর্থাৎ এক দিনে করোনায় এটিই সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে গত ৩০ মে সর্বোচ্চ ১২ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

ডা: সাইফুল ফেরদৌস জানান, মৃত্যু হওয়া ১৬ জনের মধ্যে ১০ জন করোনা পজিটিভ রোগী ছিলেন। আর অন্য ছয়জন করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। তারা সবাই করোনা ইউনিটে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃতদের মধ্যে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৯ জন, রাজশাহীর ছয়জন এবং নওগাঁ জেলার একজন রয়েছেন।

তিনি আরো জানান, ঈদুল ফিতরের পর থেকে উদ্বেগজনক হারে মৃত্যু ও সংক্রমণ বাড়ছে। গত ২৪ মে দুপুর থেকে ৪ জুন পর্যন্ত রামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে করোনা সংক্রমিত ছিলেন ৫৬ জন। অন্যদের করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত্যু হয়েছে।

ডা: সাইফুল ফেরদৌস জানান, হাসপাতালে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ভর্তি হয়েছেন ৩২ জন। শুক্রবার সকাল ১০টা পর্যন্ত ভর্তি আছেন ২২৫ জন রোগী।

এ দিকে দিন দিন করোনা ইউনিটে রোগী বেড়ে যাওয়ায় রামেক হাসপাতালে দেখা দিয়েছে চিকিৎসক সঙ্কট। করোনা রোগীদের সামাল দিতে গিয়ে সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। রামেক হাসপাতালের একটি সূত্র জানায়, কর্তৃপক্ষ ৩০ জন চিকিৎসকের চাহিদা দিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরে চিঠি পাঠিয়েছে। কিন্তু এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তবে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় করোনা রোগীদের জন্য হাসপাতালের বেড সংখ্যা ২৩২ থেকে বাড়িয়ে ২৬৪টি করার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে বলে সূত্রটি জানিয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রামেক হাসপাতালে রাজশাহী ছাড়াও চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, নওগাঁ, জয়পুরহাট, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহসহ বিভিন্ন জেলার রোগীরা চিকিৎসা নিতে আসেন। এখানে মোট শয্যা সংখ্যা এক হাজার ২০০টি। এর মধ্যে ২৩২টি কোভিডের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এতেও জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা রাজশাহী সদর হাসপাতালটি চালুর প্রস্তাব দিয়েছে রামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সদর হাসপাতালে রামেক হাসপাতালের কয়েকটি ওয়ার্ড পাঠিয়ে দেয়া গেলে এখানে কোভিডের ওয়ার্ড বাড়ানো যাবে। এ জন্য গত বৃহস্পতিবার দুপুরে বিভাগীয় কমিশনার ড. হুমায়ুন কবীর সদর হাসপাতাল পরিদর্শন করতে যান। এ সময় তার সাথে জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল, রামেক হাসপাতালের পরিচালকসহ গণপূর্ত অধিদফতরের কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

তারা আরো বলেন, রামেক হাসপাতাল ছাড়া রাজশাহীতে আর কোনো হাসপাতালে ওয়ার্ডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ লাইন নেই। থাকলে সেটাকে করোনার চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা যেত। তাই সব রোগীর চাপ রামেক হাসপাতালে। রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের রোগীরা এখানে আসছেন চিকিৎসা নিতে। এখন জায়গা সঙ্কুলানই বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে।

এ দিকে উদ্ভূত এ পরিস্থিতিতে সব করোনা রোগী রামেক হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না। এ প্রসঙ্কে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলছে, সব করোনা রোগীকে ভর্তি নেয়া হচ্ছে না। যেসব রোগীর অক্সিজেন সাচুরেশন কম বা অন্যান্য শারীরিক সমস্যা বেশি কেবল তাদেরই ভর্তি করা হচ্ছে। অন্য রোগীদের বাড়িতেই আইসোলেশনে থেকে চিকিৎসা নিতে হবে। এ ছাড়া এখন কোনো উপায় নেই।

স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে পুরো রাজশাহী অঞ্চলে করোনার কমিউনিটি সংক্রমণের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ ব্যাপারে বিভাগীয় স্বাস্থ্য দফতরের সহকারী পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা: নাজমা আক্তার সাংবাদিকদের জানান, যেহেতু এই এলাকার লোকজন চিকিৎসার জন্য রাজশাহীতে আসছেন, জীবিকার তাগিদে রাজশাহী হয়ে বিভিন্ন এলাকায় যাচ্ছেন এদের মাধ্যমে কমিউনিটি সংক্রমণের আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সংক্রমণ এড়াতে সবাইকে লকডাউন মেনে চলতে হবে। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার তাগিদও দেন এই স্বাস্থ্য কর্মকর্তা।

একাধিক সূত্রে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ আসছেন রাজশাহীতে। নানা কৌশলে তারা এসে উঠছেন নগরীতে। এ ক্ষেত্রে প্রধান রুট রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক। তা ছাড়া চাঁপাই থেকে রাজশাহী প্রবেশে এলাকার গ্রামীণ সড়কগুলোও নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার করছেন তারা। আমনুরা-তানোর আঞ্চলিক সড়ক হয়েও লোকজন আসছেন রাজশাহীতে। কিছু মানুষ ধানসুরা-নিয়ামতপুর, আড্ডা-পোরশা আঞ্চলিক সড়ক হয়েও চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়ছেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে যাওয়া এসব লোকজনের অধিকাংশই শ্রমজীবী। তাদের অধিকাংশই যাচ্ছেন রাজধানী ঢাকায়। কিছু অংশ যাচ্ছেন সিলেট ও চট্টগ্রামে। তারা বাড়িতে এসেছিলেন ঈদ করতে। কিন্তু লকডাউনে আটকা পড়ায় চরম বিপাকে পড়েন। আয় রোজগার না থাকায় বাধ্য হয়ে ঝুঁকি নিয়ে পথে নেমেছেন এসব লোকজন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/586302