৫ জুন ২০২১, শনিবার, ২:১৪

দেশে বিচারাধীন মামলা ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার

জট কমাতে কমিশন চান আইনবিদরা

করোনাভাইরাসের মহামারীর কারণে নিয়মিত আদালতের বিচারকার্যক্রম দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা বেড়ে গেছে। সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুযায়ী ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৩৯ লাখ ৩৩ হাজার ১৮৬টি। করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালে অতিরিক্ত দুই লাখ ৪৪ হাজার মামলা জমেছে। আইনবিদদের মতে, এ অবস্থায় বিচারাধীন মামলার জট কমাতে বিচার বিভাগের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দের পাশাপাশি বিচারকের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং দক্ষ আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে। আর বিপুলসংখ্যক মামলা নিষ্পত্তির জন্য একটা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন করা যেতে পারে। তারা সুচিন্তিত মতামত দেবেন কিভাবে মামলা নিষ্পত্তি করা যায়।

আইনবিদদের মতে, মামলা জট কমাতে প্রথমত দরকার সুশাসন। মামলার উৎপত্তিস্থল কমাতে হবে। মিথ্যা মামলা, রাজনৈতিক ও হয়রানিমূলক মামলার কারণে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। তাই মামলার জট কমাতে সুশাসনের পাশাপাশি সরকারের মহাপরিকল্পনা দরকার। আর যদি মামলাজট কমানো না হয় তাহলে বিচারের প্রতি মানুষের অনীহা জন্মাবে। একই সাথে আইনজীবীরা সুরক্ষা ব্যবস্থা রেখে সব আদালত খুলে দেয়া উচিত বলে মনে করেন।

সুপ্রিম কোর্টের তথ্য মতে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার। এ ছাড়া হাইকোর্টে প্রায় চার লাখ ৫৩ হাজার এবং আপিল বিভাগে ১৫ হাজার ২২৫টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের তথ্য মতে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের আদালতগুলোতে মোট বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল ৩৬ লাখ ৮৪ হাজার ৭২৮। আর এ সময়ের মধ্যে দেশের অধস্তন আদালতে বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ছিল প্রায় ৩১ লাখ ৭২ হাজার। এ ছাড়া হাইকোর্টে প্রায় চার লাখ ৮৯ হাজার এবং আপিল বিভাগে ২৩ হাজার ৬১৭।

আর করোনার কারণে দীর্ঘকাল আদালতের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় এ বছর মামলার জট আরো দীর্ঘ হতে পারে বলে আইনজীবীরা মনে করেন। তারা অবিলম্বে নিয়মিত আদালত খুলে দেয়ার দাবি জানান। তাদের মতে বিচারাধীন মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হওয়াও এক প্রকার অবিচার। আইনজীবীদের মতে, মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়ানোর জন্য নিম্ন আদালতের বিচারকের সংখ্যা দ্বিগুণ বাড়াতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের জন্য ১৮০০ বিচারক পর্যাপ্ত নয়। আর মামলার নিষ্পতির হার বাড়াতে দক্ষ আইন কর্মকর্তা নিয়োগ দিতে হবে।

বর্তমানে ভার্চুয়াল উচ্চ আদালতে আগাম জামিনের শুনানি বন্ধ রয়েছে। আর সুপ্রিম কোর্ট এবং অধস্তন আদালতের ভার্চুয়াল আদালতের কার্যক্রম গত ৪ এপ্রিল থেকে কেবল জামিন প্রার্থনা এবং অন্যান্য জরুরি মামলার শুনানির জন্য সীমিত আকারে পরিচালিত হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের স্পেশাল অফিসার ও মুখপাত্র মুহাম্মদ সাইফুর রহমান জানিয়েছেন, চলমান লকডাউনের মধ্যে ১২ এপ্রিল হতে ২ জুন পর্যন্ত মোট ৩৪ কার্যদিবসে সারা দেশে অধস্তন আদালত এবং ট্রাইব্যুনালে এক লাখ ছয় হাজার ২২২টি মামলায় জামিনের দরখাস্ত ভার্চুয়াল শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয় এবং মোট ৫৫ হাজার ৬৯ জন হাজতি অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিনপ্রাপ্ত হয়ে কারাগার মুক্ত হয়েছেন। আর ওই ৩৪ কার্যদিবসে ভার্চুয়াল আদালতের মাধ্যমে মোট ৮৪২ জন শিশু জামিন পেয়েছে। এর আগে ভার্চুয়াল আদালত শুরু হওয়ার পর প্রথম দফায় ২০২০ সালের ১১ মে থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত মোট ৫৮ কার্যদিবসে সারা দেশে অধস্তন আদালত এবং ট্রাইব্যুনালে ভার্চুয়াল শুনানিতে মোট এক লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৯টি ফৌজদারি মামলায় জামিন-দরখাস্ত নিষ্পত্তি হয় এবং ৭২ হাজার ২২৯ জন অভিযুক্ত ব্যক্তির (শিশুসহ) জামিন মঞ্জুর করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের তথ্যানুযায়ী ২০২০ সালে দেশের অধস্তন আদালতগুলোতে নতুন করে প্রায় দুই লাখ ৯৩ হাজার মামলা যুক্ত হয়েছে। কারণ একই বছর দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে নিষ্পত্তি হয়েছে ছয় লাখ ৯০ হাজার ২১টি মামলা। যেখানে একই বছর ১০ লাখ ৩০ হাজার ৩০০ নতুন মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর ২০১৯ সালে দেশের নিম্ন আদালতগুলোতে নিষ্পত্তি হয়েছে ১০ লাখ ২৪ হাজার ৩৫৭টি মামলা। যেখানে একই বছর ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৭২৪টি নতুন মামলা দায়ের করা হয়েছে। আর ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারাধীন মোট মামলার সংখ্যা ছিল ৩০ লাখ ৩২ হাজার ৬৫৬টি।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সভাপতি প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, বিভিন্ন কারণে করোনার প্রাদুর্ভাবের আগেই আমাদের বিচার বিভাগে বিপুল পরিমাণ মামলা ছিল। করোনার কারণে দীর্ঘ দিন আদালত বন্ধ ছিল। এ জন্য নিম্ন ও উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি হয়নি। করোনায় দীর্ঘদিন আদালত বন্ধ থাকায় মামলার ভয়াবহ মামলা জট তৈরি হচ্ছে। দীর্ঘদিন নিম্ন আদালত ও উচ্চ আদালতে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার কারণে সেই সঙ্কট একটা ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরাও দীর্ঘদিন ধরে কনডেম সেলে রয়েছে। এ জন্য সুরক্ষাব্যবস্থা রেখে সব আদালত খুলে দেয়া উচিত। আর মামলা নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে একটা উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন করা উচিত। তারা সুচিন্তিত মতামত দেবেন কিভাবে মামলা নিষ্পত্তি করা যায়। নতুবা বর্তমান অবস্থা যদি চলতে থাকে তাহলে বিচার বিভাগ ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে পড়বে ভেঙে পড়বে। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের প্রতি যতটা গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল, দুর্ভাগ্যবশত ততটা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। ফলে বিচার বিভাগ এখন সঙ্কটপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। বিচার বিভাগ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থায় আছে। মানুষ বিচার পাচ্ছে না। এ জন্যই মামলাজট কমাতে একটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিশন করা দরকার।

খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, বর্তমানে গণপরিবহনসহ সব কিছু খুলে দেয়া হয়েছে। অথচ বিচার বিভাগ এমন একটা অবস্থায় আছে যে, মানুষ বিচার না পেয়ে হতাশার মধ্যে রয়েছে। আমি মনে করি, দীর্ঘদিন যদি এ অবস্থা চলতে থাকে, আর মামলাজট কমানো না হয় তাহলে বিচারের প্রতি মানুষের অনীহা জন্মাবে, যা অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে। বর্তমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে স্বাস্থ্যবিধি ও সুরক্ষা দিয়ে কোর্ট খোলার ব্যবস্থা করতে হবে।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, মামলা জট কমাতে যে ধরনের মহাপরিকল্পনা দরকার সরকারকে সেরকম কোনো মহাপরিকল্পনা নিতে দেখা যাচ্ছে না। এ জন্য মামলার জট আমাদের জীবদ্দশায় কমবে বলে মনে হয় না, আরো বাড়বে। তিনি বলেন, হাইকোর্টে যে মামলা আছে তা শেষ করতে ২০ থেকে ৩০ বছর লেগে যেতে পারে। আর এ সময়েও আরো মামলা হবে। তিনি বলেন, মামলা জট কমাতে প্রথমত দরকার সুশাসন। মামলার উৎপত্তিস্থল কমাতে হবে। ফৌজদারি মামলা বেশি কেন হচ্ছে তা দেখতে হবে। মিথ্যা মামলা রাজনৈতিক ও হয়রানিমূলক মামলার কারণে মামলার সংখ্যা বাড়ছে। আর সরকার আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নিলে উচ্চ আদালতে রিটের সংখ্যা কমবে। তিনি বলেন, মামলা সৃষ্টির কারণ বন্ধ করতে না পারলে মামলা কমবে না বরং বাড়বে।

https://www.dailynayadiganta.com/first-page/586318/