৪ জুন ২০২১, শুক্রবার, ২:০৪

উন্নয়নের নামে করের বোঝা জনগণ আসলে কি পাচ্ছে?

আয় থেকে ব্যয় বেশির পরিকল্পনা করে বাজেট ঘোষণা করেছে সরকার। ঋণ আর করনির্ভরশীল এই বাজেটে আসলে জনগণ কি পাচ্ছে? উন্নয়নের নামে বাড়ছে বাজেটের আকার বাড়ছে করের বোঝাও। সবচেয়ে বড় সমস্যা এখন প্রয়োজনীয় রাজস্ব আহরণে ব্যর্থতা ও নাজুক আর্থিক খাত। সরকারের ঘরে টাকা নেই অথচ বিলাসিতার ব্যয় বেড়েছে। তারল্য সংকট থাকা সত্ত্বেও বিশাল ঘাটতি বাজেট কিভাবে বাস্তবায়নের পরিকল্পনাই বড় চ্যালেঞ্জ।

বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকার এই বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী কামাল।

এর মধ্যে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা তিনি রাজস্ব খাত থেকে যোগান দেয়ার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন, যা বাস্তবায়ন করা হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তারপরও তার আয় ও ব্যয়ের হিসাবে সামগ্রিক ঘাটতি থাকছে ২ লাখ ১৫ হাজার কোটি টাকার মত, যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় ঘাটতির এই পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৬.২ শতাংশের মত।

গত এক যুগে সরকার ঘাটতির পরিমাণ জিডিপির ৫ শতাংশের মধ্যে রেখে বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করলেও মহামারীর সঙ্কটে প্রণোদনার টাকা যোগানোর চাপ থাকায় গতবার তা ৬.১ শতাংশে পৌঁছায়। এবার তা আরও বড় হল।

আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে ধার করে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয়। সরকার বিদেশী সাহায্য ও বিদেশী ঋণ নিয়ে, দেশের সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে ধরা করে, জনগণের কাছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে সেই ঘাটতি পূরণ করতে পারে।

এবারের বাজেটের ছয় লাখ কোটি টাকা খরচ করতে হলে অর্থমন্ত্রীকে এক এক তৃতীয়াংশই ঋণ করতে হবে। সেজন্য বিদেশ থেকে ১ লাখ ১ হাজার ২২৮ কোটি টাকা এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা ঋণ করার পরিকল্পনা জানিয়েছেন কামাল।

অভ্যন্তরীণ খাতের মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ৭৬ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা, সঞ্চয়পত্র থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য খাত থেকে আরও ৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ধরা হয়েছে বাজেটে। এছাড়া বাজেটে সম্ভাব্য বৈদেশিক অনুদান পাওয়ার পরিমাণ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা।

ঋণের পরিমাণ বেড়ে গেলে অর্থনীতিতে বাইরে থেকে আসা তারল্য যোগ হয়। তাতে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বাড়ে। তাছাড়া সেই ঋণের জন্য সরকারকে সুদও গুণতে হয়।

আবার মন্দার মধ্যে ওই বাড়তি টাকার যোগান সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ে গতি আনতে পারে, তাতে স্থবির অর্থনীতিতে গতি আসার সম্ভাবনা তৈরি হয়।

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাজটের ঘাটতি আমি মনে করি কোনো সমস্যা না। কর থেকে সরকারের আয় কমবে। সেক্ষেত্রে বাজেটের ঘাটতি এমনিতেই বেড়ে যাবে। বর্তমান অবস্থায় সরকারকে বেশি ব্যয় করতেই হবে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বি আইডিএস) গবেষক এবং অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখতের পরামর্শ হল, আগে বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে ঘাটতির বড় অংশ পূরণের চেষ্টা করা এবং পরে প্রয়োজন বুঝে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণ নেয়া।

তিনি বলেন, আমাদের পাইপ লাইনে অনেক বিদেশী সাহায্য আছে, সেটা কাজে লাগাতে হবে। সরকারকে খুঁজে দেখতে হবে কীভাবে কম খরচে টাকা নেওয়া যায়।

সঞ্চয়পত্র থেকে ঘাটতি অর্থায়ন কমানোর পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বেশি, আর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিলে সেটা মূল্যস্ফীতির উপরে চাপ বাড়ায়। যেহেতু ব্যাংকে এখন তারল্য আছে, ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নিলে সটা সমষ্টিক অর্থনীতির উপর চাপ কম ফেলবে।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. সেলিম রায়হানের মতে, ঘাটতির চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল বাজেট বাস্তবায়ন।

গত বাজেটেও স্বাস্থ্যখাতসহ অন্যান্য অনেক খাতে অতিরিক্ত দেয়া হয়েছিল। এবার তা আরও বাড়িয়ে দেয়ংা হয়েছে। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের মূল বাজেটে বিদেশী ঋণের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৮৮ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে তা ৮০ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হয়।

গেল অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ছিল পাঁচ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা। মহামারির সঙ্কটে সেই গতিপথ ঠিক থাকেনি। সংশোধনে তা ৫ লাখ ৩৯ হাজার কোটিতে নামিয়ে আনতে হয়েছে।

এর মধ্যে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা তিনি রাজস্ব খাত থেকে যোগান দেওয়ার পরিকল্পনা সাজিয়েছেন, যা বাস্তবায়ন করা হবে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। রাজস্ব বহির্ভূত আয় ধরা হয়েছে ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এ টাকা জনগণের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ ভ্যাট আর করের মাধ্যমে আদায় করা হবে।

আবার ব্যয়ের নামে সারা বছরই চলে লুটপাট। স্বস্থ্য খাতে বরাদ্দ থাকলেও তা অপ্রতুল। এখানে সাধারণ মানুষ সেবা পায় খুবই কম। এখাতে সরকারের আয়ও হয়ে থাকে। তবে আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি হওয়াতে প্রতি বছরই ঘাটতি দিতে হচ্ছে।

একইভাবে কৃষি খাতে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ বরাদ্দ। সরকার বীজ, সার আর সেচ কাজে এ টাকা ব্যয় করে থাকে। অথচ কৃষি খাতে জিডিপির অবদান ১২ দশমিক ১৭ শতাংশ। তাহলে দেখা যাচ্ছে এ খাতে সরকারের ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি।

শিক্ষা খাতেও সরকারের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। আর এ কারণেই এ খাতে সর্বোচ্চ দ্বিতীয় বরাদ্দ। এখাতে থেকে সাধারণ জনগণ সরাসরি কোন টাকা পায় না। তবে প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষাবৃত্তি এবং ফ্রি বই পেয়ে থাকে।

সামাজিক নিরাপত্তা ও জনকল্যাণ খাতে মোট বরাদ্দ ৫.৭ শতাংশ। এখাত থেকে প্রায় সব টাকাই জনগণের হাতে পৌঁছে। তবে এখাতেও চেয়ারম্যান মেম্বাররা লুটপাট করেন।

বাজেটে বলা হয়েছে, কৃষির উন্নয়নের জন্য স্বাভাবিক বিনিয়োগের অতিরিক্ত হিসেবে কৃষিপণ্য রপ্তানির ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ নগদ প্রণোদনা ও কৃষি ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ চালিত সেচ যন্ত্রের ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ বিলের ওপর ২০ শতাংশ রিবেট প্রদান অব্যাহত থাকবে।

অনুদানসহ আগামী বাজেটের মোট আয় ধরা হতে পারে ৬ লাখ ৩ হাজার৬৮১ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) সংগ্রহ করতে হবে এর মধ্যে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা । এনবি আর-বহির্ভূত কর ব্যবস্থা থেকে আসবে ৪৩ হাজার কোটি টাকা।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, সবার আগে করের জাল বিস্তৃত করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। গ্রামাঞ্চলেও এখন অনেক লোক আছেন যারা কর দেয়ার যোগ্য, কিন্তু সরকার তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।

করপোরেট করের ক্ষেত্রে হিসাব কারসাজি রোধ করতে পারলেও সংগ্রহ বাড়বে বলে মনে করেন মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। তিনি বলেন, একদিকে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানের ভ্যাট নিবন্ধন নেই, আবার নিবন্ধন থাকলেও ইলেকট্রনিক ক্যাশ রেজিস্টার (ইসিআর) যন্ত্র ব্যবহার করে না। অন্যদিকে, এক পণ্য আমদানি করে শুল্ক ফাঁকি দিতে দেখায় আরেক পণ্য। এগুলো রোধ করতে পারলে রাজস্ব আয় বাড়বে।

বড় আকারের এডিপি নিয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, ব্যয়টা যে ঠিকভাবে ও ঠিক সময়ে হয় না, তার বহু দৃষ্টান্ত আছে দেশে। একটি উদাহরণ যদি দিই, ওই যে ডেমু ট্রেন কেনা হয়েছিল, ছয় বছর পরে আজ তা ভাগাড়ে পড়ে আছে। ব্যয়ের ক্ষেত্রে তাই সবার আগে অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে। দেখতে হবে যে ব্যয়টা প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখবে কি না বা দারিদ্র্য বিমোচনে সহায়ক হবে কি না।

জনগণের ঘাড়ে চাপবে এর মধ্যে ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকার কর বোঝা আর সে জনগণের কথা বলার ওপর কর বসানো হয়েছে। এবছর মোবাইল ফোনে কথা বলায় খরচ বাড়ছে। বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক দ্বিগুণ করা হয়েছে।

https://dailysangram.com/post/454386