৩ জুন ২০২১, বৃহস্পতিবার, ২:০৩

নিমতলী ট্র্যাজেডির ১১ বছর

রাত বাড়লেই বাড়ে আগুনের ভয়

পুরান ঢাকায় কত রাসায়নিক গুদাম, কেউ জানে না

‘আগে হাতি দেখলেও ভয় পেতাম না, এখন ব্যাঙ দেখলেই আঁতকে উঠি—অবস্থা হয়েছে এমন! পুরান ঢাকায় এমন কোনো বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে রাসায়নিকের গুদাম নেই। নিমতলী থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরলেও গড়ে উঠেছে জুতা ও প্লাস্টিকের বহু কারখানা, যেখানে মজুদ রয়েছে বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ।’ গতকাল বুধবার দুপুরে ৫৬ নম্বর নবাবকাটরা নিমতলী লেনে দাঁড়িয়ে কথাগুলো বলছিলেন মো. মামুন মিয়া।

২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনে ১২৪ জন মানুষের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। নিহতের এ তালিকায় রয়েছে মামুন মিয়ার শিশুসন্তান বৈশাখ। চোখের সামনে সাত বছরের সন্তানকে আগুনে অঙ্গার হতে দেখেছেন তিনি। আগুনে ঝলসে গিয়েছিল তাঁর শরীরও।

শুধু নিমতলীর মামুন মিয়া নন, আগুন-আতঙ্কে দিন কাটে গোটা পুরান ঢাকার মানুষের। দিনের আলো নিভে যাওয়ার পর এ আতঙ্ক আরো বাড়ে। লালবাগ থেকে হাজারীবাগ, চকবাজার থেকে সিদ্দিকবাজার—এমন কোনো গলি নেই, যেখানে রাসায়নিকের গুদাম নেই। তবে পুরান ঢাকায় ঠিক কী পরিমাণ রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে, সে বিষয়ে সুস্পষ্ট তথ্য নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কাছে। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের পর অনেক প্রতিশ্রুতি শোনা গেলেও বাস্তবায়িত হয়নি তার কিছুই।

পুরান ঢাকার বেশির ভাগ এলাকা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অঞ্চল-৪-এর আওতায়। এখানকার আঞ্চলিক কর্মকর্তা মো. হায়দার আলী গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ডিএসসিসি এলাকায় প্লাস্টিক, রাসায়নিক ও বিস্ফোরক দ্রব্য তৈরির কারখানার তালিকা করতে গত বছরের শেষ দিকে একটি জরিপ হয়েছিল। জরিপে প্রায় দুই হাজার কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়।

এই উদ্যোগের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে জরিপদলের প্রধান ও সিটি করপোরেশনের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা আরিফুল হক কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি।

ফায়ার সার্ভিস বিভাগও বলছে, পুরান ঢাকার প্রায় প্রতিটি এলাকা অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। প্রতিবছর ছোটখাটো অনেক অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটছে। তাদের তথ্যানুযায়ী, ২০১৮ সালে পুরান ঢাকায় গড়ে প্রতিদিন একটির বেশি অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটেছে। লালবাগ, হাজারীবাগ, সদরঘাট ও সিদ্দিকবাজার এলাকায় অন্তত ৪৬৮টি অগ্নি দুর্ঘটনা রেকর্ড করা হয় ওই বছর।

পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলিগলিতে সরেজমিনে ঘুরে অসংখ্য রাসায়নিকের কারখানা, দোকান ও গুদাম দেখা গেছে। এর বাইরে প্রায় প্রতিটি মুদি দোকানে বিক্রির জন্য মজুদ রাখা হয় দাহ্য পদার্থ। দোকানগুলো কোনো না আবাসিক ভবনের নিচে। এ কারণে এসব ভবনের বাসিন্দারা থাকে আতঙ্কে। এ ছাড়া অনেক গলির দুই পাশে রাসায়নিকের নানা ধরনের কারখানা রয়েছে। এর ফলে কোনো একটি গুদাম বা কারখানা থেকে আগুনের সূত্রপাত হলে দ্রুত তা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নবাবকাটরা সমাজকল্যাণ সংগঠন ও পঞ্চায়েতের সভাপতি হাজি মো. শহীদ মিয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, নিমতলী অগ্নিকাণ্ডের পরই সরকার ঘোষণা দিয়েছিল, পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের কারখানা, গুদাম ও দোকানগুলো সরিয়ে দেওয়া হবে। আসলে এটি কোনো দিনই সম্ভব হবে না। একেকটি ঘটনা ঘটলে সরকারি সংস্থাগুলো হুলুস্থুল শুরু করে দেয়। এক পর্যায়ে আবার সব কিছু থমকে যায়।

তিনি আরো বলেন, যেসব বাড়িতে রাসায়নিকের গুদাম রয়েছে, সেই বাড়ির সামনে লাল রঙের সাইনবোর্ড টানিয়ে সেটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা দেওয়া হোক। তাতে কিছুটা হলেও মানসিক পরিবর্তন আসতে পারে। এ ছাড়া রাসায়নিকের গুদাম থাকলে মোটা অঙ্কের জরিমানা করা হলে বাড়ির মালিকরা বিষয়টি নিয়ে হয়তো ভাববেন। পুরান ঢাকার মানুষ প্রতি মুহূর্তে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি নিয়ে বাস করে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

স্থানীয় আরো কয়েকজন প্রায় একই আশঙ্কার কথা জানান। তাঁরা বলেন, প্রতিটি রাতেই মনে হয় এই বুঝি কোথাও আগুন লাগল। কোনো না কোনো বাড়িতে আগুন লাগেই। ফলে কার বাড়িতে কখন আগুন লাগে, সেই ভয়ে থাকতে হয় গোটা পুরান ঢাকার মানুষকে।

তাঁরা বলেন, নিমতলীর পর চুড়িহাট্টা ও আরমানিটোলায় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায়ও অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এর বাইরে অনেক দুর্ঘটনা আলোচনায় না এলেও অনেকে এসব ঘটনায় মারা গেছে। অনেকে বয়ে বেড়াচ্ছে আগুনের ক্ষত।

নিমতলীর অগ্নিকাণ্ডের পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের ব্যবসা মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে স্থানান্তরে রাসায়নিক শিল্পনগর গড়ে তোলার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। ৯ বছরে প্রকল্পটি চূড়ান্ত করতে পারলেও বাস্তবায়িত হয়নি। এর মধ্যে ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ সময় রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে নেওয়ার ওপর জোর দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর গত বছরের ডিসেম্বরে গুদামগুলো স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তবে এখনো এর বাস্তবায়ন শুরু হয়নি।

জানা গেছে, শ্যামপুরে ৬.১৭ একর জমিতে ৫৪টি এবং টঙ্গীতে ৫৪টি রাসায়নিক গুদাম তৈরি করতে দুটি প্রকল্প নিয়েছিল শিল্প মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত অবকাঠামো নির্মাণকাজই শেষ হয়নি।

বেঁচে থাকলে তারুণ্যে পা রাখত বৈশাখ : সেদিনও ছিল বৃহস্পতিবার। ৫৬ নম্বর নবাবকাটরা নিমতলী লেনে ছোট্ট ফলের দোকানটিতে সাত বছরের বৈশাখকে নিয়ে খুনসুটিতে মেতে ছিলেন মামুন মিয়া। হঠাৎ আগুনের ফুলকি এসে পড়ে তাঁর দোকানে। মামুনের শরীর থেকে মাংস খসে পড়তে থাকে। পাশে তাকিয়ে দেখেন, তাঁর সাত বছরের বৈশাখ পুড়ে অঙ্গার।

মামুন মিয়া বলেন, ‘আমি এতটাই দুর্ভাগা যে চোখের সামনে ছেলেকে মরতে দেখতে হয়েছে। তার আর্তনাদ আজও আমার কানে বাজে। নিজেও জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকায় ছেলেকে মাটি দিতেও পারিনি।’ তিনি বলেন, ওই সময় বৈশাখের বয়স ছিল সাত বছর। বেঁচে থাকলে এখন সে ১৮ বছরের তরুণ হতো। এখন সে কেবলই স্মৃতি।

বুধবার যখন মামুন মিয়ার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন তাঁর ছোট্ট দোকানে বসে মোবাইল ফোনে খেলছিল আরেক ছেলে কায়সার। কায়সারের বয়স এখন সাত বছর। নিমতলী ট্র্যাজেডিতে হারিয়ে যাওয়া ভাই বৈশাখের মতোই দেখতে। এলাকার মানুষ তাই কায়সারকে ‘বৈশাখ’ নামেই ডাকে।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/first-page/2021/06/03/1039317