২ জুন ২০২১, বুধবার, ১:৪৩

ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে দেশ

দেশের ১৭ লাখ বহুতল ভবন ঝুঁকিপূর্ণ ওলট পালট করে দিতে পারে সিলেট! জরুরি মুহূর্তে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার মহড়া ও প্রশিক্ষণের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

সিলেটে টানা ছয় দফা মৃদু ভূমিকম্পের ঘটনায় সারা দেশে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এ ভূমিকম্পকে বড় ধরনের কোনো ভূমিকম্পের সতর্কসংকেত হিসেবে দেখছেন আবহাওয়াবিদ ও ভূতত্ত্ব বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশে যে কোনো সময় বড় ধরনের ভূমিকম্পের আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে ‘ডাউকি ফল্টে’ থাকা সিলেট বড় ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হতে পারে বলেও তারা জানিয়েছেন। ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে সিলেট হয়ে ভুটান পর্যন্ত ভূগর্ভে যে চ্যুতি আছে, তাতে বিপুল পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সেটি মৃদু ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে বিভিন্ন সময়ে করা জরিপে দেখা যায়, ঢাকায় মোট ১৩ লাখ, চট্টগ্রামে ৩ লাখ ও সিলেটে ১ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এসব ভবনের ৭৫ শতাংশ হচ্ছে ছয়তলা বা তার চেয়ে বেশি। ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে এই ভবনগুলো ও এর বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এদিকে দেশে ভূমিকম্পের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পরিকল্পিত নগরায়ণ এবং এই মুহূর্তে সরকারি-বেসরকারি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে মহড়ার মাধ্যমে দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার প্রশিক্ষণ জরুরি বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, ভূমিকম্পের অনেক সাংঘাতিক ঝুঁকির মধ্যে আছে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, ভূতাত্ত্বিক কাঠামো অনুযায়ী ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা তিনটি গতিশীল প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান। ৫০০ থেকে হাজার বছর ধরে প্রধান যে দুটি উৎসে শক্তি সঞ্চয় হয়ে আছে, আজ হোক কাল হোক তা বের হবেই। সিলেটে গত শনিবার ছয়টি এবং রোববার দুটি ভূমিকম্প সেই সঞ্চিত শক্তি বের হওয়ার ইঙ্গিত।

যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠা হয়েছে আর্থ অবজারভেটরি। এ প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলেন, সিলেটের জৈন্তা এলাকার ডাউকি ফল্টেই সকালের ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল হিসেবে আমাদের কেন্দ্রে আমরা চিহ্নিত করেছি। ডাউকি ফল্ট পূর্ব-পশ্চিমে প্রায় তিনশ কিলোমিটার বিস্তৃত এবং এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরেই পলিমাটি দিয়ে ঢাকা।

ভূমিকম্পের প্রবণতা নিয়ে ২০০৩ সাল থেকে গবেষণা করছেন অধ্যাপক হুমায়ুন আখতার। তিনি জানান, বাংলাদেশের দুই দিকের ভূগঠনে শক্তিশালী ভূমিকম্পের শক্তি জমা হয়েছে। তবে প্রথম ভূমিকম্পটি ভালোভাবে বোঝা গেলেও পরেরগুলো ছিল আরও মৃদু কম্পন অর্থাৎ খুবই হালকা ধরনের। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দুটি অঞ্চলে যেভাবে শক্তি সঞ্চিত হয়ে আছে বহুকাল ধরে তাতে আট মাত্রার পর্যন্ত ভূমিকম্প হতে পারে যদি একবারে হয়। হলে একবারেও হতে পারে আবার ভেঙে ভেঙে বা দফায় দফায়ও হতে পারে। কিন্তু কোন মাত্রার হবে, এটা আগে থেকে অনুধাবন সম্ভব না। তিনি বলেন, বারবার যেভাবে মৃদু কম্পন অনুভূত হয়েছে তাতে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বড় ধরনের কম্পনও অনুভূত হতে পারে। আবার নাও হতে পারে।

এদিকে, তথ্য-উপাত্তের সার্বিক বিশ্লেষণে ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে সিলেটে। সেই ঝুঁকির মাত্রা সম্প্রতি ৬ দফা মৃদু ভূমিকম্পে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ছড়িয়ে পড়েছে অজানা এক আতঙ্ক। কখন কি হয়, সেই নিয়ে দুঃচিন্তা। এ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার সিলেটে সিটি করপোরেশনের আহবানে এক সভায় বসেন নীতি নির্ধারকরা। শঙ্কিত পরিস্থিতি মোকাবেলা ও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাওয়া যায় সেই বিষয়টি বৈঠকে স্থান পেয়েছে। এছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ ভবন গুলোর ব্যাপারে প্রয়োজনীয় করণীয় নিয়েও কথা বলেছেন তারা।

সূত্র মতে, গত শনিবার মাত্র কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ৫ বার কেঁপেছিল সিলেট। এই ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল সিলেটে। পাশেই ডাউকি ফল্ট। ভূমিকম্পের ডেঞ্জার জোন। কিন্ত এসব কম্পন আসলেই কী প্রাকৃতিক ভূমিকম্প ছিল, নাকি ছিল কৃত্রিম কম্পন? এই কম্পনকে প্রাকৃতিক ভূকম্পন মানতে নারাজ অনেকে। ফেসবুকে অনেকেই লিখছেন শেভরণ তাদের জরিপ কাজের জন্য ভূগর্ভে মাইন বিস্ফোরণ ঘটানোর ফলে বারবার এরকম কম্পনের সৃষ্টি হয়েছে।

শেভরণের কমিউনিকেশন কর্মকর্তা শেখ জাহিদুর রহমান জানান, সিলেটে শেভরণের কোন জরিপ কাজ চলমান নেই। শেভরণ কোন মাইন বিস্ফোরণও ঘটায়নি। ভূকম্পনের সাথে শেভরণের কোন সম্পৃক্ততা নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে ভূমিকম্প নিয়ে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। এদিকে, সিলেট একদিকে ভূকম্পের উৎপত্তিস্থল ‘ডাউকী পয়েন্ট’-এর মাত্র ২শ’ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। অন্যদিকে শাহবাজপুর ফল্টও (ভূগর্ভস্থ প্লেটের ফাঁক, এটি হবিগঞ্জ-কুমিল্লা এলাকাধীন) সিলেটের কাছাকাছি। যে কারণে সিলেটের জন্য ভূমিকম্পের ঝুঁকি খুব বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ভূমিকম্পের ঝুঁকিভেদে তিনটি বলয় নির্ধারিত রয়েছে। তন্মধ্যে সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ তথা প্রথম বলয়েই সিলেটের স্থান। এ বলয়ে ৭-৯ মাত্রার ভূমিকম্প হতে পারে। ২০০৯ সালে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী- সিলেট অঞ্চলে ৫২ হাজার ভবন রয়েছে। তন্মধ্যে ২৪ হাজার ভবনই ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। জরিপের তথ্য দেখে ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা বিল্ডিং কোড অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনি পদক্ষেপ নেয়ার পরামর্শ দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। এদিকে সিডিএমপির জরিপে সিলেটে ভূকম্পের ঝুঁকিতে ২৪ হাজার ভবনের কথা উল্লেখ করা হলেও সিলেট সিটি করপোরেশন ও গণপূর্ত বিভাগের কাছে এ সম্পর্কিত সঠিক তথ্য নেই। ২০০৬ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশবিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, সিলেট মহানগরীতে শতাধিক প্রাচীন ভবন রয়েছে- যেগুলোর বয়স একশ’ থেকে দেড়শ’ বছর। এসব ভবন ভূমিকম্পের মারাত্মক ঝুঁঁকিতে রয়েছে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের মধ্যে রয়েছে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কর্মকর্তার কার্যালয়, কাস্টমস অফিস, জেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়, সিটি মার্কেট, সিলেট সাব পোস্ট অফিসের ফরেন রেমিটেন্স ভবন প্রভৃতি। এসব সরকারি ভবন ছাড়াও সিলেট মহানগরীতে এশিয়া মার্কেট, নেহার মার্কেট, সুরমা মার্কেট, মধুবন মার্কেট, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়, মিতালী মার্কেট, রহমান ম্যানসন সহ অসংখ্য ব্যক্তি মালিকানাধীন সুউচ্চ ভবন ভূকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে। ১৮৯৭ সালে সিলেট সহ আসামে বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই ভূমিকম্পে সিলেট ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট বিভাগের অধ্যাপক ড. জহির বিন আলম বলেন, ছোট ছোট ভূমিকম্প বড় ভূমিকম্পের বার্তা বহন করে। কয়েকদিন সবাইকে সতর্ক থাকা উচিত। এর মধ্যে বড় ভূমিকম্প হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তবে আরেকটি হচ্ছে, ঘন ঘন ভূমিকম্পের কারণে বড় ধরনের ভূমিকম্পের আতঙ্কও কেটে যায়। তিনি জানান, সবাইকে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। কারণ মনে রাখতে হবে ডাউকী ফল্ট এলোমেলো হলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ড. জহির বলেন, মাইন বিস্ফোরণে না সত্যিকারেই ভূমিকম্পে ঝাঁকুনি হয়েছে সিলেটে সেই বিষয়টি আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে চুড়ান্ত হয়ে যাবে। এনিয়ে কাজ চলছে বলেও জানান তিনি। তিনি বলেন, কোথায় কখন ভূমিকম্প হবে তা বলা মুসকিল। ভারতের মেঘালয়ের শিলং থেকে সিলেট হয়ে ভুটান পর্যন্ত ভূগর্ভে যে চ্যুতি আছে, তাতে বিপুল পরিমাণে শক্তি জমা হয়েছে। সেটি মৃদু ভূমিকম্পের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে বড় ভূমিকম্পের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেকারনে ভূমিকম্প হলে এ চিন্থিত স্থানেই উৎপত্তি হয়ে আঘাত হানবে। সিসিক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী জানিয়েছেন, ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলায় মুলত ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে এখন সিলেটে। গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিভাগকে এ নিয়ে সতর্ক থাকার কথা বলা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের নিয়ে করা হয়েছে বৈঠক। এছাড়া নগরবাসীকে সচেতন হতে হবে। ভূমিকম্প হলে হুড়োহুড়ি না করতে নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

https://www.dailyinqilab.com/article/386107/