২ জুন ২০২১, বুধবার, ১:২০

বন্দুকযুদ্ধেও থামছে না ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য

দশদিন আগে রাজধানীতে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই ছিনতাইকারী নিহত হয়েছে। এর কয়েকদিন আগে কেরানীগঞ্জে আরেক ছিনতাইকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলীতে নিহত হয়। এছাড়াও ছিনতাইকারী ধরতে রাজধানীতে পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলছে। একমাসে গ্রেফতার হয়েছে ছিনতাইকারী চক্রের কয়েক ডজন সদস্য। এরই মধ্যে প্রকাশ্যে একজন মন্ত্রীর মেবোইল ফোন ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। বিজয় সরণি এলাকা থেকে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের হাত থেকে তার দামি মোবাইল ফোন (আইফোন) ছিনতাই হয়েছে। সামনে-পেছনে গানম্যান থাকার পরও কথা বলার সময় মন্ত্রীর গাড়ির জানালার ভেতরে হাত ঢুকিয়ে ছিনতাইকারী তার মোবাইল ফোনটি কেড়ে নিয়ে যায়। এ ব্যাপারে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত পরিকল্পনামন্ত্রীর ছিনতাই হওয়া আই ফোনটি উদ্ধার করা যায়নি।
জানা গেছে, সাম্প্রতিককালে রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়ে গেছে। দিনে-দুপুরেও যেখানে-সেখানে ছিনতাই হচ্ছে। নগদ অর্থ, গহনাগাটি, মোবাইল ও অন্যান্য জিনিসপত্র অবলীলায় ছিনতাই হয়ে যাচ্ছে। ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়ে গেছে যে, পথে-ঘাটে কেউই নিরাপদ বোধ করছে না। এরা এতটাই বেপরোয়া হয়ে উঠেছে যে এখন রাস্তাঘাটে নয় যাত্রীবাহী বাসে, রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে ধারালো অস্ত্রের মুখে টাকা, স্বর্ণালঙ্কার, মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নিচ্ছে। তবে সব ছিনতাইয়ের মামলা হয় না বিধায় পুলিশের কাছে প্রকৃত পরিসংখ্যানও নেই। ছিনতাইয়ের সাথে যুক্ত থাকার গুরুতর অভিযোগ উঠেছে সিএনজি অটো রিকশা ও বাসের চালক হেলপারের বিরুদ্ধে। বাসে চালকদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ছিনতাই এবং শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে পকেটমারের কথাও বলা যায়। রাতে গ্যাং ছিনতাই বেশি হচ্ছে। সেই সাথে একথাও স্বীকার করতে হবে, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সতর্ক নজরদারীর কারণেই কিছুদিন আগেও এধরনের উপদ্রব থেকে খানিকটা মুক্তি পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু আবার এ ধরনের ঘটনা বেড়েছে।

জানা গেছে, এরআগে রাজধানীর অপরাধপ্রবণ বেশ কিছু এলাকা চিহ্নিত করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ নগরীর ১৪১ স্পটকে ছিনতাই ও অপরাধপ্রবণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। বর্তমানে এই স্পটের সংখ্যা আরও বেড়েছে বলে জানা গেছে। পুলিশ জানায়, রাজধানীর ৪৯ থানা এলাকায় অপরাধপ্রবণ বেশকিছু এলাকা চিহ্নিত করা হয়েছে। ওইসব স্পটে বাড়তি নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিভিন্ন সড়কে এখন সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা রয়েছে। এছাড়াও প্রতিনিয়ত থানা এলাকাগুলোতে টহল পুলিশ ও সাদা পোশাকে পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। পাশাপাশি সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। এর ফাঁকে কোনো ঘটনা ঘটলে সেগুলো বিচ্ছিন্ন বলে উল্লেখ করেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

পুলিশের তালিকায় অপরাধপ্রবণ ১৪১ স্পটগুলো হলো- নিউ ইস্কাটন রোড, ইস্কাটন গার্ডেন রোড, দিলু রোড, কাকরাইল মোড়, মৎস্য ভবন এলাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দোয়েল চত্বর ও কাঁটাবন। দিলকুশা বাণিজ্যিক এলাকা, বলাকা চত্বর, দৈনিক বাংলা মোড়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ এলাকা, কমলাপুর রেলস্টেশন এলাকা, ফকিরাপুল, রেলওয়ে হাসপাতাল রোড, পীরজঙ্গি মাজার, শান্তিনগর মোড়, নটর ডেম কলেজ গেট, ফকিরাপুল গরম পানির গলি, রাজারবাগ টেলিকম ভবনের সামনের রাস্তা, ইত্তেফাক মোড়, নয়াপল্টন ভাসানী গলি, পুরানা পল্টনের মল্লিক প্লাজার সামনে ও আরামবাগ। এদিকে উত্তরার ১১ ও ১৩ নম্বর সেক্টরের কয়েকটি সড়ক, আবদুল্লাহপুর, হাউসবিল্ডিং, জসীমউদ্দীন রোড, বিমানবন্দর গোলচত্বর ও রেলস্টেশন এলাকা। খিলগাঁও-রামপুরা-বাড্ডার গোড়ান, মালিবাগ, চৌধুরীপাড়া, খিলগাঁও ওভারব্রিজ, পল্লীমা সংসদ এলাকা, ভূঁইয়াপাড়া বালুর মাঠ, রামপুরা ব্রিজ, টিভি রোড, মেরুল বাড্ডা বাজার, উত্তর বাড্ডা থানা রোড, দক্ষিণ বাড্ডা, কুড়িল বিশ্বরোড, আফতাবনগর লোহার ব্রিজ, মধ্য বাড্ডা ব্যাপারী গলি, বাজার গলি, পূর্ব বাড্ডা কবরস্থান রোড ও লিঙ্ক রোড।

যাত্রাবাড়ী-কদমতলী-শ্যামপুরের বিবির বাগিচা, কুতুবখালী, উত্তর যাত্রাবাড়ীর কলাপট্টি, দয়াগঞ্জ মোড়, কাজলার পাড়, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল, জনপদ সড়ক, ধলপুর সিটিপল্লি, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ীর কবরস্থান রোড, যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের আশপাশে, মানিকনগর, মীর হাজীরবাগ ঘুণ্টিঘর, জুরাইন বালুর মাঠ, কুদার বাজার, মেডিকেল রোড, কদমতলী ওয়াসা রোড, নামা শ্যামপুর। গুলশান-বনানীর গুলশান লেকপাড়, নিকেতন, শুটিং ক্লাবের সামনে, কাকলী মোড়, বনানী কাঁচাবাজার রোড, কড়াইল বস্তি, বনানী উড়াল সড়ক, সৈনিক ক্লাব ও চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকা। ধানমন্ডি-মোহাম্মদপুরের ধানমন্ডির আট নম্বর ব্রিজ, জিগাতলা বাসস্ট্যান্ড, কলাবাগান খেলার মাঠ, সার্কুলার রোড (ভূতের গলি), মিরপুর সড়ক, মোহাম্মদপুরের আসাদ এভিনিউ, আওরঙ্গজেব রোড, কাঁটাসুর, বাঁশগাড়ি, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল কলেজ এলাকা, আদাবর ১৪ নম্বর সড়ক, বায়তুল আমান, রিং রোড ও হাজারীবাগ বেড়িবাঁধ। মহাখালী-তেজগাঁওয়ের মহাখালী বাসস্ট্যান্ড, কাঁচাবাজারের সামনে, তিব্বত মোড়, উত্তর বেগুনবাড়ী, হাতিরঝিল, মগবাজার মোড়, মালিবাগ সুপার মার্কেটের সামনে, কারওয়ান বাজার, গ্রিনরোড, ইন্দিরা রোড সংলগ্ন টিঅ্যান্ডটি কার্যালয়ের পেছনের গলি। মিরপুরের মিরপুর বেড়িবাঁধের শাহ আলী মোড় থেকে ধউর, মিরপুর-১ নম্বর গোলচত্বর, মিরপুর-১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ড, দক্ষিণ মণিপুর, বাউনিয়া বাঁধ, বিহারি কলোনি, আগারগাঁও মোড়, আইডিবি ভবনের সামনে, কল্যাণপুর হাউজিং এস্টেটের পাশের সড়ক, শেরেবাংলা নগরের বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রের সামনের সড়ক, আগারগাঁও ক্রসিং, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, দারুস সালাম, মাজার রোড। ও পুরান ঢাকার চানখাঁরপুল, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, নিমতলী, সদরঘাট, বাবুবাজার, কাজী রিয়াজ উদ্দিন রোড, ধোলাইখাল, শহীদনগর ও কামরাঙ্গীরচর।

জানা গেছে, গত ১৭ মে রাতে রাজধানীর খিলক্ষেতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে দুই ছিনতাইকারী নিহত হয়। এ সময় আহত হয়েছেন আরও দুজন। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ছিনতাই, মাদক ও হত্যা মামলা রয়েছে। পুলিশ জানায়, রাত আড়াইটার দিকে খিলক্ষেত ৩০০ ফিট এলাকায় বন্দুকযুদ্ধের এ ঘটনা ঘটে। নিহত দুজনের নাম রাসেল ও এনামুল। ডিবি পুলিশ জানিয়েছে, পুলিশের একটি দল কাওলা হয়ে পূর্বাচলগামী ফ্লাইওভারের প্রবেশমুখে এবং অপর দলটি পূর্বগামী ফ্লাইওভারের মাঝে অবস্থান নিয়ে তল্লাশী করছিল। রাত অনুমানিক সোয়া ২টার দিকে কাওলা থেকে বিশ্ব রোডের দিকে একটা সবুজ রঙের সিএনজি অটোরিকশা কয়েকজন লোক নিয়ে যাচ্ছিল। চেকপোস্টে অটোরিকশাটিকে থামতে বলা হলে তারা ৩০০ ফিট ফ্লাইওভারের ওপর দিয়ে পূর্বাচলের দিকে পালানোর চেষ্টা করে। ডিবি পুলিশের দলটি ব্রিজের মাঝে থাকা দ্বিতীয় দলকে ওয়ারলেস দ্বারা সতর্ক করলে তারা তাদের মাইক্রোবাসকে আড়াআড়ি দাঁড় করিয়ে দেয় এবং প্রথম দলটি সিএনজি অটোরিকশাকে ধাওয়া করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর ব্যারিকেডে দু’জন সন্ত্রাসী অটোরিকশা থেকে নেমে দৌড়ে সামনে যেতে থাকে এবং পুলিশের মাইক্রোবাস আড়াআড়ি দেখে সেটিকে লক্ষ্য করে গুলী ছোঁড়ে। এতে দুই পক্ষের গোলাগুলীতে দুই ছিনতাইকারী রিহত হয়। তাদের কাছ থেকে ইয়াবা, আগ্নেয়াস্ত্র, একটি পুরাতন কিন্তু ধারালো ছুরি, মোবাইল, গামছা ও মলম উদ্ধার করা হয়। এরআগে ৩ মে ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলায় গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে এক ছিনতাইকারী’ নিহত হয়। দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের করেরগাঁও এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

এদিকে পুলিশের তথ্যে জানা যায়, ২৬ মে রাজধানীর খিলগাঁও এলাকা থেকে মো. সুমন নামে সংঘবদ্ধ সিএনজি ছিনতাই চক্রের এক সদস্যকে আটক করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন র‌্যাব। র‌্যাব-৩ এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বীনা রানী দাস জানান, এ চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় সিএনজি চুরি কিংবা ছিনতাইয়ের কাজ করে আসছিল। পরবর্তীতে তারা চুরি করা সিএনজির ইঞ্জিন ও চেসিস নাম্বার পরিবর্তনের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় তা বিক্রি করতো। এই চক্রের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে চোরাই সিএনজি ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত। চক্রের অন্যান্য সদস্যদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। গত ৮ মে রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে সংঘবদ্ধ ছিনতাই চক্রের ২৩ সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। র‌্যাবের সিনিয়র সহকারী পরিচালক (এএসপি) ইমরান খান বলেন, গ্রেফতারকৃতরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সময় অস্ত্র ঠেকিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা, মোবাইল ফোন, ব্যাগসহ নানা মূল্যবান মালামাল ছিনিয়ে নিত।

https://dailysangram.com/post/454184