১ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:১৯

ইসরাইল মিসর হামাস ও মধ্যপ্রাচ্য

অবলোকন

ইথিওপিয়ায় নীল নদের উৎসে বিতর্কিত বাঁধ নির্মাণ আর ইসরাইলের ওপর দিয়ে সুয়েজের বিকল্প খাল তৈরি করে মিসরকে চেপে ধরার ইসরাইলি কৌশল কি দেশটির জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াল। ইসরাইলের মধ্যপ্রাচ্য বিশারদরা গাজায় ইসরাইলের সামরিক বিপর্যয়ের পর এমন প্রশ্ন উত্থাপন করছেন। ইসরাইলের অনেক বিশ্লেষকই মনে করছেন, গাজার সাথে ইসরাইলের সর্বশেষ যুদ্ধে মিসর ও সুদান দুটি দেশই ইসরাইলকে আশানুরূপ সহযোগিতা দেয়নি। অধিকন্তু এটাও বলা হচ্ছে যে, হামাসের সাথে গোপন কোনো যোগসূত্র মিসরের না থাকলে তারা এভাবে ইসরাইলে রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে পারত না যার জের ধরে মধ্যপ্রাচ্যের নতুন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

পুরনোদের বাদ দিয়ে নতুন প্রেম!
ইসরাইলের সাথে ১৯৭৮ সালের ‘ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি’র মধ্য দিয়ে মিসর এবং ১৯৯৩ সালে শান্তিচুক্তি দিয়ে জর্দানের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। তবে ট্রাম্পের আমলে আরব আমিরাত ও বাহরাইনসহ কয়েকটি আরব দেশের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর পুরনো কূটনৈতিক সম্পর্কে সম্পর্কিত দেশগুলোর সাথে এক ধরনের বৈরী আচরণ শুরু করে ইসরাইল। এর মধ্যে মসজিদুল আকসার স্বীকৃত খাদেম হিসেবে জর্দানকে বাদ দিয়ে অন্য কোনো দেশকে স্থলাভিষিক্ত করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। আর ট্রাম্পের কথিত শান্তিচুক্তির বিষয়ে জর্দানকে রাখা হয় অনেকটাই অন্ধকারে। এরপর আবার জর্দানে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বাদশাহ আব্দুল্লাহকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করা হয়। ফলে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সাথে শান্তিচুক্তি-পরবর্তী সবচেয়ে খারাপ সম্পর্ক তৈরি হয় জর্দানের।

জর্দানের সাথে বৈরী এ আচরণের চেয়েও মিসরের পদক্ষেপগুলো ছিল আরো মারাত্মক। মিসরের অর্থনীতির প্রাণ হলো, নীল নদের মিঠাপানির প্রবাহ আর সুয়েজ খালের জাহাজ পারাপারের আয়। মিসরের আয়ের এই দুটি বড় উৎসকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে ইসরাইল স্থায়ীভাবে দেশটিকে তেলআবিবের করুণানির্ভর করার পরিকল্পনা করেছে।

নীলের প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ
ইথিওপিয়ার সুউচ্চ পর্বতমালার হ্রদ ও ঝর্ণা থেকে উৎপন্ন, নীল নদের প্রবাহের বড় অংশটি মিসরের ওপর দিয়ে ভূমধ্যসাগরে পড়েছে। পানীয় জল ও কৃষির জন্য মিসরকে প্রধানত নীল নদের ওপর নির্ভর করতে হয়। এ নদের উৎসমূলে ‘রেনেসাঁ বাঁধ’ নামের এক বিশাল বাঁধ তৈরির কাজ শুরু করে ইথিওপিয়া ২০১১ সালে। আর এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অর্থের জোগান দেয় ইসরাইল ও ইহুদি লগ্নিকারকরা। ইসরাইল এখানে বিনিয়োগ করায় সংযুক্ত আরব আমিরাতকে দিয়েও। এখানে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ইথিওপিয়াকে সমৃদ্ধ করলেও তা মিসর ও সুদানকে নীলের ন্যায্য পানি থেকে বঞ্চিত করবে। এ জন্য এ বাঁধ চালু করার আগেই মিসর ও সুদান দুই দেশই চেয়েছিল ইথিওপিয়ার সাথে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করতে, যাতে দেশ দুটি নীল নদের প্রয়োজনীয় পানি থেকে বঞ্চিত না হয়।

বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এই নদের পানির ওপর নির্ভর করে ১১টি দেশ। তার মধ্যে রয়েছে বুরুন্ডি, কঙ্গো গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, মিসর, ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, রুয়ান্ডা, সুদান, দক্ষিণ সুদান, তানজানিয়া এবং উগান্ডা। মিসরের মিষ্টি পানির ৯৬ শতাংশেরও বেশি নীল নদের মাধ্যমে আসে। সুদান ও মিসরের মধ্যে ১৯৫৯-এ স্বাক্ষরিত একটি চুক্তির মাধ্যমে নীলের মিঠা পানির বরাদ্দ ঠিক করা হয়। এই চুক্তি অনুসারে মিসর ও সুদানকে প্রতি বছর ৫৫.৫ বিলিয়ন কিউবিক মিটার (বিসিএম) এবং ১৮.৫ বিসিএম পানি দেয়া হয়। আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্যার সময় প্রধান নীল নদের পানির বেশির ভাগ অংশ ‘নাইল’ নীল এবং আটবারা হয়ে ইথিওপীয় মালভূমি থেকে আসে। ইথিওপিয়ার উপ-নদীগুলো নীল নদের পানি সরবরাহ করে প্রায় ৮৬ শতাংশ।

২০১১ সালে, ইথিওপিয়া সুদান থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার দূরে এবং আদ্দিস আবাবার উত্তর-পশ্চিমে নাইল নীল নদের ওপরে গ্র্যান্ড ইথিওপীয় রেনেসাঁ বাঁধের (জিইআরডি) নির্মাণ কাজ শুরু করে। বাঁধের জলাধারটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪০৪০ মিটার উপরে পূর্ণ সরবরাহ স্তরে ১৮৭৪ বর্গকিলোমিটার অঞ্চলজুড়ে থাকবে ৭৪৪ বিসিএমের সক্রিয় জলাধার। এই বাঁধ নির্মাণ সম্পর্কে একটি বড় উদ্বেগ হলো, এর জলাশয় পূরণের সময়কালে নীল নদের পানি থেকে মিসর এর কত অংশ পাবে।

ইথিওপিয়া এর মধ্যে রেনেসাঁ বাঁধ স্থাপন করে প্রথম পর্যায়ের জলাধার ভরার কাজ সম্পন্ন করার পর দ্বিতীয় দফা জলাধার ভরতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এ কারণে নীলের পানিপ্রবাহ অনেকখানি কমে গেছে। মিসর ও সুদান দুই দেশই চেয়েছিল দ্বিতীয় দফা পানি প্রত্যাহারের আগে সংশ্লিষ্ট চুক্তি সম্পন্ন করার জন্য। আর এ জন্য আফ্রিকান ইউনিয়ন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার প্রস্তাবও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইথিওপিয়ার একগুঁয়ে মনোভাবের জন্য সব আলোচনাই ব্যর্থ হয়েছে।

অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র শক্তির দেশ হয়েও ইসরাইলের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে ইথিওপিয়া পাল্টা হুমকি দিতেও কসুর করছে না। এই অবস্থায় মিসর এক সিদ্ধান্তকারী প্রান্তিক অবস্থায় পৌঁছে যায় আর সমঝোতা ছাড়া নীলের পানি প্রত্যাহার করলে শক্তি প্রয়োগের বিষয় বিবেচনায় আনতে শুরু করেছে। ইসরাইল সুকৌশলে বাঁধ নির্মাণের বিনিয়োগে আরব আমিরাতকেও সম্পৃক্ত করেছে।

সুয়েজের প্রাণ সংহার!
এ অবস্থাতেই ইসরাইল আরেকটি উদ্যোগ নিয়ে মিসরের অর্থনীতির জন্য ভয়ঙ্কর বার্তা দিতে শুরু করেছে। সুয়েজ খাল থেকে মিসর প্রতি বছর পাঁচ থেকে ছয় বিলিয়ন ডলার রাজস্ব আহরণ করে থাকে। সম্প্রতি সুয়েজ খালে একটি কার্গোবাহী জাহাজ আড়াআড়িভাবে আটকা পড়লে ছয় দিনের জন্য জাহাজ পারাপার বন্ধ হয়ে যায়। সৃষ্টি হয় বিপুল জাহাজ জট। ঠিক এ সময়টাতে ইসরাইলের সুয়েজ খালের বিকল্প একটি খাল খননের প্রস্তাব আলোচনায় চলে আসে। ইসরাইল সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে যৌথ উদ্যোগে সিনাই উপত্যকার পাশ দিয়ে সুয়েজের বিকল্প হিসেবে জাহাজ আসা-যাওয়ার একটি খাল খননের প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইছে।

সুয়েজ খালের বিকল্প হিসেবে ইসরাইলের লোহিত সাগরের বন্দর ইলাতকে ভূমধ্যসাগরে সংযুক্ত করার জন্য এই খাল খননের পরিকল্পনা করা হচ্ছে । একেবারে ‘ইউটোপিয়ান’ না হলেও ইসরাইল ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রকল্পটি বাস্তবায়ন বেশ ব্যয়সাধ্য বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কয়েক শ’ মিটার উঁচু পাহাড় কেটে সিনাই উপদ্বীপের পূর্ব প্রান্তের প্রায় ২৫০ কিলোমিটার (১৫৫ মাইল) পূর্বদিকে খাল খনন করতে গেলে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। সুয়েজ খাল এই রুটের চেয়ে ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) ছোট এবং উচ্চতা মাত্র ১০০ মিটার (৩২৮ ফুট) পর্যন্ত। মিসর সুয়েজ খালের সমান্তরালে একটি নতুন খাল নির্মাণ করতে চাইলে ইসরাইল-সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকল্প ব্যয়ের এক-তৃতীয়াংশে বিদ্যমান খালটিকে প্রসারিত করতে পারে।

আনুমানিক ১২ শতাংশ বিশ্ব সামুদ্রিক বাণিজ্য সুয়েজ খালের মধ্য দিয়ে পরিবহন করা হয়, তবে এই রুটটি একেবারে অনিবার্য নয়। ১৯৫৬ সালে ব্রিটেন, ফ্রান্স এবং ইসরাইল এই খালটি দখল করার পর প্যাসেজ কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেলে বিকল্প পথে নৌবাণিজ্য অব্যাহত ছিল। ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে ইসরাইল যখন খালটি দখল করে, তখন আবার সুয়েজ পথ বন্ধ হয়ে যায় এবং এই পরিস্থিতি আট বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তখনও বিকল্প পথে বাণিজ্য হয়েছে। তবে এই রুটের জন্য বেশি জ্বালানি ও সময় ব্যয় হয়, যদিও এতে বিশ্ব বাণিজ্যে কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হয় না।
ইসরাইলের প্রস্তাবিত এবং বিপুল ব্যয়ে গ্রহণ করা, সুয়েজ খালের এই বিকল্প ক্যানেল মিসরীয় অর্থনীতির জন্য এক ধরনের মৃত্যু পরোয়ানার শামিল।

উপেক্ষা এবং এরপর-
এমনিতেই বিগত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের তথাকথিত শান্তিচুক্তির সময় সমঝোতার ব্যাপারে সৌদি আরব ও আমিরাতসহ উপসাগরীয় দেশগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে তাদের সাথেই মূল আলোচনা করা হয়েছে। উপেক্ষিত থাকে মিসর ও জর্দানের মতো দেশ। তখন ধরে নেয়া হয়, সৌদি আরব ও ইউএই ইসরাইলের সাথে থাকলে অন্য কারো কিছু করার থাকবে না। মিসর ও জর্দান এটিকে মোটেই ভালোভাবে নেয়নি।
গোয়েন্দা পর্যায়ে ইরান ও তুরস্ক দুই দেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে মিসর। ইসরাইল যেখানে লিবিয়ার ব্রাদারহুড ইস্যুকে কেন্দ্র করে তুরস্কের সাথে যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছে এবং ভূমধ্যসাগর প্রশ্নে গ্রিস সাইপ্রাস বলয়ে মিসরকে আটকাতে চেয়েছিল, সেখানে মিসর ও তুরস্ক সঙ্ঘাত থেকে সরিয়ে নিজেদের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক নির্মাণের চেষ্টা করছে। এ ব্যাপারে অনানুষ্ঠানিক পর্ব পেরিয়ে তুরস্ক-মিসর আনুষ্ঠানিক আলোচনায় প্রবেশ করেছে।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী পর্যায়ের আলোচনায় দুই দেশের দূরত্ব ও বিরোধ কাটিয়ে সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বেশ অনেক দূর অগ্রসর হয়েছে তুরস্ক-ইসরাইল। ইসরাইল যেখানে মিসরের প্রয়োজনীয় নীল নদের পানি প্রত্যাহার এবং সুয়েজ খালের বিকল্প নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সেখানে তুরস্ক ভূমধ্যসাগরের তেল গ্যাস অনুসন্ধানে সহযোগিতা দানের প্রস্তাব করেছে কায়রোকে।

মিসরের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফলে গত ২১ মে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমন্বিতভাবে করা এই চুক্তিতে ১১ দিনের প্রচণ্ড লড়াই শেষ হয়েছে। সঙ্ঘাত চলাকালে ফিলিস্তিনিদের শক্তিশালী রাজনৈতিক সমর্থন দিয়েছে মিসর। মিসরীয় রাষ্ট্রপতি আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে সেনা অভিযান বন্ধ করতে এবং একটি স্বাধীন ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য ইসরাইলের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানান। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট বাইডেন এ সময় প্রথম মিসরীয় প্রেসিডেন্টের সাথে ফোনে কথা বলেছেন।

ইসরাইলের হামলার পরে হামাস শাসিত গাজা উপত্যকা পুনর্গঠনের জন্য আল সিসি ৫০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ও দীর্ঘমেয়াদি শান্তিকে সুরক্ষিত করার লক্ষ্যে মিসরীয় রাষ্ট্রপ্রধান ২০ মে গাজা ও ইসরাইলে দুটি নিরাপত্তা প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। এ ছাড়া মিসরীয় সরকার গাজায় সহায়তার জন্য বোঝাই করা ১৩০টি ট্রাকের একটি বিশাল সহায়তা কাফেলাও পাঠিয়েছে আর চিকিৎসা পাওয়ার জন্য আহত ফিলিস্তিনিদের প্রবেশের অনুমতি দিতে গাজার রাফাহ সীমান্ত ক্রসিংটি পুনরায় চালু করেছে। এই ক্রসিংটি মিসরের সিনাই উপদ্বীপের সাথে গাজা ভূখণ্ডের সংযোগ স্থাপন করেছে।

মিসরের ওপর ইসরাইলের চাপ সৃষ্টির নানা উদ্যোগ নেয়ার পর হামাসের বিষয়ে দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে আলোচনায় সুর পরিবর্তনের বিষয়টিও লক্ষ্য করা যায়। বেশির ভাগ সংবাদপত্রই ইসলামী দল এবং অন্যান্য সশস্ত্র দলকে প্রতিরোধ আন্দোলন এবং ইসরাইলকে দখলদার হিসেবে অভিহিত করেছে। রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে হামাসের আগের নেতিবাচক কভারেজ থেকে এটি একটি বড় অগ্রগতি ছিল। হামাসের বিরুদ্ধে, মিসরের জাতীয় নিরাপত্তাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা এবং মুসলিম ব্রাদারহুডকে সহযোগিতা করার কথা বলে ২০১৩ সালে কায়রো হামাসকে ‘কালো তালিকা’ভুক্ত করেছিল। নতুন পরিস্থিতিতে মিসরীয় সরকার হামাসের সাথে তার মতের পার্থক্যকে এক পাশে সরিয়ে রেখেছে।
মিসরের কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার জন্য হামাসের রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়ার ২০১৩ সালে কায়রো সফরের পর মিসর ও হামাসের সম্পর্ক উষ্ণ হতে শুরু করে। এই সফরের পরে, কায়রো আন্তঃফিলিস্তিন দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য ফিলিস্তিনি দলগুলোর মধ্যে সংলাপের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেছিল।

কায়রোর সাথে সম্পর্কের উন্নতির লক্ষণ হিসেবে হানিয়া ফিলিস্তিনিদের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেয়ায় এবং ইসরাইলি আক্রমণ রোধে মিসরীয় ভূমিকার জন্য মিসরকে ধন্যবাদ জানাতে ২১ মে কাতারের রাজধানী দোহায় একটি বড় সমাবেশ করেছেন।

ইসরাইলের সাথে যুদ্ধবিরতি শক্তিশালীকরণ এবং গাজা উপত্যকা পুনর্গঠন বিষয়ে মিসরীয় কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার জন্য কয়েক দিনের মধ্যে হানিয়া কায়রো সফরে যাওয়ার কথা রয়েছে। হানিয়ার এই সফরের খবরটি এসেছে যখন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন গত ২৬ মে গাজা যুদ্ধবিরতি স্থায়ীকরণ এবং ছিটমহলটি পুনর্নির্মাণের বিষয়ে মিসরীয় কর্মকর্তাদের সাথে আলোচনার জন্য মধ্য প্রাচ্যের সফরের অংশ হিসেবে কায়রো পৌঁছেন।

কায়রোতে অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে একটি অনুষ্ঠানে যোগ দেয়ার আগে ব্লিংকেন প্রেসিডেন্ট সিসির সাথে বৈঠক করেন, যেখানে তিনি বলেন যে, ওয়াশিংটন এবং কায়রো ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের নিরাপদে বাস করার জন্য একত্রে কাজ করছে। তিনি ইসরাইল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে সর্বশেষ সহিংসতার মোকাবেলায় মিসরকে একটি ‘সত্যিকারের এবং কার্যকর অংশীদার’ হিসেবে বর্ণনা করেন। গত সপ্তাহে, সিসি মার্কিন রাষ্ট্রপতি বাইডেনের সাথে গাজা যুদ্ধবিরতি ঘোষণার আগে ও পরে দুইবার কথা বলেছেন।

নতুন মেরুকরণ : নতুন সম্ভাবনা
হামাসের সাথে মিসরের এই সম্পর্ক উন্নয়ন কেন হচ্ছে? এই প্রশ্নের জবাবে, মিসরের প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সুরক্ষা সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির প্রধান আহমেদ আল-আওয়াদি বলেছেন, কায়রো ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ অধিকার রক্ষার স্বার্থে হামাসের সাথে তার পার্থক্য কাটিয়ে উঠেছে। আওয়াদি উল্লেখ করেন, ‘হামাসের সাথে কিছুটা মতপার্থক্য থাকতে পারে; কিন্তু ইসরাইলের অধীনে বসবাসরত ফিলিস্তিনি জনগণের স্বার্থ হাসিলের আশায় সঙ্কট চলাকালে উভয় পক্ষই এই মতবিরোধকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে।’

মিসর কর্তৃপক্ষ হামাসের সাথে সম্পর্ক উন্নয়ন এবং তুরস্কের সাথে সহযোগিতা পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ মূলত একই সূত্রে গাঁথা। এর সাথে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে মুসলিম ব্রাদারহুডের নতুন করে সক্রিয় হওয়ার একটি যোগসূত্রও রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের সূত্রগুলো থেকে যতটা খবর পাওয়া যায় তাতে মনে হয়, মিসরের সাথে সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোতে আরব বসন্তের আগে মুসলিম ব্রাদারহুড যে রাজনৈতিক ও অন্যান্য অধিকার ভোগ করত, সেটি ফিরিয়ে দেয়ার ব্যাপারে ঐকমত্য হয়েছে। মিসর এর মধ্যে ব্রাদারহুডের মাঝারি কাতারের কয়েক শত নেতা ও কর্মীকে মুক্তি দিয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরো সিনিয়র নেতাদেরও মুক্তি দেয়া হতে পারে। সম্ভবত সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসনি মোবারকের সময় যতটা রাজনীতি ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালনার সুযোগ ব্রাদারহুড পেত সেটি আবার দেয়া হবে। পর্যায়ক্রমে মিসরের রাজনীতিতে তাদের ভূমিকা আরো বাড়তে পারে। সৌদি আরবও এর মধ্যে হামাসের অনেক নেতাকে জেল থেকে ছেড়ে দিয়েছে। মুসলিম ব্রাদারহুডের ব্যাপারেও সৌদি কর্তৃপক্ষ উদার মনোভাব নেয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী সঙ্ঘাতের দেশ সিরিয়ায় এক ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতার খবর পাওয়া যাচ্ছে যার অংশ হিসেবে, বাশার আল আসাদ সিরিয়ায় নতুন করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। পরে সবার অংশগ্রহণে সংসদ নির্বাচনের আয়োজনও হতে পারে। এটি ‘আস্তানা’ শান্তি উদ্যোগের অংশ হিসেবে রাশিয়া ইরান তুরস্ক যে সমঝোতার চেষ্টা করে আসছিল, তারই অংশ বলে মনে হচ্ছে।
এবারের ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে নতুন এক মেরুকরণের পথকে প্রশস্ত করবে বলে মনে হচ্ছে। এতে মুসলিম ব্রাদারহুড ও এই ঘরানার বিরুদ্ধে যে ক্রাশ অভিযান রাজতান্ত্রিক ও একনায়কতান্ত্রিক দেশগুলো চালিয়ে আসছিল সেটি বন্ধ হয়ে যাবে। একই সাথে মধ্যপ্রাচ্যের প্রধান শক্তিগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সঙ্ঘাতমুখর সম্পর্ককে যথাসম্ভব নমনীয় করে আবার মুসলিম উম্মাহর স্বার্থকে সামনে নিয়ে এসে ফিলিস্তিন সঙ্কটের সুরাহার চেষ্টা হতে পারে। এর অংশ হিসেবে কার্যকর সার্বভৌম ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথ সুগম হতে পারে। ইসরাইলের জন্য এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে যে, সার্বভৌম ফিলিস্তিনকে মেনে না নেয়ার বিকল্প হবে বিশ্ব মানচিত্র থেকে নিজেদের স্বাধীন অস্তিত্বকে মুছে দেয়া। ২০২১ সালে গাজা যুদ্ধের মাধ্যমে যে পরিবর্তনের সূত্রপাত হয়েছে সেটি আগামী বছরগুলোতে একটি পরিণতির দিকে যাবে যেখানে বিশ্ব মুসলিম শক্তি বৈশ্বিক ব্যবস্থার একটি সিদ্ধান্তÍকারী শক্তিতে পরিণত হবে।

mrkmmb@gmail.com

https://www.dailynayadiganta.com/post-editorial/585700/