সীমান্ত দিয়ে ভারত যাতায়াতই বাংলাদেশের মানুষের জন্য সর্বনাশ ডেকে আনছে। মহামারি করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এবং ব্ল্যাক ফাঙ্গাস আতঙ্কে সারাবিশ্ব। ইতোমধ্যেই সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনাভাইরাস বেড়ে যাওয়ায় চাপাইনবাবগঞ্জ জেলায় লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এছাড়াও ডিজিএইচএসের এপিডেমিওলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ কমিটি গত কয়েকদিন ধরে সীমান্ত জেলাগুলোতে কোভিড-১৯ সংক্রমণের উচ্চহারের কারণে নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরায় লকডাউনের সুপারিশ করে। তারপরও সীমান্ত দিয়ে ভারতে যাতায়াত কমছে না।
প্রতিদিন শত শত ট্রাক স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে যাতায়াত করছে। দুই দেশের ট্রাক ড্রাইভার, হেলপাররা কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। কোয়ারেন্টিনে যাচ্ছেন না। ফলে সীমান্ত জেলাগুলোর করোনা সংক্রমণের উচ্চহার সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সীমান্তের ৮ জেলায় লকডাউনের নির্দেশনা দিয়েছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক স্পষ্ট করে বলেছেন, সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বেড়ে গেছে। ভারতে যাতায়াত বন্ধ করতে না পারলে করোনা আরো ভয়াবহ রুপ দেবে। তারপরও ভারতে যাতায়াত বন্ধ হচ্ছে না। তবে ব্যাতিক্রম হচ্ছে পঞ্চগড় জেলা। এ জেলার সাধারণ মানুষের দাবির মুখে ভারতে যাতায়াতের একমাত্র পথ তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে সকল প্রকার পণ্য আমদানি-রফতানি বন্ধ ঘোষণা করেছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের বক্তব্য লকডাউন এই অঞ্চলগুলোতে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার আমের বাণিজ্যে মারাত্মক আঘাত হানবে। কিন্তু ব্যবসার চেয়ে জীবন বড়। এক সপ্তাহ বাংলাবান্ধা বন্ধ থাকবে।
মূলত বাংলাদেশের এক শেণির মানুষের কারণে অকারণে ভারতে যাতায়াত ফ্যাশন হয়ে গেছে। কেউ প্রয়োজনে চিকিৎসার জন্য পাশের দেশে যেতে বাধ্য হন। কেউ প্রতিবেশিকে সামাজিক অবস্থান বোঝানোর জন্য অকারণে চিকিৎসার অজুহাতে ভারত যান। আবার অনেকেই যান ব্যবসার জন্য। করোনাকালে চার দফায় সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। গত এপ্রিল মাসের শেষ সপ্তাহে ১৪ দিন সীমান্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়। অতপর আরো তিন দফায় সেই সীমান্ত বন্ধের মেয়াদ ১৪ দিন করে বাড়ানো হয়। তারপরও এক শ্রেণির মানুষ অবিবেচকের মতো নানা অজুহাত দেখিয়ে ভারত যাচ্ছেন আবার ফিরে আসছেন করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বহন করে।
এদিকে প্রশাসনের কিছু দায়িত্বশীল পদে থাকা ব্যাক্তির ভারত প্রেমের কারণে সীমান্ত জেলাগুলোতে লকডাউন ঘোষণায় বিলম্ব হচ্ছে বলে জানা গেছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের বিশেষজ্ঞ কমিটি রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের সীমান্তবর্তী ৮ জেলায় লকডাউন দেয়ার প্রস্তাব করেছে। গতকালও স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় ভারত সীমান্তবর্তী ৭ জেলায় লকডাউনের কঠোর বিধিনিষেধ জারি করতে দেরি হলে সঙ্কট বাড়বে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এটা পর্যালাচনা করছে। আম চাষিদের অবস্থা বিবেচনা করে হয়ত দেরি করছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের জরুরি সুপারিশ সত্ত্বেও, রাজশাহী ও খুলনা বিভাগের সাতটি জেলার স্থানীয় প্রশাসন ও স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সেখানে এখনই লকডাউন দেয়ার বিরোধিতা করেছেন। তারা মনে করছেন, নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরায় লকডাউন দেয়া হলে আম ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। সরকারের দায়িত্বশীল এই ব্যক্তিদের কাছে আমের ব্যবসা বড় না দেশের ১৭ কোটি মানুষের জীবন বড় সেটাই বড় প্রশ্ন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, লকডাউনের সিদ্ধান্ত কেবিনেট (ডিভিশন) করে। আমরা আলাপ করব যে উনারা কবে থেকে লকডাউন দেবেন। কিন্তু আমাদের পরামর্শ হচ্ছে, যেসব জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী, বেশি বেড়ে যাচ্ছে, সেখানে লকডাউন দিয়ে দেয়া। তবে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, পুরো জেলা অবরুদ্ধ করা হবে, না জেলার নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় ‘পরিস্থিতি বুঝে’ সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। তিনি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ মনে করলে স্থানীয় প্রশাসনও লকডাউনের ঘোষণা দিতে পারে, সেরকম নির্দেশনা আগেই দিয়ে রাখা হয়েছে।
বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় লকডাউন চলছে। গতকাল চলমান লকডাউনের মেয়াদ আরো ৭ দিন বৃদ্ধি করা হয়েছে। তবে নওগাঁ, রাজশাহী, নাটোর, কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা ও সাতক্ষীরায় করোনার সংক্রমণ উচ্চহারে হলেও লকডাউন দেয়া হয়নি। এমনকি এসব জেলার সীমান্ত ও স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন শত শত মানুষ ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারত থেকে যারা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসছেন তারাই মূলত করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ও ব্ল্যাক ফাঙ্গাসের বাহক।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আখাউড়া, বিবিরবাজার, বেনাপোল, বাংলাবান্ধা, টেকনাফ, বিলুনিয়া, সোনা মসজিদ, ভোমরা, দর্শনা, বুড়িমারি, সোনাহাট, রৌমারি, হিলি, রাধিকাপুর, তামাবিল, গোয়াইনঘাট, সুতারকান্দি, বিয়ানিবাজার, জকিগঞ্জ, বল্লা চুনারুঘাট, ফুলতলা, চাতলা, নাকুগাও, গোবরাকুড়া, ধনুয়া বকশিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে প্রতিদিন মানুষ বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন। সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে আসা এসব মানুষের মধ্যে খুব কমসংখ্যক মানুষকে কোয়ারেন্টিনে নেয়া হচ্ছে।
৭ জেলায় লকডাউনে গড়িমসি করা হলেও সীমান্ত জেলা পঞ্চগড়ের মানুষ দেশবাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন নিজেদের দেশপ্রেম। নিজেরাই মহামারি করোনাভাইরাসের ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট এবং ব্ল্যাক ফাঙ্গাস থেকে নিজেদের রক্ষা করতে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর বন্ধ করে রাখার দাবিতে আন্দোলনে নামেন। অতঃপর পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর দিয়ে সকল প্রকার পণ্য আমদানি-রফতানি বন্ধ ঘোষণা করেন ব্যবসায়ীরা। গত শনিবার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, আমদানি-রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশন, ব্যবসায়ীসহ বন্দর সংশ্লিষ্টদের ঐক্যমতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে বলা হয়, রোববার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চতুর্দেশীয় এই স্থলবন্দর বন্ধ থাকবে। তবে জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয়দের দাবি, ভারতে করোনা ও ফাঙ্গাস সংক্রমণ পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর বন্ধ রাখা উচিত।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানি রফতানিকারক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মেহেদী হাসান খান বাবলা বলেন, এলাকার জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, বন্দর শ্রমিক এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের যৌথ সিদ্ধান্তে সতর্কতার অংশ হিসেবে রোববার থেকে ৩ জুন পর্যন্ত এই বন্দর দিয়ে আমদানি রফতানি বন্ধ থাকবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে।
পঞ্চগড় জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার সাদাত সম্রাট বলেন, বাংলাবান্ধায় ভারত থেকে প্রতিদিন শত শত ট্রাক পাথর নিয়ে আসে। এই ট্রাকের চালকরা আমাদের দেশের অভ্যন্তরে যত্রতত্র চলাফেরা করে। মুলত এটা নিয়েই তেঁতুলিয়া এবং পঞ্চগড়ের মানুষ আতঙ্কিত। এজন্য করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট থেকে বাঁচতে সকলের মতামতের ভিত্তিতে স্থলবন্দরে কয়েকদিন আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে। এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ছাড়াও সীমান্তের অন্য ৭ জেলা লকডাউন ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামীম ইয়াজদানী বলেন, আমরা লকডাউনের পক্ষে জোর সুপারিশ করেছি। সংক্রমণ এতো বেশি যে ইতোমধ্যে আমাদের সবগুলো শয্যা ও অক্সিজেন সুবিধা করোনা রোগীদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। প্রতিদিন কমপক্ষে ১২ জন নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। কয়েকজন রোগীর মৃত্যুও হচ্ছে। তবুও এখনো আমরা পরিস্থিতি সামলাতে পারছি। রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে সমস্যা হবে। তবে রাজশাহীর জেলা প্রশাসক আবদুল জলিল সাংবাদিকদের বলেন, এই মুহূর্তে একটি কঠোর লকডাউন নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া কঠিন। কারণ আমের বাণিজ্যে কোটি কোটি টাকা ও হাজার হাজার মানুষের জীবিকা জড়িত। তার দাবি রাজশাহীসহ সীমান্ত জেলাগুলোতে করোনা পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক নয়।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গতকাল করোনা ছড়িয়ে পড়ার জন্য দেশব্যাপী নিয়ন্ত্রণ বিধিগুলো আগামী জুন পর্যন্ত আরো এক সপ্তাহের জন্য বাড়িয়েছে। তারা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ দিয়েছেন।