১ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:১২

দুই সিটিতে শতকোটি টাকার বাজার

বাসার বর্জ্য সংগ্রহে চরম বিশৃঙ্খলা

বেঁধে দেওয়া ফির চেয়ে বেশি আদায় করছে ডিএসসিসির ইজারাদাররা

রাজধানীতে বাসা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাপনায় চরম বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দিলেও তা মানছেন না ইজারাদাররা। হোল্ডিংপ্রতি ১০০ টাকার পরিবর্তে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত ফি অর্থ আদায় করছে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এ ব্যাপারে এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো নির্দেশনা দিতে পারেনি। যে কারণে বর্জ্য সংগ্রহ প্রতিষ্ঠানগুলো খেয়ালখুশিমতো ফি আদায় করছে। এতে হয়রানির মুখে পড়ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য সংগ্রহ নিয়েও দুই সিটিতে চলছে নৈরাজ্য। তারা ৫০০ থেকে ৫০০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করছেন। দুই সিটির দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বাসা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ করে সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে (এসটিএস) ফেলে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজে বছরে শতকোটি টাকার চেয়ে বড় বাজার গড়ে উঠেছে। এর সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে পারলে দুই সিটির রাজস্ব আয় বাড়বে। শহর পরিচ্ছন্ন হবে এবং হয়রানি কমবে গ্রাহকদের। আর সেটা করতে না পারলে গ্রাহকদের হয়রানি বৃদ্ধির পাশাপাশি বর্জ্য দখলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে রক্তপাতের শঙ্কা আছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।

জানা গেছে, ডিএসসিসির প্রতিটি হোল্ডিং থেকে বর্জ্য অপসারণ বাবদ ১০০ টাকা করে ফি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও এটা মানছে না ওই বর্জ্য সংগ্রহের ইজারাদার প্রতিষ্ঠান। দোকানপাট, মার্কেট, সরকারি অফিস ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে আলোচনা করে মূল্য নির্ধারণের নির্দেশনা দেওয়া হয় ইজারাদারদের। এ সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ইজারাদাররা। তারা স্বাভাবিকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ আদায় করছে। এ ক্ষেত্রে ৫০০ থেকে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। ডিএসসিসির ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের চানখাঁরপুল লেনের বাসিন্দা মুসতাক আহমদ যুগান্তরকে বলেন, হোল্ডিংপ্রতি ১০০ টাকা ধার্য থাকলেও এ এলাকার বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ‘বন্ধন ক্লিন’ সর্বোচ্চ ২০০ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে।

অন্যদিকে ডিএনসিসি এখনো ফি নির্ধারণ করতে পারেনি। অবিভক্ত সিটি করপোরেশন ২০০৯ সালে প্রতি হোল্ডিং থেকে ৩০ টাকা করে আদায়ের নির্দেশ দেয়। ডিএনসিসি গঠিত হওয়ার পর প্রয়াত মেয়র মো. আনিসুল হক সেটা বাড়িয়ে ১০০ টাকা করার বিষয়ে বোর্ড সভায় প্রস্তাব অনুমোদন করেন। পরে তা যাচাই-বাছাই করে চূড়ান্ত হওয়ার আগেই তিনি মারা যান। এরপর সেটা আর চূড়ান্ত হয়নি। এক্ষেত্রে আগের ৩০ টাকা ফি বাস্তবসম্মত না হওয়ায় আবর্জনা সংগ্রহের সঙ্গে জড়িতরা নিজেদের খেয়ালখুশিমতো ফি আদায় করে চলেছে। ডিএনসিসির অনেক এলাকার বাসা-বাড়ি থেকে ৮০-১০০ টাকা এবং ক্ষেত্র বিশেষে ১৫০ টাকা পর্যন্ত আদায় করা হচ্ছে। তবে গুলশান, বনানী, বারিধারা, উত্তরা ও লালমাটিয়া এলাকায় এটা ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়। আর দোকানপাট, সুপারশপ, মার্কেট থেকে ইচ্ছামতো ফি আদায় করা হচ্ছে বলে স্বয়ং ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগ তথ্য দিচ্ছে।

আরও জানা যায়, ডিএসসিসি এলাকার বর্জ্য সংগ্রহ প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে ‘ঢাকা ওয়েস্ট কালেকশন ফাউন্ডেশন’। এ সংগঠনের সদস্য ৪৫০টি প্রতিষ্ঠান। এখানে প্রায় ৪ হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী নিয়োজিত রয়েছেন। গত বছরের কোরবানি ঈদের আগে দীর্ঘদিন থেকে কাজ করে আসা অভিজ্ঞ প্রতিষ্ঠানগুলো বাদ দিয়ে নতুন ৭৫টি প্রতিষ্ঠানকে ৭৫টি ওয়ার্ডের বর্জ্য সংগ্রহের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে ‘ঢাকা ওয়েস্ট কালেকশন ফাউন্ডেশন’র সভাপতি মনিরুল হোসেন কমল এ বিষয়ে যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন যাবত আমরা বেসরকারিভাবে ঢাকা শহরের বর্জ্য সংগ্রহের কার্যক্রম পরিচালনার সঙ্গে জড়িত। এমন ৪৫০টি প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের ঘনিষ্ঠজনদের এ কাজ দেওয়া হয়েছে।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. বদরুল আমিন যুগান্তরকে বলেন, বাসা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে ওয়ার্ডভিত্তিক ইজারা দেওয়া হয়েছে। এদের বাসা থেকে মাসিক ফি ১০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। আর সরকারি অফিস ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে আলোচনার ভিত্তিতে আদায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শর্তভঙ্গের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অন্যদিকে ডিএনসিসি এলাকায় বর্জ্য সংগ্রহ কার্যক্রমের সমন্বয়ের লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে ‘প্রাইমারি ওয়েস্ট কালেকশন সার্ভিসেস প্রোপাইটার (পিডব্লিউসিএসপি)’। ডিএনসিসি এলাকার কেন্দ্রীয় এ সমন্বয় সংগঠনের সদস্য সংখ্যা ৪৫০। এসব প্রতিষ্ঠানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সংখ্যা অন্তত ৬ হাজার। ডিএনসিসিও সম্প্রতি ডিএসসিসির আদলে ৫৪টি ওয়ার্ডে ৫৪ প্রতিষ্ঠানকে আবর্জনা পরিষ্কারের দায়িত্ব দেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। সে সময় পিডব্লিউসিএসপি মানববন্ধনসহ নানাবিধ কর্মসূচি গ্রহণ করার সে উদ্যোগ থেকে তারা সরে দাঁড়িয়েছে। তবে ডিএনসিসি এলাকার বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রমের বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে বোর্ড সভায় তা অনুমোদন করেছে কর্তৃপক্ষ। এখানে পুরাতন ওয়ার্ড ১ থেকে ৩৬ নম্বর পর্যন্ত টাইপ ‘এ’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। আর নবগঠিত ওয়ার্ড ৩৭ থেকে ৫৪ নম্বর পর্যন্ত টাইপ ‘বি’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, টাইপ ‘এ’র বাসা-বাড়ি, ফ্ল্যাট, দোকানপাট. ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে মাসিক ১০০ টাকা এবং টাইপ ‘বি’ এলাকা থেকে মাসিক ৫০ টাকা হারে ফি আদায় নির্ধারিত হবে। উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টরের ১ নম্বর রোডের ৩৭ নম্বর বাসার বাসিন্দা মো. হেলাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, বাসা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ মাসে ২৫০ টাকা করে পরিশোধ করতে হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১০০ টাকা করে নেওয়ার কথা থাকলেও কেউ সেটা মানছে না।

ডিএনসিসি এলাকার বর্জ্য সংগ্রহ সমন্বয়ক সংগঠন ‘প্রাইমারি ওয়েস্ট কালেকশন সার্ভিসেস প্রোপ্রাইটারের (পিডব্লিউসিএসপি) সভাপতি নাহিদ আক্তার লাকী যুগান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বর্জ্য সংগ্রহের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানকে বাদ দিয়ে ডিএসসিসিতে রাজনৈতিক বিবেচনায় ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের সুপারিশে অনভিজ্ঞদের বর্জ্য সংগ্রহের কাজ দেওয়া হয়েছে। ডিএনসিসিতেও সেটা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। সুষ্ঠুভাবে বর্জ্য সংগ্রহ কাজে এখন বড় বাধা ওয়ার্ড কাউন্সিলররা।

এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা যুগান্তরকে বলেন, এ এলাকার বাসা থেকে বর্জ্য সংগ্রহ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে নানান বিশৃঙ্খলা রয়েছে, এটা সত্য। এটা নিয়ন্ত্রণে আমরা একটি নীতিমালা করেছি। সেটা কাউন্সিলরদের বোর্ড সভায়ও অনুমোদন পেয়েছে। পরে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে।

শতকোটি টাকার বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খলা : অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ডিএসসিসির বর্তমান হোল্ডিং সংখ্যা ২ লাখ ৫১ হাজার। আর ট্রেড লাইসেন্স সংখ্যা ২ লাখ ৩১ হাজার। এ সংখ্যা অনুযায়ী ১০০ টাকা বর্জ্য সংগ্রহ ফি ধরলে মাসিক হিসাব দাঁড়ায় ৪ কোটি ৮২ লাখ টাকা। বছরে এর পরিমাণ হয় ৫৭ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আর ডিএনসিসির হোল্ডিং সংখ্যা ২ লাখ ৪০ হাজার। আর ট্রেড লাইসেন্স সংখ্যা ২ লাখ ৬০ হাজার। এ সংখ্যা অনুযায়ী ১০০ টাকা করে বর্জ্য ফি ধরলে মাসিক হিসাব দাঁড়ায় ৫ কোটি টাকা। যেটা বার্ষিক পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ কোটি টাকা। এ হিসাব অনুযায়ী বাসাবাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ বাবদ বছরে অন্তত ১১৮ কোটি টাকা আয় করা সম্ভব। এ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাসা-বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহ কার্যক্রম যথাযথভাবে বিধিমালা অনুসরণ করে করলেও ১০০ থেকে ১৫০ কোটি টাকার বাজার এটা। এ বাজারে বিশৃঙ্খলা থাকায় অসাধু ব্যক্তিরা এখান থেকে আরও বেশি টাকা তুলে নিচ্ছেন। এতে জনগণ ও সিটি করপোরেশন উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/426482