৩ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১১:৩৪

একই দিনে তিন মেয়র বরখাস্ত

 মামলা থাকায় বিএনপি সমর্থিত তিন মেয়রকে বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। গতকাল রোববার দুপুরে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ওই তিনজনকে বরখাস্ত করা হয়। বরখাস্তরা হলেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল, সিলেটের মেয়র আরিফুল হক ও হবিগঞ্জের মেয়র জি কে গউছ। মন্ত্রণালয় থেকে বরখাস্তের আদেশ সংশ্লিষ্ট মেয়রদের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।
গতকাল রোববার স্থানীয় সরকার বিভাগ রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও সিলেটের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে বরখাস্ত করে।
এর আগে উচ্চ আদালতের রায় নিয়ে রোববার সকালে মেয়রের দায়িত্ব বুঝে নিতে নগর ভবনে যান এই দুই মেয়র। সকাল ১০টার দিকে রাজশাহীর মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল তাঁর দায়িত্ব নিতে নগর ভবনে আসেন। কিন্তু তালা ঝোলানো থাকায় মেয়র তাঁর কক্ষে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হন। পরে তালা খুলে দেয়া হয় প্রচার এবং দায়িত্ব গ্রহণের মাথায় বরখাস্তের আদেশ পান।
এদিকে রোববার বেলা সাড়ে ১১টায় নগরের কুমারপাড়ার বাসা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পথ হেঁটে নগর ভবনে পৌঁছান সিলেট সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। করপোরেশনের ওয়ার্ড কাউন্সিলর, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাঁকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। বাসা থেকে হেঁটে নগর ভবনে যাওয়ার সময় মেয়রকে রাস্তার দুই পাশ থেকে সাধারণ মানুষ হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানান। এ সময় তাঁকে ফুলের মালা দিয়েও শুভেচ্ছা জানানো হয়। এর কয়েক ঘণ্টা পরেই বরখাস্তের খবর আসে।
এদিকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি হবিগঞ্জের পৌর মেয়র জি কে গউছকে একই কারণ দেখিয়ে বরখাস্ত করেছে মন্ত্রণালয়। হাইকোর্টের আদেশ পেয়ে তিনি গত ১০ দিন আগে মেয়রের দায়িত্ব বুঝে পেয়েছিলেন।
মেয়র বুলবুল ফের সাময়িক বরখাস্ত : দিনভর নানান নাটকের পর শেষ পর্যন্ত চেয়ারে বসতে দেয়া হলো না রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) নির্বাচিত মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে। দায়িত্ব গ্রহণের মাত্র ১০ মিনিটের মাথায় ফের সাময়িক বরখাস্তের খবর পেলেন গতকাল রোববার বিকেল প্রায় সোয়া ৩টার দিকে তিনি। এর আগে মেয়রের অফিস কক্ষে তালা ঝুলিয়ে রাখা হয়। এ নিয়ে কর্মচারিদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পুলিশের উপস্থিতিতে অফিসের তালা খুলে দেয়া হয়।
গতকাল রোববার (২ এপ্রিল) স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মুহাম্মদ আনোয়ার পাশা স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বিকেল ৩টা পাঁচ মিনিটের দিকে ফ্যাক্সযোগে তাকে সাময়িক বরখাস্তের আদেশের কপিটি নগর ভবনে পৌঁছে। এর আগে ৩টা দুই মিনিটের দিকে মেয়র বুলবুল তার অফিস কক্ষে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসেন। এরপর সাময়িক বরখাস্তের খবর শুনে ৩টা ১২ মিনিটের দিকে তিনি বেরিয়ে যান। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের মেয়র বুলবুল বলেন, যে কারণ দেখিয়ে তাকে ফের সাময়িক বরখাস্তের আদেশ দেয়া হয়েছে, সেই একই কারণ দেখিয়ে এর আগে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছিল। তবে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের আদেশে তিনি দায়িত্ব ফিরে পেয়েছেন। উচ্চ আদালতের ওই আদেশে সাময়িক বরখাস্তের বিধানটি অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই তাকে ফের বরখাস্তের আদেশ সঠিক হয়নি মন্তব্য করে তিনি বলেন, আগামীকাল (আজ সোমবারও) তিনি অফিস করবেন।
মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনটি এরূপ : ‘মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১, রাজশাহী এর মামলা নং- ১৩৬/১৫ (রাজশাহী জেলার বোয়ালিয়া থানার মামলা নং- ১৭, তারিখ- ৮ ফেব্রুয়ারি’২০১৫/এম.জি.আর- ১০৩/১৫ বোয়ালিয়া মডেল থানা) এর অভিযোগপত্র বিজ্ঞ আদালত কর্তৃক গৃহীত হইয়াছে। সেহেতু, স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯, (২০০৯ সালের ৬০ নং আইন) এর ধারা ১২ এর উপধারা (১) এ সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের বিরুদ্ধে ফৌজদারী মামলায় অভিযোগপত্র আদালত কর্তৃক গৃহীত হইলে, সরকার কর্তৃক লিখিত আদেশের মাধ্যমে তাহাকে সাময়িকভাবে বরখাস্তের বিধান রহিয়াছে। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ মোসাদ্দেক হোসেনকে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯, (২০০৯ সালের ৬০ নং আইন) এর ধারা ১২ এর উপধারা (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হইল। জনস্বার্থে জারিকৃত এই আদেশ অবিলম্বে কার্যকর হইবে।’
এরআগে ২০১৫ সালে ৭ মে একই কারণে সিটি মেয়র বুলবুলকে মেয়র পদকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ২০১৬ সালের ১০ মার্চ উচ্চ আদালত তার বরখাস্ত আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। এরই প্রেক্ষিতে গত ২৭ মার্চ তারিখে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মাহমুদুল আলম স্বাক্ষরিত ‘মহামান্য আদালত কর্তৃক আদেশ প্রতিপালন’ শীর্ষক এক পত্রে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের দায়েরকৃত আপিলের আদেশ কার্যকরের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদান করা হয়। এর অনুলিপি মেয়র ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ছাড়াও রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকসহ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ব্যত্তিদের প্রদান করা হয়।
এদিকে, সাময়িক বরখাস্তেরর দীর্ঘ প্রায় ২০ মাস পর উচ্চ আদালতের রায়ের প্রেক্ষিতে গতকাল সকাল ১০টায় নগরভবনে মেয়রের দায়িত্ব নিতে যান মেয়র বুলবুল। কিন্তু তিনি সেখানে গিয়ে দেখতে পান তার কক্ষটি তালাবদ্ধ। তিনি যাতে দায়িত্ব নিতে না পারেন সে কারণে আগেই তার অফিস কক্ষটি তালাবদ্ধ করে দেয়া হয়। তবে কে বা কারা তালা লাগিয়ে দেয় তা জানা যায়নি। এসময় মেয়র বুলবুল কিছুক্ষণ অপেক্ষার পরও কক্ষে প্রবেশ করতে না পেরে সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে বসেন তিনি। এ পরিস্থিতিতে সেখানে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। দুপুর ২টার দিকে পুলিশের সহযোগিতায় সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. শরীফ উদ্দিন তালা ভেঙ্গে মেয়রকে তার কক্ষে প্রবেশের সুযোগ করে দেন। কিন্তু মেয়রকে দায়িত্ব বুঝে দিতে আগে থেকে কোনো উদ্যোগ নেননি প্রধান নির্বাহী কর্মককর্তা। এ সময় মেয়র বুলবুল সাংবাদিকদের বলেন, আদালতের রায় হাতে নিয়েই তিনি দায়িত্ব নিতে এসেছেন। কিন্তু এসে দেখেন তার কক্ষ তালাবদ্ধ। তবে তিনি যেহেতু ভোটে নির্বাচিত এবং আদালতের রায়ে দায়িত্ব ফিরে পেয়েছেন, সেহেতু লিখিতভাবে কোনো আনুষ্ঠানিকতার দরকার নেই। তিনি এমনিতেই মেয়র-বলেন বুলবুল।
রাসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শরীফ উদ্দিন বলেন, কে বা কারা মেয়রের দপ্তরে তালা দিয়ে গেছে তিনি তা জানেন না। তবে বিষয়টি বিভাগীয় তদন্ত করা হবে বলে জানান তিনি। মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের মেয়রের দায়িত্ব নেয়াকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে নগর ভবনের সামনে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। বেলা ১১টার দিকে নগর ভবনে মেয়র বুলবুলের আহবান করা সংবাদ সম্মেলনও হয়নি। নগর ভবনে দেখা যায়নি আ’লীগসমর্থিত দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র নিযাম-উল-আযীমকেও।
২০১৫ সালে ৭ মে মেয়র বুলবুলকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ২০১৬ সালের ১০ মার্চ উচ্চ আদালত তার বরখাস্ত আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। গত ২৭ মার্চ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মাহমুদুল আলমের স্বাক্ষরিত চিঠিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে ভারপ্রাপ্ত মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপরই রোববার দায়িত্ব নিতে নগর ভবনে যান মেয়র বুলবুল। উল্লেখ্য, মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে সাময়িক বরখাস্ত করে ২১ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর নিযাম-উল আযীমকে দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র হিসেবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর প্রকাশ করা হয়। এরপর রায়ের অনুলিপি সংযুক্ত করে বুলবুল দায়িত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর আবেদন করেন। কিন্তু, দায়িত্ব বুঝিয়ে না দিয়ে মন্ত্রণালয় সিভিল মিস পিটিশান বা সিএমপি দাখিল করে আপিল বিভাগের রায় স্থগিত চেয়েছিলেন। চেম্বার জজ তা স্থগিত না করে আপিল বিভাগের রায়ই বহাল রাখেন। পরে সরকার সিভিল মিস পিটিশান ফর লিভ টু আপিল বা সিপি দাখিল করেন। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি হচ্ছিল। এরপর পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে বুলবুলকে বরখাস্ত আদেশ চূড়ান্তভাবে অবৈধ ঘোষিত হয়। একই সঙ্গে নিযাম উল আযীমের ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র’ পদে দায়িত্ব গ্রহণও বৈধতা হারায়।
মেয়রের চেয়ারে সকালে দুপুরে বরখাস্ত আরিফ : নগরবাসীর বিপুল উদৎসাহ উদ্দীপনা ও ফুলেল শুভেচ্ছা গ্রহণের মধ্যদিয়ে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের জননন্দিত নির্বাচিত মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী সকালে নগরভবনের চেয়ারে বসলেও বিকেলে বরখাস্ত হয়েছেন। দীর্ঘ আইনী লড়াই চালিয়ে মেয়রের পদ ফিরে পেয়েছিলেন আরিফুল হক চৌধুরী। গতকাল রোববার সকালে রীতিমতো শোডাউন করে গিয়েছিলেন নগর ভবনে। বসেন মেয়রের চেয়ারে। কিন্তু মেয়রের চেয়ারে বসার মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে ‘দুঃসংবাদ’ এসেছে আরিফের জন্য। ফের মেয়রের পদ থেকে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের সিটি করপোরেশন অ্যাক্ট উপ-সচিব মো. মাহমুদুল আলম কর্তৃক সিলেট সিটি করপোরেশনে একটি ফ্যাক্স বার্তা প্রেরণ করা হয়েছে।
ওই বার্তায় বলা হয়েছে, ‘আরিফুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল মামলা-৪/২০০৯ এর সম্পূরক অভিযোগপত্র গত ২২ মার্চ আদালতে গৃহিত হয়েছে। সেহেতু সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে স্থানীয় সরকার বিভাগ আইন ২০০৯ এর ১২ উপধারা প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো।’
ওই বিশেষ ট্রাইব্যুনাল মামলাটি হচ্ছে দিরাই-শাল্লা এলাকার সংসদ সদস্য মৃত্যুবরণকারী আওয়ামী লীগ নেতা সুরঞ্জিত সেন গুপ্তের জীবদ্দশায় দিরাইয়ে একটি জনসভায় বোমা হামলার মামলা।
সাবেক অর্থ মন্ত্রী কিবরিয়া হত্যা ও সুরঞ্জিত সেনের জনসভায় বোমা হামলার ঘটনায় দায়েরকৃত ৪টি মামলায় পর্যায়ক্রমে উচ্চ আদালত থেকে জামিন লাভ করেন আরিফ। ২ বছর ৫ দিন পর চলতি ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি সবকয়টি মামলায় জামিনে মুক্ত হন তিনি। গত ১৩ মার্চ আরিফের রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের বরখাস্তের আদেশ ছয় মাসের জন্য স্থগিত করেন। রাষ্ট্রপক্ষ এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করলে গত ২৩ মার্চ হাইকোর্টের দেয়া আদেশই বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। এর পর গতকাল রোববার আরিফুল হক চৌধুরী ঢাক-ঢোল পিটিয়ে নগরভবনের চেয়ারে বসেন। এর কয়েক ঘন্টার মাথায় নগরপিতা আরিফকে বরখাস্ত করলো স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

http://www.dailysangram.com/post/278264