১ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:১১

দুবাইয়ের ‘অনিশ্চিত’ গন্তব্যে বাংলাদেশীরা

ভিজিট ভিসার কর্মীদের কর্মসংস্থান ভিসায় রূপান্তরে ব্যর্থ হলে দেশে ফেরতের ব্যয় বহন করবে নিয়োগকারী কোম্পানি : দুবাই কাউন্সিলর

স্বপ্নের শহর দুবাইয়ের অনিশ্চিত গন্তব্যে পাড়ি জমাচ্ছে হাজার হাজার বাংলাদেশী। কাজের সন্ধানে তিন মাসের ভিজিট ভিসায় এসব বাংলাদেশী পাড়ি জমালেও আদৌ তারা এমপ্লয়মেন্ট (কর্মসংস্থান) ভিসায় স্থায়ী হতে পারবেন কি নাÑ তা নিয়ে রয়েছে নানা সংশয়। যদিও ইউএই সরকারের মৌন ইচ্ছাতেই আপাতত বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার নাগরিকদের ভিজিট ভিসায় যাওয়ার ‘গ্রিন সিগন্যাল’ দেয়া হয়েছে বলে দাবি করছেন জনশক্তি ব্যবসার সাথে সম্পৃক্তরা।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং অভিবাসনের সাথে সম্পৃক্ত বিশ্লেষকরা বলছেন, জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর বহির্গমন ছাড়পত্র (স্মার্ট কার্ড) নিয়ে যারা দুবাই গিয়েছেন, তারা মোটামুটি যাওয়ার পর নিরাপদ থাকবেন এমনটাই আশা করা হচ্ছে। তবে এ নিয়মের বাইরে যারাই দালালের মাধ্যমে ‘এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট’ করে যাবেন তাদের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর সমস্যা দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় তাদেরকে পালিয়ে থাকা ছাড়া বিকল্প আর পথ থাকছে না। তাই যারা ভিজিট ভিসায় দেশটিতে যাওয়ার চিন্তা করছেন তাদের অবশ্যই ভেবে-চিন্তে দুবাই পাড়ি জমানো উচিত বলে মনে করছেন তারা।

গত ফেব্রুয়ারি মাসে দুবাইয়ের ব্রাইট ক্লিন কার পোলিশিং অ্যান্ড ক্লিনিং কোম্পানিতে পুরুষ পদে ১০ জন কর্মী নিয়োগের চাহিদা ও ক্ষমতাপত্র সত্যায়নের জন্য দুবাইয়ের কাউন্সেলর জেনারেল অফিসের কাউন্সেলর (শ্রম) ফাতেমা জাহান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, কোম্পানি কর্র্তৃক ডিমান্ড লেটার, পাওয়ার অব অ্যাটর্নিসহ অন্যান্য কাগজপত্রের সঠিকতা ও বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধা সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়। কাগজপত্র সঠিক পাওয়ায় কোটা অনুযায়ী চাহিদাপত্রটি সত্যায়ন করা হলো।

একই চিঠিতে বলা হয়, কোম্পানি পরিদর্শন করার সময় কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সরাসরি কর্মসংস্থান ভিসা বন্ধ থাকায় কোম্পানি কর্তৃক বাংলাদেশ থেকে ভিজিট ভিসায় কর্মী এনে পরবর্তী সময়ে কর্মসংস্থান ভিসায় রূপান্তর করা হবে। এটি করা না গেলে সেসব কর্মীর বাংলাদেশে প্রত্যাগমনের যাবতীয় ব্যয়ভার তাদের পক্ষ থেকে বহন করা হবে। তা ছাড়াও ওই ভিজিট ভিসাগুলো এই কনসুলেট অফিস থেকে সত্যায়নপূর্বক বিএমইটির ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলেও ওই চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় শত শত লোক দেশটিতে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জনশক্তি কর্মসংস্থান ব্যুরোর পরিসংখ্যান সূত্রে জানা গেছে।

দেশটিতে কর্মী যাওয়া প্রসঙ্গে দুবাইয়ের রেসিডেন্স পারমিট পাওয়া একাধিক ব্যবসায়ী নয়া দিগন্তকে বলেন, কর্মী সঙ্কটের কারণে ইউএই সরকার বড় ধরনের বেকায়দায় পড়েছে। এ কারণে তাদের ব্যবসাবাণিজ্য, অফিস, ফ্যাক্টরি সবকিছুতে অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে। উপায় না পেয়ে ইউএই সরকার মনোনীত রিক্রুটিং এজেন্সি ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো কিভাবে কর্মীর অভাব পূরণ করা যায় সে ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে তাদের সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরে লিখিত প্রস্তাব দেয়। একই সাথে তারা তাদের প্রস্তাবনায় উল্লেখ করে, যেহেতু এ মুহূর্তে এমপ্লয়মেন্ট ভিসায় কর্মী আসার সুযোগ নেই, তাই আপাতত যেন তিন মাসের ভিজিট ভিসা দিয়ে হলেও শ্রমিক আসার সুযোগ দেয়া হয়। এমন প্রস্তাবনার পর ইউএই সরকার লিখিত কোনো সার্কুলার না দিলেও ভিজিট ভিসায় কর্মী আসার মৌন সম্মতি দেয়।

এরপরই দেশটির সরকারের সাথে বাংলাদেশ দূতাবাসের বৈঠকের পর আলোচনা করে করণীয় নির্ধারণ করা হয়। সে মোতাবেক বাংলাদেশ সরকারও ভিজিট ভিসায় পাড়ি জমানো কর্মীর নামে বিএমইটি থেকে স্মার্ট কার্ড প্রদানে রাজি হয়। দুই পক্ষ ঐকমত্যে পৌঁছানোর পরই বাংলাদেশীদের ঢাকা ছাড়ার হিড়িক পড়ে। ইতোমধ্যে এই প্রক্রিয়ায় অর্ধলক্ষাধিক শ্রমিক দুবাই পাড়ি দিয়েছেন বলে তারা ধারণা করছেন। বর্তমানে করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ইউএই সরকারের কঠোর নির্দেশনায় বাংলাদেশসহ পাঁচ দেশের ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রয়েছে। যার কারণে আবুধাবি ও দুবাইয়ের উদ্দেশে ভিজিট ভিসায় কর্মী যাওয়া বন্ধ আছে। তবে ফ্লাইট চালু হলেই প্রসেসিং সম্পন্ন হওয়া বিপুলসংখ্যক কর্মী আবারো দুবাই পাড়ি জমাবেন বলে জনশক্তি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে জানা গেছে।

জনশক্তি ব্যবসায়ীদের কেউ কেউ অবশ্য নয়া দিগন্তকে বলছেন, সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক যেসব কর্মী বিএমইটির ক্লিয়ারেন্স নিয়ে বৈধভাবে দুবাই গিয়েছে তাদের ব্যাপারে নিয়োগকারী কোম্পানি পরবর্তী সময়ে এমপ্লয়মেন্ট ভিসায় (ওয়ার্ক পারমিট) আবেদন করে কর্মীদের বৈধভাবে কাজ এবং দেশটিতে থাকার সুযোগ দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়েই নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ নিয়মের ব্যতয় ঘটিয়ে ইদানীং শোনা যাচ্ছে শতকরা ৬০-৭০ ভাগ লোকই বিএমইটির ক্লিয়ারেন্সকে তোয়াক্কা না করে দালালদের মাধ্যমেই ‘এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট’ করে যাওয়ার চেষ্টা করছে। অনেকে এই প্রক্রিয়ায় চলেও গেছে। যারা চলে গেছে, তাদের ভিসা শেষ হওয়ার পর সেখানে নানা ধরনের সমস্যা মোকাবেলা করতে হবে। কারণ তাদের কাছে বিএমইটির বহির্গমন ছাড়পত্র নেই। কোম্পানিও তখন এসব কর্মীর দায়িত্ব নেবে না। তখন হয় তাদের পালিয়ে থাকতে হবে, না হয় দেশে ফিরে আসতে হবে। তাই তাদের পরামর্শ, ইউএই সরকার যেহেতু ভিজিট ভিসায় যাওয়ার একটা সুযোগ দিয়েছে, সেহেতু বহির্গমন ছাড়পত্র নিয়ে যাওয়াই নিরাপদ বলে তারা মনে করছেন।

এক প্রশ্নের উত্তরে তারা জানান, বর্তমানে ইউএইতে কম করে হলেও দুই-তিন লাখ লোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার যদি ভিজিট ভিসায় যাওয়ার ব্যাপারে অনীহা দেখাতো তাহলে এ সুযোগে শ্রমবাজারটিতে ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপালসহ অন্যান্য দেশের কর্মীরা সেটি দখল করে নিতো। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তারা বলেন, ‘এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট’ করে যারা যাচ্ছে তারা মূলত দুবাইয়ে থাকা পুরনো শ্রমিক অথবা স্থানীয় এজেন্টদের প্রলোভন পড়েই যাচ্ছে। এ পথে যারা যাচ্ছে তাদের দালালরা প্রথমে দুবাইয়ের কোনো একটি ভাড়াবাসায় নিয়ে রাখছে। পরবর্তী সময়ে কাজ খুঁজে তারপর তাদের যোগদান করাচ্ছে। এ নিয়মে যারা যাচ্ছে তাদের বেশির ভাগই শুনেছি কাজ পাচ্ছে না।

একজন কর্মীর এই প্রক্রিয়ায় বিদেশে যেতে কত টাকা খরচ হতে পারেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে দুবাইয়ের রেসিডেন্ট পারমিটধারী ব্যবসায়ী কবির আহমেদ নয়া দিগন্তকে বলেন, ভিসা প্রসেসিং, বহির্গমন ছাড়পত্র, বিমান টিকিট ও কনসাল অফিসের সত্যায়ন খরচ মিলিয়ে মোট দুই লাখ টাকা। আর এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট করে গেলে সে ক্ষেত্রে দুই লাখ ২০ হাজার টাকার মতো লাগছে।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/585508/