১ জুন ২০২১, মঙ্গলবার, ১:০৪

নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে জনমনে চাপা ক্ষোভ

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন ইয়াসিন আরাফাত। কিছুটা কমদামে বাজার পাওয়ার আশায় কাওরান বাজারে আসেন। কিন্তু বাজার শেষে এ প্রতিবেদকের কাছে জানালেন, মোহাম্মদপুর কাঁচা বাজারে যে দামে শাক সবজি, মাছ মুরগিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পাওয়া যায়, পাইকারি এ মার্কেটেও প্রায় কাছাকাছি দাম। তবে খেয়ে বাঁচতে হবে, তাই যেসব নিত্যপণ্য দরকার তা কমিয়ে হলেও কিনে বাসায় ফিরছি। আমাদের মতো মধ্যবিত্তের কষ্ট দেখার কেউ নেই। নিত্যপণ্য কিনতে আসা ভ্যানচালক মো. জাহিদুল ইসলাম বলেন, সরকার আমাদের মতো গরিবের খবর নেয় না। খবর নিবে বড় বড় ব্যবসায়ীদের। বাজারে অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, বাজারে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে। কিভাবে পিতা মাতা, স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকবেন সেই চিন্তায় দিশেহারা।

সূত্র মতে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে পণ্যের দাম শুরুতে যা ছিল এখন সেটি ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। চাল থেকে শুরু করে, ডাল, ভোজ্যতেল, আটা, পেঁয়াজ, মুরগির মাংস, ডিম, চিনি, লবণসহ বেশ কিছু নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে হু হু করে। খোদ সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) পণ্যমূল্য তালিকায় এ চিত্র উঠে এসেছে। সংস্থাটি তথ্যমতে, গত বছরের একই সময়ের তুলনায়ও বর্তমানে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্য বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে প্রতি কেজি পণ্যে ভোক্তাকে ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় করোনাকালে আয় কমায় ও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তারা দিশেহারা। এতে সবচেয়ে বেশি হিমশিম খাচ্ছেন নিম্ন আয় ও খেটে খাওয়া মানুষ।

টিসিবির তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে সরু চাল কেজিতে ১ দশমিক ৬৭ শতাংশ দাম বেড়েছে। মাঝারি আকারের চাল কেজিতে ১১ দশমিক ৫৮ শতাংশ ও মোটা চাল কেজিতে ৮ দশমিক ১৪ শতাংশ দাম বেড়েছে। প্রতি কেজি খোলা আটার দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৩৩ শতাংশ। বছর ব্যবধানে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৩৮ দশমিক ৮৯ শতাংশ, প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিনের দাম বেড়েছে ৩৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং লুজ পাম অয়েলের দাম বেড়েছে লিটারে ৭৫ শতাংশ। প্রতি কেজি মুগ ডাল বছরের ব্যবধানে ১৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে কেজিতে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বেশি দরে। দেশি হলুদ ২৫ শতাংশ, চিনি ১৬ শতাংশ, প্যাকেটজাত লবণ ৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। আর দেশি মুরগি প্রতি কেজিতে ২ দশমিক ১১ ও প্রতি হালি (৪ পিস) ফার্মের ডিমের দাম বছরের ব্যবধানে ১৯ দশমিক ২৩ শতাংশ বেড়েছে।

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, করোনাকালে দেশের মানুষের আয় কমেছে। কিন্তু নিত্যপণ্য কিনতে বেশি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। তাই পণ্যের দাম যাতে সহনীয় থাকে এ ব্যাপারে সরকারকে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। অনেক পণ্য আছে যেগুলো দেশে উৎপাদন হয়। আবার অনেক পণ্য আমদানি করতে হয়। সেক্ষেত্রে যেসব দেশ থেকে পণ্য আসে সেসব দেশে দাম বাড়লে আমাদের দেশেও বাড়বে। এটাই স্বাভাবিক। তাই আমদানি করা নিত্যপণ্যের ওপর সব ধরনের শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করলে পণ্যের দাম স্থিতিশীল থাকবে। তিনি আরও বলেন, করোনাকালে দেশের মানুষ অনেকেই চাকরি হারিয়েছেন। অনেকেরই আয় কমেছে। নতুন করে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। তাই এসব দিকে সরকারের খেয়াল রাখা দরকার। মানুষের আয় কিভাবে বাড়বে সেদিকে লক্ষ্য রেখে কাজ করতে হবে।
টিসিবির তথ্যমতে, প্রতি কেজি মোটা চাল বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকায়, গত বছর একই সময় ছিল ৩৫ টাকা। প্রতি কেজি মাঝারি আকারের চাল ৫০ টাকা থেকে বেড়ে ৫৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি কেজি সরু চাল সর্বনিম্ন বিক্রি হয়েছে ৫৮ টাকা, গত বছর ছিল ৫৫ টাকা। প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলে ৩৪ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১২৬ টাকায়। বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন ৪০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়। পাম অয়েল লুজ প্রতি লিটারে ৪৯ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১১৪ টাকা। প্রতি কেজি মুগ ডাল বছরের ব্যবধানে ১০ টাকা বেড়ে ১১০-১৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমদানি করা পেঁয়াজ কেজিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩৫ টাকা। দেশি হলুদ কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা। প্রতি কেজি চিনি ১০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৭৫ টাকা। পাশাপাশি প্রতি কেজি প্যাকেটজাত লবণ ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০ টাকা। এছাড়া বছরের ব্যবধানে দেশি মুরগি কেজিতে ৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ টাকা। ফার্মের ডিম প্রতি হালিতে ৫ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ৩২ টাকা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের মার্চে ২৭৭ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ পণ্য ও সেবা পাওয়া যেত, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত সেই পরিমাণ পণ্য ও সেবা নিতে ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় ৩’শ টাকা। আলোচ্য এই সময়ে পণ্য ও সেবা কিনতে ১৫ টাকা বেশি খরচ করতে হচ্ছে। সেক্ষেত্রে শতকরা হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ। ওই সময় সবচেয়ে বেশি বেড়েছে খাদ্যপণ্যের দাম। গত বছরের মার্চে ৩০১ টাকা দিয়ে যে পরিমাণ খাদ্যপণ্য পাওয়া যেত, একই পণ্য কিনতে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে ৩১৮ টাকা। আলোচ্য সময়ে বেশি ব্যয় হয়েছে ১৭ টাকা। সেক্ষেত্রে শতকরা হিসাবে ব্যয় বেড়েছে ৫ দশমিক ৫১ শতাংশ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন ধরনের অজুহাত সামনে রেখে বাজার অস্থির হওয়ার বিষয়টি যেমন নতুন নয়, তেমনি কারসাজিসহ নানা কারণেই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয় বারবারই আলোচনায় আসে। অথচ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে নিম্নআয়ের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে, যা বলার অপেক্ষা রাখে না। পত্র-পত্রিকায় এসব নিয়ে মানুষের ভোগান্তির চিত্র উঠে আসলেও সরকার সেভাবে ব্যবস্থা নিচ্ছে না। অনেকেই বলেছেন, কোম্পানিগুলো তাদের খেয়াল-খুশিমতো ব্যবসা পরিচালনা করছে। পণ্যের দাম কমা-বাড়া নিয়ে কোনো নির্দিষ্ট ও কঠোর আইন না থাকার কারণে এ রকম সুযোগ নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। বিশিষ্টজনরা বলছেন, মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপে এমনিতেই জনসাধারণের জীবনে নানা ধরনের সংকট বিদ্যমান। ফলে এমন পরিস্থিতিতে বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা সরকারেরই দায়িত্ব।

বাজারে চাল, পেঁয়াজ ও আলুর মতো নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার জন্য ব্যবসায়ীদের ‘সিন্ডিকেট’ এবং তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে বিশিষ্টজনরা। বিএআরসির গবেষণা দলের সমন্বয়ক ও প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম তার এক প্রতিবেদনে বলেন, ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যখন খুশি নিজেদের মতো করে নিত্যপণ্যের দাম বাড়াচ্ছে। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণে অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যে কতটা শক্তিশালী এবার দেশজুড়ে একযোগে কেজি দরে তরমুজ বিক্রির চিত্রই তা বলে দিয়েছে। চাষিদের কাছ থেকে পিস হিসেবে কেনা তরমুজ কেজি দরে কিনতে বাধ্য হয়েছেন ক্রেতারা। এতেই প্রমাণ মেলে সিন্ডিকেটের কাছে কীভাবে জিম্মি হয়ে আছে তারা। এমনকি ভ্রাম্যমাণ আদালত বিভিন্ন জায়গায় জরিমানা করলেও ভাঙা যায়নি সেই সিন্ডিকেট।

সূত্র মতে, পবিত্র ঈদুল ফিতর সামনে রেখেই বিভিন্ন সক্রিয় হয়ে উঠে এসব অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। রমজান শেষ হলেও সেই সিন্ডিকেট এখনো আছে। সরকার টিসিবির পণ্য বিক্রির কার্যক্রম জোরদার করায় অনেকেই বলেছিল, সেই সিন্ডিকেটের শক্তি কমে যাবে। কিন্তু মূলত সেটি দেখা যাচ্ছেনা। কারণ চাহিদার মাত্র ৮-১০ শতাংশ পণ্য ন্যায্যমূল্যে বিক্রি করে তারা।

এদিকে, গত কয়েক বছরে বিভিন্ন সময় চাল, পেঁয়াজ ও আলুর বাজারে অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণ উদঘাটনে গবেষণা চালায় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল (বিএআরসি)। সরকারি এই প্রতিষ্ঠান চলতি বছর জানুয়ারিতে তাদের প্রকাশিত গবেষণার ফলাফলেও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির জন্য অসাধু সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছে। একই সাথে ব্যবসায়ীদের এই ‘সিন্ডিকেট’ এবং তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করেছে বিএআরসি। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সরকারকে সিন্ডিকেটের হোতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানিয়েছেন ভুক্তভোগী এবং বাজার বিশ্লেষকরা।

নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তিনি বলেন, এতে সাধারণ মানুষের মধ্যে চাপা হাহাকার বিরাজ করছে। কিন্তু সরকার নির্বিকার, যেন কিছুই করার নেই। বিশ্ব বাজারে দাম বেড়েছে এই অজুহাতে সয়াবিন তেলে দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা উল্লেখ করে জিএম কাদের বলেন, চাল, ডালসহ খাদ্য পণ্যের দামও বেড়েছে। অথচ করোনাকালে কাজ হারিয়ে বেকার হয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। আয় কমেছে কয়েক কোটি মানুষের। জাপা চেয়ারম্যান বলেন, মাঝে মাঝে টিসিবির মাধ্যমে গরিব মানুষের জন্য কিছু খাদ্য পণ্য বিক্রি করা হয়, তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে টিসিবির পক্ষে কোনো পণ্যই চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট পরিমাণ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে টিসিবির মাধ্যমে ভর্তুকি দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। মুক্ত বাজার অর্থনীতিতে সেটা কাম্যও নয়। কেননা এতে করে তাৎক্ষণিকভাবে মূল্য হ্রাস হলেও দীর্ঘমেয়াদে পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যেতে পারে যাতে সাধারণ ব্যবসায়ীরা বাজারজাতকরণে নিরুৎসাহিত হবে ও সরবরাহ ঘাটতি হয়ে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণহীন হতে পারে।

পরিকল্পিতভাবে চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের সহজলভ্যতা ও সরবরাহ নিশ্চিত করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার আহ্বান জানিয়ে সাবেক এই বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, এখানে দুটো জিনিসের ওপর বিশেষ দৃষ্টি দিয়ে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রথমটি হলো সরবরাহকারীরা যাতে নিজেদের মধ্যে সিন্ডিকেট সৃষ্টি করে বাজার মূল্যের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিতে ইচ্ছামতো দাম বাড়াতে না পারে। আর দ্বিতীয়টি হলো সরবরাহকারীরা যেন বিভিন্ন পর্যায়ে বারবার চাঁদা বা ঘুষ দিতে বাধ্য না হয়। এতে তাদের পক্ষে ন্যায্যা দামে পণ্য বিক্রি অম্ভব হয়ে যায়।

বাংলাদেশ লেবারপার্টির চেয়ারম্যান ডাঃ মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, চাল ডাল তেল-সহ দ্রব্যমুল্য দফায় দফায় বৃদ্ধির কারণে জনগন দিশেহারা। দুর্নীতি লুটপাট ও দুঃশাসনের কারণে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে। অসাধু কালোবাজারী সিন্ডিকেট চক্র সরকার দলীয় হওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণে আসছে না। সরকার দলীয়রা মেগা প্রকল্পের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ও পাচার করার কারণে অর্থনীতি জড়াগ্রস্ত হওয়ায় দ্রব্যমূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।

https://dailysangram.com/post/454116