৩১ মে ২০২১, সোমবার, ১২:৫৪

করোনার নেতিবাচক প্রভাব মুদ্রানীতিতে

বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না

অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধে (জানুয়ারি-জুন) বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ শেষে অর্জিত হয়েছে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে গত এপ্রিল ও মে মাস জুড়েই ছিল লকডাউন। লকডাউনের সময়সীমা আরো এক সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জুন মাস শেষে বেসরকারি বিনিয়োগ ১০ শতাংশ অতিক্রম করা কষ্টকর হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। আর তা হলে গেল বছরের মতো এবারো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী মুদ্রানীতির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না বলে ওই সূত্র জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতির প্রক্ষেপণ অনুযায়ী বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের প্রকৃত অবস্থা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত কয়েক বছর যাবৎই বেসরকারি বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। গত প্রায় দুই বছর ধরে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রকৃত অবস্থা ১০ শতাংশের নিচেই অবস্থান করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ডিসেম্বর প্রান্তিকে বেসরকারি বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৮ শতাংশ। গত বছরের জুন প্রান্তিকে তা আরো কমে হয় ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল সাড়ে ১১ শতাংশ। কিন্তু বিপরীতে লক্ষ্যমাত্রার ধারে-কাছেও যেতে পারেনি। আগামী জুন শেষে ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এবারো তা ১০ শতাংশের ওপরে যাবে না।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ভোগব্যয় কমে গেছে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এতে বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে রফতানি আয়ে। আর রফতানি আয়ের সাথে আমদানি ব্যয় জড়িত রয়েছে। রফতানির জন্য পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। কিন্তু পণ্যের মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামালসহ সামগ্রিক পণ্য আমদানি কমে গেছে। আর আমদানি ব্যয় কমলে রফতানি স্বাভাবিকভাবেই কমে যাবে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের নেতিবাচক প্রভাবের কারণে প্রকৃত উদ্যোক্তারা এ মুহূর্তে নতুন করে বিনিয়োগ নিতে চাচ্ছেন না। কারণ, ব্যাংকের ঋণ নিলেই সুদে আসলে পরিশোধ করতে হবে। এ মুহূর্তে নতুন বিনিয়োগ নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করে মুনাফা ঘরে তোলা মোটেও সম্ভব নয়। এ কারণেই ঝুঁকির কথা ভেবে প্রকৃত ব্যবসায়ীরা নতুন করে ব্যবসা বাড়াতে চাচ্ছেন না।

এদিকে বেশির ভাগ ব্যাংকও নতুন করে বিনিয়োগ বাড়াতে চাচ্ছে না। এক দিকে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ঋণ আদায়ের ওপর শিথিলতা আরোপ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটা ধাপে ধাপে বাড়িয়ে চলতি মার্চ পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়। অর্থাৎ টানা এক বছর তিন মাস কোনো ব্যবসায়ী এক টাকাও ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ না করলেও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীকে খেলাপি করা যায়নি। এ কারণেই ব্যাংকগুলোর প্রকৃত ঋণ আদায় কমে গেছে। অপর দিকে, করোনার প্রাদুর্ভাবের প্রথম ধাক্কার পর আবার দ্বিতীয় ধাক্কা শুরু হয়েছে। তৈরী পোশাক রফতানির প্রধান বাজারগুলো বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে নতুন করে লকডাউন শুরু হয়েছে। এ মুহূর্তে উদ্যোক্তাদের অবস্থা এমনিতেই খারাপ অবস্থানে চলে এসেছে। এ অবস্থায় নতুন করে ব্যাংকঋণ দিলে ওই ঋণ ফেরত পাওয়া বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হবে না। এ কারণে সর্বসাধারণের ক্ষেত্রে নতুন ঋণ দিতে অনেকটা সাবধানতা অবলম্বন করছে ব্যাংকগুলো। তবে কিছু রাঘববোয়াল ঋণগ্রহীতাদের বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের বিপরীতে ঋণ দিতে হচ্ছে কিছু কিছু ব্যাংকের।

এভাবে গ্রাহক ও ব্যাংকের উভয়ের বাড়তি সতর্কতার ফলে সামগ্রিক নতুন ঋণ বাড়ছে না। ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতে ঋণের এ প্রবৃদ্ধি হচ্ছে মূলত ব্যাংকগুলোর পুরনো ঋণের সাথে নতুন করে মুনাফা বা সুদহার যুক্ত হওয়ার কারণে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আমানতের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে না দিলেও ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার বেঁধে দিয়েছে গত বছরের এপ্রিল থেকে। বলা হয়েছে, ক্রেডিট কার্ডের ঋণ ছাড়া আর সব ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ শতাংশ। বিদ্যমান ঋণ ১১ লাখ কোটি টাকা হলে আর একটাকাও ঋণ বিতরণ না করলেও ৯ শতাংশ সুদহার যুক্ত হওয়ায় বছর শেষে পুঞ্জীভূত ঋণ ১১ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা হবে। এভাবেই বেড়ে যাচ্ছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ প্রবাহ।

তবে কিছু উদ্যোক্তা প্রকৃতভাবেই টাকার সঙ্কটে ভুগছেন। করোনাভাইরাসের প্রভাবে আয় কমে যাওয়ায় তারা পুঁজির সঙ্কটে ভুগছেন। পুঁজির অভাবে অনেকেই নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে পারছেন না। এমন একজন উদ্যোক্তা জানিয়েছেন, তারা টাকার সঙ্কটে ভুগছেন। ব্যাংকগুলো থেকে কোনো সহযোগিতা পাচ্ছেন না। গত বছর তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের শুধু ঋণের সুদ পরিশোধ করেছেন ২৩ কোটি টাকা। তিনি কখনো খেলাপি ছিলেন না। কিন্তু করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে তিনি ব্যাংকের ঋণ এখন ঠিকমতো পরিশোধ করতে পারছেন না। তাদের এই দুর্দিনে ব্যাংক থেকে তেমন কোনো সহযোগিতাও পাচ্ছেন না। উপরন্তু তাদেরকে নানাভাবে নাজেহাল হতে হচ্ছে। এখন ব্যাংকই পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে, ওই ব্যবসায়ীর মতো বেশির ভাগ উদ্যোক্তারই একই সমস্যা। ব্যাংক থেকে কাক্সিক্ষত হারে বিনিয়োগ পাচ্ছেন না।

তবে, ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, তাদের পরিচালন ব্যয় বেশি। গত বছরের জানুয়ারি থেকে ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছে। এটাই নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় বলে তারা মনে করছেন। তারা জানিয়েছেন, ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। বরং কখনো ঋণ পুনর্গঠন, কখনো সুদ মওকুফ করে, কখনো বা নামমাত্র ডাউন পেমেন্ট দিয়ে ঋণখেলাপিদের ছাড় দেয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকের পুঞ্জীভূত খেলাপি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের চেয়ে অদৃশ্য খেলাপি ঋণ প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমানতকারীদের অর্থে ঋণ দেয়া হয়। ঋণগ্রহীতারা ঋণ ফেরত না দিলে আমানতকারীদের অর্থ ফেরত দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এতে আস্থার সঙ্কটে পড়ে যাবে দেশের ব্যাংকিং খাত। বাধ্য হয়েই তারা বর্তমান পরিস্থিতিতে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করছেন।

https://www.dailynayadiganta.com/last-page/585281