বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের অতিসংক্রামক চারটি মিউট্যান্ট (রূপ) শনাক্ত হয়েছে বলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা: নাসিমা সুলতানা জানিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট (ধরন)। অন্য দিকে গতকাল রোববার পর্যন্ত ২৬৩টি নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে ১৪০টিতে চারটি ধরন পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক ডা: তাহমিনা শিরিন।
অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলেন, ‘২৭টিতে যুক্তরাজ্যের ধরন, ৮৫টিতে দক্ষিণ আফ্রিকার, ৫টিতে নাইজেরিয়ার এবং ২৩টিতে ভারতীয় ধরন মিলেছে। করোনাভাইরাসের যেসব ধরন পাওয়া গেছে এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ধরনটি হলো ভারতীয় ধরন (বি.১.৬১৭)। এ ধরনটি ভারতে করোনা পরিস্থিতিকে ভয়াবহ করে তুলেছে।
ডা: তাহমিনা ভারতের ধরন সম্পর্কে বলেন, ভারত থেকে আসা ব্যক্তি এবং তাদের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্স করে বাংলাদেশে ২৩ জনের দেহে ভারতীয় ‘ভ্যারিয়েন্ট’ পাওয়া গেছে।
ইতোমধ্যে সরকার ভারতীয় ধরনটির বাংলাদেশে সংক্রমণ রোধে প্রতিবেশী দেশটির সাথে সব ধরনের চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। এর মধ্যেই বাংলাদেশে সীমান্ত জেলাগুলোতে ভারতীয় ধরনের কিছু করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে। ফলে সীমান্ত জেলাগুলোতে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।
এ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের টিকা প্রস্তুতকারী কোম্পানি মডার্নার প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মেলিসা মুরের বরাত দিয়ে সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে, সামনের দিনগুলোতে করোনাভাইরাসের আরো নতুন ভাইরাল ভ্যারিয়েন্ট আসছে, নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসার পথেই রয়েছে।
মেলিসা মুর বলেন, যেহেতু করোনা ভাইরাসটি খুবই দ্রুত ছড়াচ্ছে সে কারণে এটি খুব দ্রুততার সাথে রূপান্তর হচ্ছে। কিছু নতুন ভাইরাল স্ট্রেনের (রূপ) আবির্ভাব হবে, যা হবে অনেক বেশি সংক্রামক। এটি মূল ভাইরাসের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুততার সাথে ছড়াবে। আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি, নতুন স্ট্রেনগুলোকে আমাদের বর্তমান টিকা দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হচ্ছে। মডার্না নতুন ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে টিকার ক্রমাগতভাবে পরীক্ষা করে যাচ্ছে।
এ ব্যাপারে মডার্নার সহযোগী পরিচালক গিলিউম স্টুয়াট জোনসের মন্তব্য হলোÑ ‘নতুন ভাইরাল ভ্যারিয়েন্ট (ভাইরাসের নতুন ধরন) আসছে, এগুলোর আগমণ সময়মতোই হবে।’ তবে সব ভ্যারিয়েন্টই যে বর্তমান ভ্যারিয়েন্টের চেয়ে বেশি ভয়াবহ হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বাংলাদেশে ফাইজারের তৈরি করোনাভাইরাসের টিকা আসবে আজ সোমবার রাতে। এর আগে অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা: রোবেদ আমীন গতকাল রাতেই ফাইজারের টিকা আসার কথা জানালে এটি নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। এ ব্যাপারে ভ্যাকসিন ডেপ্লয়মেন্ট কমিটির সদস্য সচিব ডা: শামসুল হক বলেন, ‘আমরা জানতাম আজ রাতেই যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার ও জার্মান জৈবপ্রযুক্তি কোম্পানি বায়োএনটেকের তৈরি করোনাভাইরাস প্রতিষেধক টিকার প্রথম চালান আসছে। কিন্তু পরে কার্গোর কনফারমেশনের তথ্য অনুসারে জানা গেছে, আজ (গতকাল রোববার) রাতে নয়, আজ সোমবার রাত ১১টা ২০ মিনিটে এসে পৌঁছাবে।’
এ দিকে গতকাল রোববার সারা দেশে ১৪ হাজার ২৭৭টি নমুনা পরীক্ষা করে এক হাজার ৪৪৪ জনকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। করোনায় আক্রান্ত হয়ে গতকাল সারা দেশে মৃত্যুবরণ করেছে ৩৪ জন। দেশে গতকাল করোনা শনাক্তের শতকরা হার ১০.১১ শতাংশ। শতাংশের দিক থেকে করোনা শনাক্ত বেড়েছে। এর মধ্যেই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে সীমান্ত অঞ্চলের মানুষ। কারণ সীমান্ত অঞ্চলের মানুষের মধ্যে বৈধ ও অবৈধ উভয় উপায়েই ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশের সাথে যোগাযোগ বেশি হয়ে থাকে।
জানা গেছে, কিছু বাংলাদেশী ভারত থেকে প্রতিদিনই ফেরত আসছেন। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে সবাইকে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টিনে রাখা হচ্ছে এবং করোনা নেগেটিভ হলে তারা বাড়িতে যেতে পারছেন।
গতকাল করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের মধ্যে ২৩ জন পুরুষ ও ১১ জন নারী। মৃত্যুবরণকারীদের ২১ জন ষাটোর্ধ্ব । এদের মধ্যে ঢাকা বিভাগের আটজন, চট্টগ্রাম বিভাগের ১২ জন এবং খুলনা বিভাগের ছয়জন। এদের মধ্যে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ২১ জন এবং বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ১০ জন। তিনজন বাড়িতে অবস্থান করছিলেন।
রাজধানী ঢাকায় কোভিড ঘোষিত সরকারি ১৫ হাসপাতালে ৩৭৪টি আইসিইউ শয্যার মধ্যে গতকাল ২৫০টিই খালি ছিল বলে স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে। অন্য দিকে একই ১৫ হাসপাতালের তিন হাজার ৪৬৫টি সাধারণ শয্যার মধ্যে দুই হাজার ৭৩৮টি শয্যাই খালি ছিল। কারণ করোনা সংক্রমণ আগের চেয়ে অনেক।
রামেক হাসপাতালে এক দিনে রেকর্ড ১২ জনের মৃত্যু
রাজশাহী ব্যুরো জানায়, প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ও উপসর্গ নিয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন শনাক্ত হওয়ার পর রামেক হাসপাতালে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যুর রেকর্ড এটি।
রামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত শনিবার সকাল ১০টা থেকে গতকাল রোববার সকাল ১০টা পর্যন্ত হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১২ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে আটজন মারা গেছেন করোনা সংক্রমণ নিয়ে। আর চারজনের মৃত্যু হয়েছে করোনার উপসর্গ নিয়ে। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে সাতজন করোনার নতুন হটস্পট চাঁপাইনবাবগঞ্জের বাসিন্দা। বাকিদের মধ্যে রাজশাহীর দুইজন, নওগাঁর দুইজন ও নাটোরের একজন। করোনা সংক্রমণ ও উপসর্গ নিয়ে এরা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন।
রামেক হাসপাতালের উপপরিচালক ডা: সাইফুল ফেরদৌস সাংবাদিকদের জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় রামেক হাসপাতালে ১২ জন মারা গেছেন। তাদের মধ্যে আটজন মারা গেছেন করোনা সংক্রমণে। আর সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন অপর চারজন।
তিনি আরো জানান, মৃত্যুর পর সন্দেহভাজন করোনা রোগীদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। বাড়তি সতর্কতা হিসেবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে লাশ দাফনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
রামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, রোববার সকাল ১০টা পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ ও উপসর্গ নিয়ে রামেক হাসপাতালে এসেছেন ২০৯ জন। এর মধ্যে করোনা ধরা পড়েছে ৭৫ জনের। করোনা সংক্রমণের উপসর্গ রয়েছে বাকি ১৩৪ জনের। তারা সবাই হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি। আশঙ্কাজনক অবস্থায় আরো ১২ জন হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসাধীন রোগীদের মধ্যে বেশির ভাগই এসেছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে।
এর আগে গত মঙ্গলবার দুপুর থেকে শনিবার দুপুর পর্যন্ত রামেক হাসপাতালে করোনা সংক্রমণ ও উপসর্গ নিয়ে ২৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। এর মধ্যে ১৫ জনই চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দা। তাদের মধ্যে ১১ জনই মারা গেছেন করোনা সংক্রমণের উপসর্গ নিয়ে। ফলে করোনায় মৃতের তালিকায় তাদের নাম ওঠেনি বলে বিভাগীয় স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে।
চট্টগ্রামে মৃত্যু বেড়েছে
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, চট্টগ্রামে করোনা সংক্রমণ কমে এলেও বেড়েছে মৃত্যুর হার। গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া ৭৩৭টি নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হয়েছে ৮২ জনের। এ নিয়ে মোট আক্রান্ত ৫৩ হাজার ২৫১ জন। গতকাল সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
সিভিল সার্জন ডা: সেখ ফজলে রাব্বি জানান, চট্টগ্রামে নতুন আক্রান্তদের মধ্যে নগরের ৪৯ জন এবং উপজেলায় ৩৩ জন।