৩ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১১:৩১

অবৈধ ভিওআইপি প্রযুক্তিতে প্রতিদিন ৫ কোটি ৪৫ লাখ মিনিট আন্তর্জাতিক কল আসছে

|| এক বছরে ৩৩ অভিযানে ৩০ হাজার ১৪৭ সিম জব্দ
|| ভাইবার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ ও স্কাইপের সহজলভ্যতায় বৈধ কল কমেছে
|| টার্মিনেশন রেট বাড়ানোর ফলে বেড়েছে অবৈধ কল
|| কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার
দিনের পর দিন চেষ্টা করেও বন্ধ করা যাচ্ছে না অবৈধ ভিওআইপি’র ব্যবহার। এতে করে অবৈধভাবে প্রতিদিন কোটি কোটি মিনিট মোবাইল ও টেলিফোন আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল দেশে আসছে। অবৈধ এই প্রযুক্তির কারণে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব। অনেক চেষ্টা এবং অভিযান চালিয়ে অবৈধভাবে আসা আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল রোধ করা যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী কর্মের তাগিদে বিদেশ গমন করে। তাদের পাঠানো রেমিটেন্স দিয়ে এদেশের অর্থনীতিতে বেশীর ভাগ অবদান রাখছে। প্রবাসে থাকা এসব মানুষ প্রতিদিনই তাদের পরিবার-পরিজনের সাথে মোবাইল কিংবা টেলিফোনে যোগাযোগ করছেন। তাদের এ যোগাযোগ বৈধ পন্থায় হলে যেমন দেশের রাজস্ব বাড়বে তেমনি ভিওআইপির অবৈধপন্থায় যোগাযোগ করায় রাজস্ব ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
ভয়েস ওভার ইন্টারনেট প্রটোকল (ভিওআইপি) প্রযুক্তি ব্যবহার করে অবৈধ পথে আন্তর্জাতিক কল কমাতে বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)। এসব উদ্যোগের পরও অবৈধ ভিওআইপি কল কমেনি।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, এখন প্রতিদিন প্রায় ৫ কোটি ৪৫ লাখ মিনিট আন্তর্জাতিক কল অবৈধভাবে দেশে আসছে। দেশে বর্তমানে আন্তর্জাতিক ইনকামিং কল আসছে প্রতিদিন গড়ে ১২ কোটি মিনিটের মতো। এর মধ্যে বৈধ পথে আসছে মাত্র ৬ কোটি ৫৫ লাখ মিনিট, বাকিটা অবৈধ পথে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈধ কল কমার পেছনে মূলত টেলিযোগাযোগ খাতে নেয়া কিছু বিতর্কিত উদ্যোগই দায়ী, যার মধ্যে অন্যতম কল টার্মিনেশন রেট বৃদ্ধি। এছাড়া অবৈধ ভিওআইপিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত দুই প্রতিষ্ঠান টেলিটক ও বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) বিরুদ্ধেও।
তবে টেলিটক দাবি করছে, বিটিআরসির নির্দেশনার আলোকে টেলিটকও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শনাক্তকৃত নম্বরগুলো স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় ব্লক করে বিটিআরসিকে অবহিত করে। টেলিটক দিনে ১২ বার স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় বিটিআরসি নির্দেশিত ছয়টি লজিক ও টেলিটকের নিজস্ব আরো দুটি লজিক প্রয়োগ করে অবৈধ ভিওআইপি কাজে ব্যবহার হচ্ছে, এমন সন্দেহজনক সিম শনাক্ত করে। শনাক্তকরণের পর পরই সিমগুলোর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়।
তবে অবৈধ ভিওআইপি বন্ধের চেষ্টা করে যাচ্ছে বিটিআরসি। গত এক বছরে ৩৩টি অভিযান পরিচালনা করে বিটিআরসি। এসব অভিযানে অবৈধ কল টার্মিনেশনে ব্যবহৃত বিপুলসংখ্যক চ্যানেল বক্স, জিএসএম গেটওয়ে, সফটসুইচ, সার্ভার, রাউটার, মডেম, সেলফোন হ্যান্ডসেট, লেন সুইচ, কলিং কার্ড ও ভুয়া তথ্যে নিবন্ধিত সিম উদ্ধার করা হয়। অভিযানে মোট ৩০ হাজার ১৪৭টি এমন সিম আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে একক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবচেয়ে বেশি সিম আটক হয় টেলিটকের, ১০ হাজার ৮০৫টি। এছাড়া গ্রামীণে ফোনের ৪ হাজার ৯৫৬, বাংলালিংকের ১ হাজার ৯১, রবির ৬ হাজার ৯২৪, এয়ারটেলের (বর্তমানে রবির সঙ্গে একীভূত) ৬ হাজার ৩৬৩ এবং সিটিসেল ও র্যাংকসটেলের চারটি করে সিম আটক হয়। প্রতিটি অভিযানের ঘটনায় একটি করে মামলাও হয়।
মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা গেছে, বৈধ পথে কল কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ কল টার্মিনেশন রেট। অবৈধ ভিওআইপি কলের পরিমাণ কমিয়ে আনতে ২০১৪ সালের জুলাইয়ে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কাছে কল টার্মিনেশন চার্জ কমানোর বিষয়ে প্রস্তাব দেয় বিটিআরসি। এতে কলপ্রতি চার্জ দেড় সেন্ট নির্ধারণ করার প্রস্তাব করা হয়। ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক কল টার্মিনেশন রেট ছয় মাসের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে কমিয়ে আনার বিষয়ে নির্দেশনা জারি করে বিটিআরসি। এ সময় মিনিটপ্রতি সর্বনিম্ন রেট (ফ্লোর রেট) ৩ সেন্ট থেকে কমিয়ে দেড় সেন্ট করা হয়। পাশাপাশি কল আদান-প্রদান সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের আয় ভাগাভাগির অংশও অস্থায়ী ভিত্তিতে পনঃনির্ধারণ করা হয়। সেই সঙ্গে অপারেটরদের সঙ্গে বিটিআরসির রাজস্ব ভাগাভাগির কাঠামোও পনঃনির্ধারণ করা হয়। নতুন এ নিয়ম চালুর পর দৈনিক আন্তর্জাতিক ইনকামিং কলের পরিমাণ দাঁড়ায় গড়ে ১১ কোটি মিনিট। পরীক্ষামূলকভাবে চালু করা এ ব্যবস্থার মেয়াদ পরবর্তীতে একাধিকবার বাড়ানো হয়। এতে কলের পরিমাণ বাড়লেও সরকারের আয় কমে যায়। এর পরিপ্রেক্ষিতে কল টার্মিনেশন রেট বাড়ানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০১৫ সালের আগস্টে মিনিটপ্রতি কল টার্মিনেশন রেট দেড় সেন্ট থেকে বাড়িয়ে ২ সেন্ট করা হয়। ফলে আবার কমতে থাকে বৈধ কলের পরিমাণ।
বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, ভিওআইপি প্রযুক্তির অবৈধ ব্যবহারের ব্যাপকতার কারণে বৈধ পথে প্রতিদিন আন্তর্জাতিক কল এসেছে ৬ কোটি ৫৫ লাখ মিনিটে ৩ কোটি মিনিট। অথচ ২০১৫ সালের বৈধ পথে কল এসেছে প্রতিদিন ১২ কোটি মিনিট।
বিটিআরসি বলছে, ভিওআইপি প্রযুক্তি ব্যবহার করে অবৈধ পথে আন্তর্জাতিক কল কমাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এটি শনাক্তে সিম বক্স ডিটেকশন সিস্টেম, সেলফ রেগুলেশন প্রসেস, সিগোস সিস্টেম ছাড়াও সম্প্রতি নতুন করে চালু হয়েছে থ্রিভিআই সিস্টেম। এছাড়া নিয়মিত পরিদর্শন ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মাধ্যমে অবৈধ ভিওআইপি কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি জব্দ ও ব্যবসায়ীদের আটক করা হচ্ছে। এছাড়া অবৈধ কল টার্মিনেশন রোধে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন মনিটরিং কমিটি করেছে বিটিআরসি। এর মাধ্যমে অবৈধ কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা আরো জোরদার করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বৈধ পথে আন্তর্জাতিক কল কমে যাওয়ার জন্য ওভার দ্য টপ (ওটিটি) অ্যাপসেরও ভূমিকা রয়েছে। সেলফোনে ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ার পাশাপাশি ভাইবার, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপ ও স্কাইপের মতো নানা ওটিটি এপ্লিকেশন জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এর প্রভাব পড়ছে বৈধ পথে আসা কলের ওপর। অনেকেই আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে এসব অ্যাপ ব্যবহার করছেন।
বিটিআরসি চেয়ারম্যান ড. শাহজাহান মাহমুদ এক সাংবাদিক সম্মেলনে দাবি করেছেন, অবৈধ ভিওআইপি ব্যবসা বন্ধের কার্যক্রম একটি চলমান প্রক্রিয়া। এ ব্যবসা বন্ধ করতেই বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম নিবন্ধন চালু করা হয়েছে। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা হচ্ছে। এতে সংশ্লিষ্টদের জরিমানাও করা হচ্ছে। অবৈধ ভিওআইপিতে যুক্ত সিম বন্ধে আগে অপারেটরদের ৪ ঘণ্টা সময় দেয়া হতো, যা কমিয়ে আনা হয়েছে। এটি সম্পূর্ণ বন্ধ করা যাবে না, কিছু না কিছু থাকবেই। তবে আগের চেয়ে অনেক কমিয়েছি, আরো কমে যাবে।

 

http://www.dailysangram.com/post/278267