২৯ মে ২০২১, শনিবার, ৩:২২

ঢাকার হারিয়ে যাওয়া খাল পুনরুদ্ধার

সীমানা নির্ধারণই চ্যালেঞ্জ

বর্ষায় থাকছে জলাবদ্ধতা: সচল রাখায় বড় বাধা দখল

ঢাকায় হারিয়ে যাওয়া খালগুলো পুনরুদ্ধারে সীমানা নির্ধারণই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুই সিটি করপোরেশন গত সাড়ে চার মাসে কিসের ভিত্তিতে সীমানা চিহ্নিত হবে তা চূড়ান্ত করতে পারেনি। এ ছাড়া খালগুলো দখলমুক্ত, সংস্কার ও আধুনিকায়ন করার পদ্ধতিও নির্ধারণ করেনি।

বিশেষজ্ঞদের মতে, খাল সচল রাখার ক্ষেত্রে বড়া বাধা হচ্ছে অবৈধ দখল। সীমানা চিহ্নিত না হওয়ায় দখলদারদের শনাক্তের পর উচ্ছেদ করা যাচ্ছে না। এতে খালগুলো হারানো অবস্থা ফিরে না পাওয়ায় বাড়ছে না পানির প্রবাহ।

বিভিন্ন জরিপ ও সরকারি তথ্যে উঠে আসা চিত্র বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, খাল দখল করে সড়ক, বক্সকালভার্ট, ড্রেন, বাড়িঘর, মার্কেট নির্মাণ, আবর্জনার ভাগাড় ও বিভিন্ন আবাসন প্রকল্পে ঢুকিয়ে ফেলা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং প্রভাবশালী মহল। অতীতেও দায়িত্বপ্রাপ্তরা নানাভাবে চেষ্টা করেছেন এগুলো দখলমুক্ত করতে। কিন্তু কেউ তেমন সফল হননি। এ অবস্থায় গত ৩১ ডিসেম্বর দুই সিটি করপোরেশনের কাছে খালগুলো হস্তান্তর করা হয়।

এর পরপরই দুই সিটির তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়। খালের আবর্জনা পরিষ্কারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। এ সংক্রান্ত কার্যক্রম গণমাধ্যমগুলোতে ছবিসহ প্রকাশ হয়। তবে কিছু দিন যাওয়ার পরই যথারীতি এর গতি কমতে থাকে। শুরুতেই পরিষ্কার করা খালগুলো আবার আবর্জনায় ভরে যাচ্ছে। এতে পানির প্রবাহ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় আসন্ন বর্ষা মৌসুমে ঢাকাবাসীকে ফের জলাবদ্ধতায় নাকাল হতে হবে।

এ প্রসঙ্গে নদী ও খালবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খাল বুঝে পাওয়ার পর চার মাস অতিবাহিত হলেও এখনো একটি খালেরও সীমানা চিহ্নিত করতে পারেনি দুই সিটি করপোরেশন। দুই সিটি বিগত চার মাসে অন্তত দুটো খালের সীমানা চিহ্নিত করে মডেল সৃষ্টি করতে পারত। তা হলে আমরা বলতে পারতাম, টেকসই উন্নয়নের যে স্বপ্ন দুই সিটি মেয়র দেখিয়েছেন তারা সে পথে হাঁটছেন। কিন্তু তেমন কিছু না দেখে আমরা হতাশ হয়েছি।

তিনি বলেন, প্রথম দিকে দুই সিটির খাল উদ্ধারে আমরা যেমন তোড়জোড় দেখেছিলাম, এখন তেমনটা দেখছি না। অনেক খালপাড়ে এখনো আবর্জনার ভাগাড় রয়েছে। সেসব অপসারণে দুই সিটির তেমন কোনো তৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে না। খাল উদ্ধারের দুর্বল উদ্যোগের কারণে আমরা আমাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে ডিএনসিসির রামচন্দ্রপুর ও ডিএসসিসির দেবধোলাই খালের সীমানা নির্ধারণ, সংস্কার ও আধুনিকায়নের প্রস্তাব দেব। সে লক্ষ্যে আমাদের সংগঠন কাজ শুরু করেছে।

এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন যাবত বিশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয়েছে। বর্তমানে সেখান থেকে সরে এসে সঠিকপথে হাঁটা শুরু করেছে। তবে খালগুলোর সীমানা নির্ধারণসহ টেকসই উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু করতে হবে। যেটা এখনো দৃশ্যমান নয়, দুই সিটিকে সে পথে হাঁটতে হবে। সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।

জানা যায়, বিগত বছরগুলোতে ঢাকার খাল ও পানি নিষ্কাশন নর্দমার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ছিল কয়েকটি সংস্থার হাতে। এ কারণে এক সংস্থা অন্য সংস্থার ওপর দায় চাপানোর প্রচেষ্টা চালাত। গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ২৬টি খাল ঢাকার দুই সিটির নিকট হস্তান্তর করা হয়। সেগুলো পরিষ্কার করে প্রবহমান রাখার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে দুই সিটি।

একই সঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ড, রাজউক ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাছে আরও ১৩টি খাল, স্লুইচ গেট, পাম্পস্টেশন বুঝিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য ঢাকা শহরের পানি নিষ্কাশনের মূল কার্যক্রম দুই সিটির হাতে বুঝিয়ে দেওয়া। এতে সমন্বয়হীনতা দূর হলেও সীমানা নির্ধারণ করে টেকসই উন্নয়ন না করলে ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তথ্যমতে, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে ডিএসসিসি পেয়েছে জিরানী খাল, কালুনগর খাল, মান্ডা ও শ্যামপুর খাল। আর পান্থপথ, সেগুনবাগিচা, কমলাপুর ও ধোলাইপাড় বক্সকালভার্টের দায়িত্ব পেয়েছে। এ ছাড়া শ্যামপুর খালের শাখা খাল-কাজলা, তিতাস, কুতুবখালী উত্তর ও দক্ষিণ খাল, বরইতলা খাল পরিষ্কার করা হয়েছে। একই সঙ্গে ধোলাইপাড়, ধোলাই খাল, বুড়িগঙ্গার শাখা নদী ও মাতুয়াইলের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে।

সরেজমিন দেখা গেছে, ডিএসসিসি কুতুবখালী খাল পরিষ্কার করলেও সেখানে নতুন করে আবর্জনা ফেলছে নগরবাসী। এ কারণে ওই কুতুবখালী উত্তর ও দক্ষিণ খালের প্রবাহ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ডিএসসিসির আওতাভুক্ত বুড়িগঙ্গা শাখা নদী এখনো অপরিষ্কার অবস্থায়ই পড়ে রয়েছে। আসন্ন বর্ষার আগে ওই শাখা নদী পরিষ্কার না করলে এলাকার পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হবে। সায়েদাবাদ ও ডেমরা এলাকা দিয়ে প্রবাহিত খালগুলো আবর্জনা ও নোংরা পানিতে পূর্ণ দেখা গেছে।

আরও জানা যায়, মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজের কারণে শ্যামপুর খালের শাখা খাল বরইতলী খালের প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বিষয়টি সুরাহা করতে ডিএসসিসি মেয়র মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। এর পরও আসন্ন বর্ষার আগে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। জুরাইন থেকে শ্যামপুর খালের সঙ্গে সংযুক্ত কিছু এলাকার পানি নিষ্কাশন নেটওয়ার্ক বেসরকারি জায়গার ওপর দিয়ে সচল রয়েছে। ভবিষ্যতে ওই জমি অধিগ্রহণ করানো প্রয়োজন হতে পারে।

এ ছাড়া দায়িত্ব পাওয়ার পর কোন খালের নেটওয়ার্ক কোন দিকে, নতুন নেটওয়ার্ক কিভাবে সৃষ্টি করা যেতে পারে, এসব বিষয়ে বিস্তারিত কোনো কাজ করেনি ডিএসসিসি। তবে খালগুলোর টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি মেগাপ্রকল্প প্রস্তাব করেছে সরকারের কাছে। ইতোমধ্যে ওই প্রকল্পটি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অনুমোদন করেছে।

একনেকে অনুমোদন পেলে আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে কার্যক্রম শুরু হতে পারে। এ প্রকল্পের ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। একই সঙ্গে পান্থপথসহ আশপাশের এলাকার পানি নিষ্কাশন কার্যক্রম সচল রাখতে হাতিরঝিলের স্লুইস গেট খোলার ব্যবস্থা করেছে ডিএসসিসি। এসব কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পন্ন করতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ডিএসসিসিকে পাঁচ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে খাল, নর্দমা ও বক্সকালভার্ট পাওয়ার পর সেগুলোসহ ডিএসসিসির নিজস্ব নর্দমাগুলো পরিষ্কার করা হয়েছে। এগুলোতে পানির প্রবাহ ঠিক রাখতে রুটিন পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম অব্যাহত রাখা হয়েছে। তবে সীমানা নির্ধারণ করে টেকসই উন্নয়ন করতে সরকারের কাছে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে। সে অনুমোদন পেলে আগামী ডিসেম্বরে কাজ শুরু করা সম্ভব হবে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) তথ্যমতে, ডিএনসিসির এলাকায় মোট ২৯ খাল রয়েছে। এর মধ্যে ডিএনসিসি শুধু পুরাতন এলাকার ১৮টি খাল পরিষ্কারের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। ইতোমধ্যে একবার করে পুরো খাল পরিষ্কার করা হয়েছে। এরপর প্রতিনিয়ত ওই খালগুলো ভরাট হচ্ছে। ডিএনসিসি মাঝেমধ্যে সেসব পরিষ্কার করে পানির প্রবাহ ঠিক রাখার চেষ্টা করছে। বাকি ১১টি খাল মূলত নতুন এলাকায়। সেগুলো প্রবহমান রয়েছে।

এ বছর সে খালগুলোর সংস্কার বা উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করছে না ডিএনসিসি। মেগাপ্রকল্পের আওতায় ওই এলাকার খালসহ অন্যান্য অবকাঠামো উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে বলে জানা গেছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, মোহাম্মদপুর, আদাবর এলাকা দিয়ে প্রবাহিত রামচন্দ্রপুর খাল পরিষ্কারের পর আবারো আবর্জনায়পূর্ণ হচ্ছে। যদিও কিছু দিন পরপর এসব আবর্জনা পরিষ্কার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী।

সংশ্লিষ্টরা জানান, মেট্রোরেলের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়া এলাকার পানি নিষ্কাশন লাইন এখনো সংস্কার করতে পারেনি ডিএনসিসি। নিজস্ব ফান্ডের টাকায় সেসব সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এ কারণে আসন্ন বর্ষায় ওই এলাকায় জলাবদ্ধতার শঙ্কা রয়েছেন স্বয়ং ডিএনসিসির প্রকৌশলীরা।

এ ছাড়া রাজাবাজার, গ্রিন রোড এলাকাসহ মহানগরীর বেশ কিছু এলাকার ড্রেন, নর্দমা ও পানি নিষ্কাশন চ্যানেলগুলো আসন্ন বর্ষার আগে সমাধান করতে পারছে না ডিএনসিসি এ কারণে ওই এলাকায়ও জলাবদ্ধতা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, দায়িত্ব পাওয়ার পর আমরা খাল ও ড্রেনগুলো পরিষ্কার, দখলমুক্ত ও সংযোগ তৈরি করে টেকসই প্রবাহ নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছি। এটা বছরজুড়ে চলমান থাকবে। এসব কার্যক্রমের ফলে আমরা অনেকটা আশাবাদী হয়েছি যে, এবারের বর্ষায় জলাবদ্ধতা অনেকাংশে কম হবে। সীমানা নির্ধারণসহ অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করতে একটি প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে। এসব কার্যক্রমের দায়িত্ব আমরা সেনাবাহিনীর হাতে দেব বলে চিন্তা করছি।

https://www.jugantor.com/todays-paper/last-page/425448/