২৯ মে ২০২১, শনিবার, ৩:০৯

কেন পান করি এসব পানীয়?

১৯০ বছর আগের কথা। ১৮৩১ সালের ৮ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়ায় জন্মেছিলেন জন পেম্বারটন। পড়াশোনায় ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো ছিলেন তিনি। জন পেম্বারটন রিফর্ম মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন ফার্মেসি নিয়ে পড়তে। ১৮৫০ সালে ফার্মাসিস্টের ডিগ্রি ও লাইসেন্স পেয়ে গেলেন তিনি। তাঁর লক্ষ্য ছিল বিভিন্ন ওষুধ আবিষ্কার ও বিক্রি করা।

সেলক্ষ্যে সফলভাবে এগিয়েও চলছিলেন জন পেম্বারটন। কিন্তু দাসপ্রথা নিয়ে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল আমেরিকায়। গৃহযুদ্ধে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলো। আমেরিকার গৃহযুদ্ধে জন পেম্বারটন লড়াই করেন জর্জিয়ার স্টেট গার্ডের পক্ষে। ‘ব্যাটল অব কলম্বাস’ এর যুদ্ধে তিনি মারাত্মকভাবে আহত হন। ক্ষতের যন্ত্রণা কমাতে জন পেম্বারটন মরফিন নেয়া শুরু করলেন। রোজ তিন চারবার মরফিন নিতে নিতে তিনি এর নেশায় চূড়ান্তভাবে আসক্ত হয়ে পড়লেন।
মরফিন যথেষ্ট দামি নেশা ছিল তখন। এখনও এটি খুব দামি। কুলোতে না পেরে নেশার কবল থেকে নিজেকে সরিয়ে আনতে জন পেম্বারটন সহজলভ্য কোকাপাতা চিবোতে শুরু করলেন। উল্লেখ্য, এ কোকাগাছ থেকেই তৈরি হয় আরেক ভয়ঙ্কর ড্রাগ কোকেন। কোকাপাতা চিবোলে নেশা হয়। তবে কোকাপাতা স্বাদে যথেষ্ট তেতো। এ পাতা সেবন সামান্য উপাদেয় করবার জন্য জন পেম্বারটন নিজের ল্যাবরেটরিতে এর নির্যাসের সঙ্গে বিভিন্ন উপাদান মেশাতে লাগলেন নেশার তাগিদেই। অনেক নেশাখোর যা করেন আর কী!

একদিন এভাবেই পেম্বারটন কোকাপাতার নির্যাসের সঙ্গে মেশালেন কোলাবাদামের গুঁড়ো। দিনশেষে বাড়ির বারান্দায় বসে সিরাপটির স্বাদ নিলেন তিনি। প্রথম চুমুকেই বুঝে গেলেন এ তরল পদার্থটি পৃথিবী কাঁপাবে।

ব্রেন টনিক হিসেবে বাজারে এসেছিল কোকাকোলা। একদিন সন্ধ্যায় হুইস্কিতে সোডাওয়াটার মেশাতে গিয়ে নিজের খেয়ালেই কোকা আর কোলাবাদামের মিশ্রণটিতে সোডাওয়াটার মিশিয়ে চুমুক দিলেন। এবার নিজেই চমকে গেলেন পেম্বারটন। বুঝতে পারলেন সোনারখনি আবিষ্কার করে ফেলেছেন তিনি। জন পেম্বারটন পরের দিনই তাঁর বন্ধু উইলিস ভেনাবলের সঙ্গে দেখা করলেন। উইলিস একটি ওষুধের দোকানের মালিক। উইলিসকে সোডাওয়াটার সহযোগে কোকা আর কোলাবাদােমর মিশ্রণের স্বাদ নিতে বললেন জন পেম্বারটন। স্বাদ নিয়ে বন্ধু উইলিস আনন্দে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠেছিলেন।

দুজনে মিলে কোকা আর কোলাবাদামের মিশ্রণকে ব্রেন-টনিক জাতীয় ওষুধ হিসেবে বাজারে আনলেন। কারণ এটা খেলে বেশ ফুরফুরে লাগে ও মানসিক অবসাদ দূর হয়। সেসময় মিশ্রণটির এক গ্লাসের দাম ছিল মাত্র ৫ সেন্ট। কিন্তু ব্রেন টনিক হিসেবে নয়, বরং সোডা ফাউন্টেন ড্রিঙ্ক হিসেবেই বাজারে হিট হয়ে গেল পেম্বারটনের আবিষ্কৃত মিশ্রণটি। কিন্তু প্রিয় বন্ধুকেও ফর্মুলা জানালেন না পেম্বারটন। রহস্যময় থেকে গেল আজও এ জনপ্রিয় পানীয়ের ফর্মুলা।
কোকা আর কোলাবাদামের সোডা ফাউন্টেন ড্রিঙ্কটি বাজারে হিট হতেই ব্র্যান্ড নেইম এর দরকার পড়লো। বিজ্ঞাপন কোম্পানির মালিক ফ্র্যাঙ্ক ম্যাসন রবিনসন এ সোডা ফাউন্টেন ড্রিঙ্কটির নাম প্রধান দুটি উপাদানের নামে রাখলেন। এসে গেল পৃথিবী কাঁপানো ব্র্যান্ড ‘কোকাকোলা’। পেম্বাটন তৈরি করে ফেললেন দ্য কোকাকোলা কোম্পানি।

মরফিন ছাড়বার উদ্দেশে জন পেম্বারটন কোকাকোলা আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু আবিষ্কারের পরও মরফিনের নেশা ছাড়তে পারেননি তিনি। সেই নেশায় প্রায় দেউলিয়া হতে বসেন জন পেম্বারটন। একপর্যায়ে সংসার চালাতে এবং নেশার টাকা যোগাতে তিনি কোকাকোলার ফর্মুলা বেচতে বাধ্য হলেন। বেচে দিলেন কোম্পানির কিছু শেয়ারও।

তবে কোকাকোলা কোম্পানির সিংহভাগ শেয়ার নিজের হাতে রাখলেন জন পেম্বারটন। যাতে তাঁর ছেলে চার্লি পেম্বারটন ভবিষ্যতে ব্যবসা করতে পারেন। কোকাকোলার ফর্মুলা বেচলেও তাঁর নিজস্ব ফর্মুলার পুরোটা নাকি কাউকেই জানাননি জন পেম্বাটন। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন এ কোকাকোলা ভবিষ্যতে একদিন আমেরিকার জাতীয় পানীয় হবে এবং গোটা দুনিয়া মাতিয়ে তুলবে।

জন পেম্বারটনের ফর্মুলা নিয়ে অন্য সফটড্রিঙ্কস কোম্পানিগুলো বিভিন্ন ব্র্যান্ড এনে রমরমা ব্যবসা শুরু করলো। কিন্তু জন ও তাঁর ছেলে চার্লি তাঁদের ব্যবসা তেমন জমাতে পারলেন না। অথচ জন পেম্বাটনের ছেলে চার্লি পেম্বাটনের কাছে কোকাকোলা নামটার কপিরাইট ছিল। কিন্তু চার্লি পেম্বারটন ছিলেন অলস প্রকৃতির। ব্যবসা বাড়ানোর চেষ্টা বা ইচ্ছে কোনওটাই ছিল না তাঁর।

‘ফর গড: কান্ট্রি এন্ড কোকাকোলা’ বইয়ের লেখক মার্ক পেন্ডারগ্রাস্ট লেখেছিলেন, জন পেম্বারটনের ছেলে চার্লিরও বাবার মতো মরফিনের নেশা ছিল। বাবাকে বুঝিয়ে দ্রুত বেশি টাকা রোজগারের জন্য ১৮৮৮ সালে চার্লি তাঁদের কোকাকোলা কোম্পানিকে বেচে দিলেন ধনকুবের এসা ক্যান্ডলারের কাছে।
একই বছর আগস্টে জন পেম্বাটন মারা গেলেন পাকস্থলির ক্যান্সারে। মৃত্যুর সময় তিনি নাকি কপর্দকহীন অবস্থায় ছিলেন এবং মরফিনের নেশা ছাড়তে পারেননি। ভোগবিলাস আর নেশায় সর্বস্বান্ত হয়ে জন পেম্বারটন মারা যাবার মাত্র ছয় বছরের মধ্যে মারা যান চার্লি পেম্বারটনও। অথচ ধনকুবের হবার সোনার খনিটি তাঁদের হাতেই ছিল।

ইতোমধ্যে এসা ক্যান্ডলারের ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে ‘কোকাকোলা কোম্পানি’ হয়ে গেছে ‘কোকাকোলা কর্পোরেশন’। অল্পদিনের মধ্যেই এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সফটড্রিঙ্ক বিক্রেতা ও নির্মাতা কোম্পানি হয়ে উঠলো। জন পেম্বারটনের স্বপ্নই সত্যি সফল হলো।

যদি জন পেম্বারটন আমেরিকার গৃহযুদ্ধে না লড়তেন তাহলে তিনি আহত হতেন না। আহত না হলে যন্ত্রণা পেতেন না। যন্ত্রণা না পেলে মরফিন নিতেন না। মরফিনে আসক্ত না হলে কোকাপাতাও চিবোতে যেতেন না। কোকাপাতা না চিবােলে মানুষ কোকাকোলা পেতো না। তাই এসা ক্যান্ডলারের হাতে কোকাকোলা দ্বিতীয় জীবন ফিরে পেলেও এ পানীয়টির জনক হিসেবে অমর হয়ে থাকবেন জন পেম্বারটন।

কিছুটা হলেও বোঝা গেল কোকাকোলা আসলে কী? এ হলো দুনিয়া মাতানো এক বিনাশী নেশা। আড্ডা, অতিথি আপ্যায়ন, জন্মদিন কোথায় নেই এ পানীয়?
এ কোকাকোলা প্রতিদিন বারবার গেলে পৃথিবীর শত কোটি মানুষ।

সফটড্রিঙ্ক হিসেবে পানীয়টি গলাধঃকরণ করলেও এটি আসলে মারাত্মক নেশা। আসক্তি সৃষ্টি করে। আর আসক্তরা ভুলতে পারে না। তাই বারবার খেতে ইচ্ছে করে মরফিনের মতোই। না খেলে শরীর ঝিমঝিম করে। মাথা ঘোরায়। কাজকর্মে মনোযোগ থাকে না। আসলে এটি সফটড্রিঙ্ক নয়। বলা যায় স্লোপয়জন। সফটড্রিঙ্কের নামে মানুষ এ স্লোপয়জনই পান করছে আয়েস করে। ক্রমাগত এগোচ্ছে মৃত্যুর হিমশীতল অন্ধ গলিপথে। কিন্তু হুঁশ হচ্ছে না কারুরই। কী কী উপাদান আছে এতে তার কোনও স্পষ্ট ধারণা নেই গ্রহণকারীদের। উচ্চমূল্য দিয়ে কিনছে। পান করছে। কিন্তু আসলে কী পান করছে জানে না আজও। জানতে চায়ও না কেউ। কোকাকোলা ও অন্যসব সফটড্রিঙ্ক পানে মানুষের আয়ু কমে যাচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখবার সময় ঘনিয়েছে বলেই মনে হয়। কারণ কোকাকোলা আর কোকেনের উৎপত্তি একই উপাদান থেকে। কোকেন হলো ভয়াবহ মাদক। এর যথেচ্ছ ব্যবহার মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এছাড়া এতে অন্য কোনও মারাত্মক উপাদান রয়েছে কিনা কে জানে?

নেটে একবার একটা সচিত্র নিউজ ভাইরাল হয়েছিল। আর সেটা হচ্ছে কাঠবেড়ালি কোকোফল খেয়ে এর আস্তবিচিগুলো ‘হাগু’ করে। কাঠবেড়ালির এ মল থেকেই নাকি সবচেয়ে দামি কফি পাউডার প্রস্তুত হয়। প্রশ্ন হলো: দামি কফি হলে কোকোকোলা হতে বাধা কোথায়? ফারাক কেবল একটা গরম। অন্যটা শীতল। তবে মেকিং ফর্মুলা এক নয় নিশ্চয়ই।

বলাবাহুল্য, কোলাকোলাসহ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোমলপানীয় বা সফটড্রিঙ্ক আমরা প্রতিদিন পান করি। কিন্তু কেন পান করি, না পান করলে কী হয় তা কেউ ভাবি না। এসব পানে আমাদের দেহ-মনের কি কোনও উপকার হয়, না বারোটা বাজে তাও খতিয়ে দেখি না।

https://dailysangram.com/post/453784