ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে জোয়ারে বসতঘর ভেসে গেছে এমন অন্তত ২৫টি পরিবার ঠাঁই নিয়েছে বেড়িবাঁধে। রাঙ্গাবালী উপজেলার নয়ার চর এলাকা থেকে গতকালের তোলা। সৌজন্য : আল মামুন
২৮ মে ২০২১, শুক্রবার, ২:৫৮

‘দুগ্যা খাওন দেন বড় কষ্টে আছি’

চর মোন্তাজের নয়ার চর এলাকার বাসিন্দা খাদিজা বেগম। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে জোয়ারে গত মঙ্গলবার তাঁর বসতঘর ভেসে গেছে। ভূমিহীন খাদিজা প্রকৃতির কাছে আত্মসমর্পণ করে আশ্রয় নিয়েছেন পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার নয়ার চর বেড়িবাঁধের ওপর। তিন দিন ধরে ওখানেই ছয় ফুট বাই আট ফুট পরিধির পলিথিনের তাঁবু বানিয়ে স্বামী-সন্তানদের নিয়ে আশ্রয় গড়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টার দিকে খাদিজার সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, তাঁর পাঁচ সদস্যের পরিবার একমুঠো চালও পায়নি। নেই অন্য কোনো খাবারও। দুই কেজি চাল ধার করে তিন দিন চলেছেন। লবণ-ভাত আর মরিচ-ভাতই তাঁদের ক্ষুধা মেটানোর একমাত্র উপায়। চাল না থাকায় অনাহারে-অর্ধাহারে দিন পার করছেন তাঁরা। খাদিজার স্বামী কাসেম বয়াতি পেশায় জেলে। নদী ও সাগর উত্তাল থাকায় তিনি মাছ শিকার করে আয় করতে পারছেন না।

খাদিজা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাঁচ জোনের সংসার। ঘরডা পানিতে ভাসাইয়া নেছে। বান্দের (বাঁধ) ওপরে আইয়া উডছি। পলিথিন দিয়া আকাশ ডাকছি। বৃষ্টি আইলে পানি পড়ে। ঘরে খাওন নাই। পারলে দুগ্যা (অল্প কিছু) খাওন দেন, আমরা বড় কষ্টে আছি। কেউ দুগ্যা চিড়া-মুড়িও দেলে না।’

শুধু খাদিজার পরিবারই এমন বিপর্যয়ে পড়েনি, ওই বাঁধের ওপর আশ্রয় নেওয়া অন্তত ২৫টি পরিবারেরও একই অবস্থা। লবণ-ভাত, মরিচ-ভাতের পাশাপাশি বাঁধে আশ্রয় নেওয়া পরিবারের কেউ আবার শ্বাসমূলীয় কচুশাক সংগ্রহ করে রান্না করে খাচ্ছে। বাঁধে আশ্রয় নেওয়া আব্বাস হোসেন বলেন, ‘আমরা কত কষ্টে আছি, দ্যাহেন। ঘরে ভাত নাই, পরনে কাপুড় নাই, থাহনের ঘর নাই, মাতার ওপরের পলিথিন জোরে বাতাস আইলে উড়াইয়া লইয়া যাইবে। ছোড এই পলিথিনের ছাইনির তলে পাঁচ-ছয়জন মানুষ ক্যামনে রাইতে থাহে, কন?’

পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার নয়ার চরের বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেওয়া মানুষের থাকা-খাওয়া নিয়ে এমনই আহাজারি। ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসে ওই বাঁধের ওপর তারা আশ্রয় নিয়েছে। ফোরকান রাঢ়ি নামের একজনকে দেখা গেছে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একই ধরনের একটি আশ্রয়স্থল বানাতে। বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নেওয়া মো. নয়ন বলেন, ‘ব্যামালা কষ্টে আছি। খাওন নাই। কাম নাই।’

জেলে নৌকায় কাজ করে কোনো রকমে সংসার চালান অহিদুল। মাস শেষে ১২ হাজার টাকা মজুরি পেয়ে তা দিয়েই মিটে যায় সংসারের খরচ। জায়গা-জমি বলতে অতিরিক্ত কিছুই নেই তাঁর। তিন ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী আর বৃদ্ধা মাকে নিয়ে ছয় সদস্যের পরিবারের কর্তা তিনি। ওয়াপদা বেড়িবাঁধের বাইরে একটি ছোট ঘর ছিল, সেখানেই থাকতেন তাঁরা। অস্বাভাবিক জোয়ারে শেষ সম্বল ঘরখানাও ভাসিয়ে নিয়ে গেল। ফলে মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয়টুকু হারিয়ে এখন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধের ওপর কাগজের ছাপরা দিয়েই সংসার পেতেছেন তাঁরা। গতকাল চর মোন্তাজ ইউনিয়নের দক্ষিণ চর মোন্তাজ এলাকায় গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।

অহিদুল মিয়ার স্ত্রী রিনা বেগম বলেন, ‘এ্যাহন (এখন) আমাগো আর কী দেখতো আইছেন ছার (স্যার), পোলাপাইন লইয়া কেমনে থাকমু, হেই চিন্তার আগে ভাবতে হয় খামু কী! জোয়ারের পানিতে ঘরের চাউল দুগ্যাও ভাসাই লইয়া গ্যাছে। নিজেগো একটু জায়গাও নাই যে ঘর কইরা ভেরির মইধ্যে থাকমু। এমনকি লাকরি আর রানধুইন্না চুলাডাও নাই।’

অহিদুল মিয়ার ছাপরার পূর্ব পাশেই আরেক বসতি কাওসার মোল্লার। পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে তিনিও বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। একটু পশ্চিম পাশে রাসেল মোল্লা নামের আরেকজনের বসতি। পেশায় মোটরসাইকেলচালক সব হারিয়ে ওয়াপদা রাস্তায় থাকছেন। এভাবেই অনেক পরিবার পলিথিনের ছাউনিতে কোনো রকম দিন যাপন করছে।

ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবু হানিফ মিয়া বলেন, ‘প্রথম দিন নয়ার চর ও চরবেষ্টিত বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকেছে ওই দুই গ্রামে। দ্বিতীয় দিনেও পানি ঢুকেছে। আর আণ্ডার চরের ভাঙা বাঁধ সংস্কার না করায় সেই চরেও দুই দিন পানি ঢুকে প্লাবিত হয়। দক্ষিণ চর মোন্তাজে কয়েকটি পরিবার বেড়িবাঁধে আশ্রয় নিয়েছে শুনছি। পরিদর্শন করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

এদিকে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, দুই দিনের জোয়ারে রাঙ্গাবালী, ছোট বাইশদিয়া, চালিতাবুনিয়া, চর মোন্তাজ, বড় বাইশদিয়া ও মৌডুবি ইউনিয়নে দুই হাজার ৩৪০টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে পুরোপুরি ক্ষতি হয়েছে ১১০টির। জোয়ারের তোড়ে পাঁচ হাজার ৫১০ মিটার বন্যা নিয়ন্ত্রণ বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে চালিতাবুনিয়া, চর মোন্তাজ ও ছোট বাইশদিয়া ইউনিয়নে।

রাঙ্গাবালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাশফাকুর রহমান বলেন, ‘দ্বিতীয় দিনের জোয়ারে ১৫টি গ্রামের বেশি প্লাবিত হয়। এতে ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে যারা দুপুরে রান্নাবান্না করতে পারেনি, তাদের জন্য চেয়ারম্যানদের মাধ্যমে শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রত্যেক ইউনিয়নে দুর্গত মানুষকে সহায়তার জন্য ২৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ পেয়েছি শুকনা খাবার ত্রাণ হিসেবে দেওয়ার জন্য। সব ইউনিয়নে ওই টাকার বিনিময়ে খাবার বিতরণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে চেয়ারম্যানদের।’

বেড়িবাঁধ সংস্কার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভাঙা বেড়িবাঁধ সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। পাশাপাশি জোয়ারের পানিতে বিধ্বস্ত হওয়া ঘরগুলোর পরিবারের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এদিকে জোয়ারের তীব্রতা গতকালও কমেনি বরং বেড়েছে। ফলে জেলার প্রায় ২৫০ গ্রামে দেখা দিয়েছে মানবিক বিপর্যয়। ঘরবাড়ি, মাছের খামার, গবাদি পশুসহ বিভিন্ন জিনিস নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে ওই সব এলাকার মানুষ বাসস্থান কিংবা থাকা-খাওয়া নিয়ে চরম বিপর্যয়ে পড়েছে। অথচ গতকাল পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত ওই সব এলাকায় কোনো খাদ্য সহায়তা পৌঁছায়নি।

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, দুর্গত সব এলাকায় ত্রাণ পাঠানো হয়েছে এবং ত্রাণ দেওয়ার কার্যক্রম চলছে। চর মোন্তাজে সবার আগে পানি উঠে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ওখানে ত্রাণ আগেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কোনো মানুষ সরকারের ত্রাণ সহায়তা থেকে বঞ্চিত হবে না।

https://www.kalerkantho.com/print-edition/last-page/2021/05/28/1037401