২৮ মে ২০২১, শুক্রবার, ২:৫৪

উপকূলজুড়ে কয়েকশ কিলোমিটারে ধস

টেকসই বেড়িবাঁধের আকুতি

ইয়াসের প্রভাবে উপকূলজুড়ে ব্যাপক ক্ষতি

ঘূর্ণিঝড় ইয়াস বাংলাদেশে আঘাত না হানলেও এর প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলোতে ভৌত অবকাঠামো, ঘরবাড়ি ও কৃষির ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাসে কয়েকশ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।

শত শত গ্রাম প্লাবিত হওয়ার পাশাপাশি কয়েক হাজার ঘের ও পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। নষ্ট হয়েছে ফসলি জমি। সুন্দরবনের অনেক স্থাপনা, গাছ ও প্রাণীর ক্ষতি হয়েছে। এক খুলনায়ই ৭৫ কিমি. বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, সাতক্ষীরা, বাগেরহট, লক্ষ্মীপুরসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় বাঁধ ভেঙে গেছে। উপকূলীয় ১৪ জেলায় অন্তত কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তাদের অনেকেই অনাহার ও অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছেন। তবে ইয়াসের প্রভাবে জেলাগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির মোট পরিমাণ এখনো জানা যায়নি। দায়িত্বপ্রাপ্তরা ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের চেষ্টা করছেন।

এবারের এ দুর্যোগের সময় উপকূলবাসীর মধ্যে একটিই দাবি লক্ষ্য করা গেছে, তা হলো টেকসই বেড়িবাঁধ। তাদের মতে, দুর্বল বাঁধের কারণেই এবার এত ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থা থেকে উদ্ধারে শক্ত, মজবুত বাঁধের বিকল্প নেই। দ্রুত বাঁধ নির্মাণের জন্য তারা সরকারের কাছে জোর দাবি জানিয়েছেন।

পাইকগাছায় এক কিশোরের বুকে লেখা ‘ত্রাণ নয়, টেকসই বাঁধ চাই’- নিবেদন অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বৃহস্পতিবারও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হয়েছে। ফলে মানুষের দুর্ভোগ কমছে না। যুগান্তরের ব্যুরো, স্টাফ রিপোর্টার ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

খুলনা : খুলনায় ৭৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ৩০টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ভেসে গেছে পুকুর ও ঘেরের মাছসহ ক্ষেতের ফসল। ২৪০টি ঘর সম্পূর্ণ নষ্ট ও ২ হাজার ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে পাওয়া তথ্যমতে, সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়রা উপজেলা। এ উপজেলার দশহালিয়া, পবনা, মঠবাড়িয়া, গাতির ঘেরি, মেদেরচর, গাতিরঘেরি, পদ্মপুকুর এলাকার বাঁধ ভেঙে পানি লোকালয়ে ঢুকেছে।

মঙ্গলবার ও বুধবার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা, পবনাসহ বেশ কয়েকটি জায়গায় প্রশাসনের সহযোগিতায় বাঁধ মেরামত করা হলেও বৃহস্পতিবারের জোয়ারে আবার তা ভেঙে যায়। আর দাকোপ উপজেলার বানিশাস্তা এলাকা, ঝালবুনিয়া, কামিনীবাসিয়া ও পাইকগাছার সোলাদানা ও লতা ইউনিয়নের ২শ’ মিটার বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে।

কয়রা উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের সবকটি কমবেশি ক্ষতি হয়েছে। অনেক এলাকায় ঘর ভেঙে পড়েছে। সব মিলিয়ে ৭ হাজার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

কয়রা উপজেলা মৎস্য অফিসার এসএম আলউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই উপজেলায় ২১শ’ মৎস্য ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ ছাড়া অসংখ্য পুকুর ডুবে মাছ বের হয়ে গেছে। উপজেলার মৎস্য খাতে প্রায় ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। পাউবোর বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

পাইকগাছায় ২৭ কিলোমিটার ওয়াপদার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেখানে কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে এক কিশোরের বুকে লেখা ‘ত্রাণ নয়, টেকসই বাঁধ চাই’- নিবেদন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা পবিত্র কুমার দাস জানান, এখানে ৬৬০ হেক্টর চিংড়ি ঘের প্লাবিত হয়ে ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার চিংড়ি ও মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এবিএম খালিদ হোসেন সিদ্দিকী জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। তাদের পুনর্বাসনের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

বাগেরহাট ও শরণখোলা : ঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সুন্দরবনের ১৯টি জেটি, ১০টি অফিস, ৪টি জলোযানসহ বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পূর্বসুন্দরবন বিভিন্ন এলাকা থেকে ৪টি মৃত ও ১টি জীবিত হরিণ উদ্ধারের কথা নিশ্চিত করেছে পূর্ববনবিভাগ।

সুন্দরবনের কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণে বনবিভাগ ৪টি পৃথক কমিটি গঠন করেছে। বাগেরহাট, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার অন্তর্গত বন বিভাগের ৪টি রেঞ্জ এলাকা রয়েছে। যার দুটি বাগেরহাটে অবস্থিত। ইতোমধ্যে সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের অন্তর্গত শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কাজ শুরু হয়েছে। সুন্দরবনের খুলনা জেলার নলিয়ান ও সাতক্ষীরা জেলার বুড়িগোয়ালিনী রেঞ্জেও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

পূর্ব সুন্দরবনের চারটি হরিণের মৃত্যু ও বন বিভাগের অবকাঠামোর ব্যপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া জোয়ারে ভেসে লোকালয়ে চলে আসা দুটি জীবিত হরিণ বৃহস্পতিবার সকালে উদ্ধার করে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়েছে।

শরণখোলা রেঞ্জ কর্মকর্তা (এসিএফ) জয়নাল আবেদীন জানান, জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বনের চারটি চিত্রল হরিণের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে বুধবার দুপুরে দুবলা থেকে একটি, কচিখালী থেকে একটি, শরণখোলা উপজেলা সদরের বলেশ্বর নদীর রাজেস্বর এলাকা থেকে একটি ও বৃহস্পতিবার সকালে চাল রায়েন্দা এলাকা থেকে একটি মৃত হরিণ উদ্ধার করা হয়। এগুলো সুন্দরবনে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পানির স্রাতে ভেসে পার্শ্ববর্তী মঠবাড়িয়া উপজেলার বেতমোড় ও গোলবুনিয়ার লোকালয়ে চলে যাওয়া দুটি জীবিত হরিণ উদ্ধার করে সুন্দরবনে অবমুক্ত করা হয়েছে। তবে বনের মধ্যে আর কোনো বণ্যপ্রাণীর মৃত্যু হয়েছে কিনা জানা যায়নি।

ঝড়ে বন বিভাগের দুটি রেস্ট হাউস, দুটি অফিস, একটি ব্যরাক, একটি ফুট ট্রেইল, ১০টি জেটি, ১৫টি রাস্তা, চারটি পুকুর, একটি জলযান ও গাছপালার ক্ষতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরের জোয়ারে প্লাবিত হয় মোংলাসহ সুন্দরবন উপকূলের নিম্নাঞ্চল। কানাইনগর, চিলা, কেয়াবুনিয়া, সুন্দরতলা কাইনমারীসহ আশপাশ এলাকার অন্তত ৮শ’ পরিবার নোনা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের শুকনো খাদ্যসামগ্রী বিতরণের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছেন স্থানীয়রা। এ ছাড়া ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিভিন্ন এনজিও খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। মোংলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কমলেশ মজুমদার জানান, জলোচ্ছ্বাসে ৬৮৫টি চিংড়ি ঘের তলিয়ে গেছে।

সাতক্ষীরা : জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে সাতক্ষীরার অনেক জনপদ ও অবকাঠামো। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে নোনা পানি ঢুকেছে। তলিয়ে গেছে শত শত মাছের ঘের। পানির তোড়ে জেলার কয়েকটি স­–ইসগেট ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী সাতক্ষীরাসহ খুলনা অঞ্চলে ১২০ কিলোমিটার বাঁধ লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।

জেলা প্রশাসক এসএম মোস্তফা কামাল বলেন, ক্ষয়ক্ষতি এখনো পুরোপুরি নিরূপণ করা যায়নি। বাঁধ ভেঙেছে এবং মাছের ঘেরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ ও দেবহাটা উপজেলার ২৭টি ইউনিয়নের ৭৫৬০টি মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

আশাশুনি উপজেলায় ১ হাজার ৪শ’ হেক্টর জমির মাছের ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেবহাটা উপজেলায় ২০০ ঘের পানিতে তলিয়ে আছে। শ্যামনগর উপজেলায় ২৫শ’ ঘের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ভোলা, চরফ্যাশন : ভোলায় বৃহস্পতিবারও দিনব্যাপী ঝড়োহাওয়া ও ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি অব্যাহত ছিল। বোরহানউদ্দিন ও মনপুরায় ধসে যাওয়া বাঁধ দিয়ে পানি প্রবেশ অব্যাহত রয়েছে। ঝড়ে তিন দিনে প্লাবিত গ্রামের সংখ্যা ৩০টি। কাচিয়া চরের এগারোশ’ একর জমির সবজি চাষ বিনষ্ট হয়েছে। জেলায় বিধ্বস্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা ৩৭৫টি। ভেসে যাওয়া গরু-মহিষের সংখ্যা এক হাজার ৬০টি । এসব তথ্য ইউপি চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে। জেলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়ন, কাচিয়া মাঝেরচর চরফ্যাশনের চরপাতিলা, ঢালচর, আহমদপুর, বোরহানউদ্দিনের মির্জাকালু, মনপুরার ঈশ্বরগঞ্জসহ বিভিন্ন চরাঞ্চলে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। লালমোহন উপজেলা নির্বাহী অফিসার আল নোমান জানান, গাছ পড়ে নিহত পরিবারকে ২০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। জেলার সদর উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নের ৬টি ওয়ার্ডের ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। এছাড়া কুকরীর ইকোপার্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মনপুরার চর নিজামের কেওড়া বাগান থেকে দুটি হরিণ লোকালয়ে চলে আসে। হরিণ দুটি বন বিভাগের কর্মীরা উদ্ধার করেছে।

চরফ্যাশন উপজেলার আহম্মেদপুর ইউনিয়নে ৫টি ওয়ার্ডের মানুষ পানিবন্দি বলে জানান ইউপি চেয়ারম্যান সফিউল্লাহ। মনপুরায় ঈশ্বরগঞ্জ এলাকায় বাঁধের ৫০ মিটার ধসে গেছে। জেলা প্রশাসক তৌফিক ইলাহী চৌধুরী জানান, ঝড়ে কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপণ করতে উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা মাঠে কাজ করছেন। প্রাথমিকভাবে গাছ পড়ে একজন নিহত হয়েছেন। পানিবন্দিদের জন্য শুকনো খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

পিরোজপুর, নাজিরপুর, কাউখালী : সুন্দরবন থেকে পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ায় ভেসে আসা দুটি হরিণ বন বিভাগের কাছে বৃহস্পতিবার সকালে হস্তান্তর করে এলাকাবাসী। উলুবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা নজরুল ইসলাম বেপারী জানান, ভোরে স্থানীয়রা চিত্রা হরিণ দুটি আটক করে।

নাজিরপুরে শতাধিক কাঁচা ঘর ও ১০ কি.মি পাকা-কাঁচা রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা গৌতম মন্ডল জানান, ৮৫০টি মাছের ঘেরে প্লাবিত হয়েছে। এসব ঘেরের সঙ্গে ১ হাজার ১৫০টি পরিবার সম্পৃক্ত। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা দ্বিগবিজয় হাজরা জানান, তার উপজেলার ৯৫০ হেক্টর ফসলি জমি নষ্ট হয়েছে।

কাউখালীর ১০-১৫টি গ্রাম পানিতে ডুবে আছে। এসব গ্রামের মানুষ অর্ধহারে-অনাহারে রয়েছে।

বরগুনা বামনা, আমতলী : বাঁধ ভেঙে বরগুনার দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। জেলার বামনা উপজেলায় বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা চেচাঁন, বেবাজিয়াখালী, কালিকাবাড়ি, পুরাতন বামনা বাজার, কলাগাছিয়া, পূর্ব সফিপুর, রুহিতা, অযোধ্যা, খোলপটুয়া, রামনা, উত্তর কাকচিড়া, চলাভাঙ্গা ও দক্ষিণ কাকচিড়া, ছোনবুনিয়া, লক্ষ্মীপুড়া গ্রাম তলিয়ে গেছে। বেড়িবাঁধ ভেঙে উপজেলার চেচাঁন, পুরাতন বামনা, বামনা লঞ্চঘাট, খোলপটুয়া বাজার, রামনা, চলাভাঙ্গা ও জাফ্রাখালী আশ্রয়ণ প্রকল্প এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তলিয়ে গেছে ফসলি জমি ও মাছের ঘেরসহ অনেক জলাশয়।

জলোচ্ছ্বাসে আমতলী উপজেলার নিম্নাঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলার ২৪০টি মাছের ঘের তলিয়ে গেছে। এছাড়া উপজেলার সাতটি ইউনিয়নের চারশ পানের বরজ লবণ পানিতে তলিয়ে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে অন্তত অর্থ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর : লক্ষ্মীপুরের রায়পুরের উপকূলে দক্ষিণ চরবংশি, উত্তর চরবংশী, দক্ষিণ চরআবাবিল ইউনিয়নে মেঘনা নদীদে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। অনেক কাঁচা-পাকা রাস্তা ভেঙে গেছে।

নোয়াখালী : নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় জোয়ারের পানিতে ভেসে যাওয়ার শিশু লিমা আক্তারের (৭) সন্ধান ১৪ ঘণ্টায় পাওয়া যায়নি। লিমা উপজেলার সুখচর ইউনিয়নের চর আমান উল্যাহ গ্রামের জগলুলের মেয়ে। বুধবার সন্ধ্যায় উপজেলার জোয়ারের পানিতে ঘর থেকে ভেসে যায় শিশুটি। জোয়ারের পানিতে হাতিয়ার নিম্নাঞ্চলের ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

পটুয়াখালী, রাঙ্গাবালি, মির্জাগঞ্জ, কলাপাড়া : পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে বসত ঘরবাড়ি, বেড়িবাঁধ, পুকুর ও ঘেরের মাছ ভেসে গেছে। বুধ ও বৃহস্পতিবার জোয়ারে এ ক্ষতি হয়। প্রশাসনের তথ্যানুযায়ী, দুর্গত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩৬ হাজার ২০৮ জন।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ছোটবাইশদিয়া, চালিতাবুনিয়া, চরমোন্তাজ, বড়বাইশদিয়া ও মৌডুবি ইউনিয়নে ২ হাজার ৩৪০টি বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, উপজেলার ৮৫০টি পুকুর এবং ২০৮টি মাছের ঘের পানিতে তলিয়ে গেছে। এতে মৎস্য চাষিদের প্রায় ৪৭ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত এই এলাকায় কোনো ত্রাণ সহায়তা পৌঁছেনি। ক্ষতিগ্রস্তদের দাবি, ‘ত্রাণ নয়, তারা টেকসই বেড়িবাঁধ চান।’

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির বলেন, ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। প্রত্যেক ইউনিয়নে শুকনো খাবারের জন্য ২৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

মির্জাগঞ্জে ক্ষতিগ্রস্ত সহস্রাধিক পরিবারের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেছে উপজেলা প্রশাসন।

কলাপাড়া উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পাঁচ শতাধিক বসতঘরে পানি প্রবেশ করেছে। কলাপাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এমএইচ সালেহী বলেন, বৃহস্পতিবার সকালেও আন্ধারমানিক, টিয়াখালী, খাপড়াভাঙ্গা ও রাবনাবাদ নদীর পানি বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। মৎস্যবন্দর আলীপুর, মহিপুরের শতাধিক মৎস্য আড়তসহ সরকারি বিভিন্ন অফিসে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে।

দুমকি উপজেলার লোহালিয়া নদীর চরে হোগলা পাতা আনতে গিয়ে জোয়ারের পানিতে ডুবে হাচিনা বেগম (৫৫) নামের এক বিধবার মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রাম : চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার ইয়ার্ডে ফের জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। বৃহস্পতিবার এনসিটি ও সিসিটি এলাকার কিছু অংশে পানি ওঠে বলে বন্দর ব্যবহারকারী একাধিক সূত্র জানিয়েছে। এতে বেশ কিছু কনটেইনার ডুবে যায়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বন্দরের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, বুধবার যেসব স্থানে পানি প্রবেশ করেছিল, বৃহস্পতিবারও সেসব স্থানে জোয়ারের পানি ওঠে।

বন্দর ইয়ার্ডে পানি প্রবেশ করা নিয়ে উদ্বিগ্ন ব্যবসায়ীরা। তারা দুর্যোগ মোকাবিলায় বন্দর কর্তৃপক্ষের পূর্ব প্রস্তুতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যথাযথ প্রস্তুতি থাকলে এ ধরনের পরিস্থিতি এড়ানো যেত বলেও জানান তারা।

বুধবার ভারতের উড়িষ্যা উপকূল দিয়ে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ও পূর্ণিমার জোয়ারের প্রভাবে চট্টগ্রাম নগরীর আগ্রাবাদ, হালিশহর, পতেঙ্গাসহ নিুাঞ্চলে খাল-নালা উপচে পানি প্রবেশ করে। রেহাই পায়নি বন্দরের কনটেইনার ইয়ার্ডও। বেশ কয়েক বছর ধরেই বর্ষায় নগরীর নিুাঞ্চল জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। এটা নিত্য ঘটনা হয়ে দাঁড়ালেও বন্দর ইয়ার্ডে পানি প্রবেশ করায় এ নিয়ে আমদানি রফতানিকারকদের মধ্যে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে।

চট্টগ্রাম চেম্বার ও পোর্ট ইউজার্স ফোরামের সভাপতি মাহবুবুল আলম যুগান্তরকে বলেন, বন্দরের ইয়ার্ডে পানি প্রবেশের ঘটনা বিরল। নিকট অতীতে এরকম ঘটনার কথা আমার জানা নেই। ঘূর্ণিঝড় হয়েছে উড়িষ্যায়, আর পানি উঠল চট্টগ্রাম বন্দরের ভেতরে। এ থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, কর্তৃপক্ষের পর্যাপ্ত পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। যদি ঘূর্ণিঝড়টি চট্টগ্রাম দিয়ে বয়ে যেত, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি কেমন হতো একবার চিন্তা করে দেখুন। বন্দরের যথাযথ প্রস্তুতি থাকলে হয়তো যেসব কনটেইনার পানিতে ডুবেছে, তা থেকে রেহাই পাওয়া যেত। তিনি বলেন, ক্ষতি কম হলো, না বেশি সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো-এভাবে যদি জোয়ার বা দুর্যোগে ইয়ার্ডে পানি প্রবেশ করতে থাকে, তাহলে তাতে বন্দর ও ব্যবসায়ীদের ক্ষতি হবে।

কক্সবাজার : উত্তাল ঢেউয়ে কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভের দৃষ্টিনন্দন সড়কটির তীর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়েছে পাহাড়ি ঝর্ণার আশপাশের বহুতল ভবনসহ হিমছড়ির চেঞ্জিং ভবনটি। ক্ষতির মুখে পড়ছে স্থানীয় বনবিট অফিসও। পাশাপাশি প্লাবিতও হয়েছে নিম্নাঞ্চল।

রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রণয় চাকমা বলেন, ‘খবর পেয়েছি কক্সবাজারের দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভের তীরে আছড়ে পড়ছে জোয়ারের পানি। হিমছড়ি এলাকায় কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। জোয়ারের পানি যেন সড়কটির কোথাও স্থায়ী ক্ষতি করতে না পারে সেদিকে নজর রাখা হচ্ছে।

মহেশখালীর কুতুবজোমের ঘটিভাঙ্গা খালে প্রবল জোয়ারের স্রোতে ভেসে যাওয়া এক কিশোরের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তার নাম মোহাম্মদ হাসান (১২) । বৃহস্পতিবার সকালে সোনাদিয়ার একটি খাল থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়।

মাদারীপুর : ঝড়ো হাওয়ার কারণে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে পদ্মা উত্তাল রয়েছে। তাই বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুটে নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পরবর্তী নির্দেশনা না পাওয়া পর্যন্ত নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে। যদিও বৃহস্পতিবার বাংলাবাজার ফেরিঘাটে কয়েক হাজার যাত্রীকে পদ্মা পারের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা গেছে।

শরীয়তপুর : ইয়াসের প্রভাবে পদ্মার পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এই নদীল ডান তীর রক্ষা বাঁধের তিন স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নড়িয়া উপজেলার মোক্তারের চর, পৌরসভার শুভগ্রাম ও চন্ডীপুর এলাকায় হঠাৎ করেই স্লোব থেকে মাটি সরে গিয়ে প্রায় ১শ ৩০ মিটার বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে বাঁধের আশপাশে থাকা রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/425122/