২৮ মে ২০২১, শুক্রবার, ২:৫৩

একাত্তরের ঝর্নাতলায়

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কতকিছু সামাল দিতে হয়!

রোজিনা ইস্যুতে উদ্ভূত বিভিন্ন প্রশ্নের সামাল দিতে হবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেই; কয়েকদিন আগে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন এমন একটি কথা বলেছেন।

 

ড. মোমেনের মতো এমন খোলাখুলিভাবে দারুণ সত্য একটি কথা আমাদের আর কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগে কখনো বলেছেন কিনা মনে করতে পারছি না।

আমাদের এ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিভিন্ন সরকারের আমলে কত রকমের বিচিত্র ও উদ্ভট সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে, তার কিছু বাস্তব উদাহরণ আজ তুলে ধরতে চাই। প্রথমেই মনে পড়ছে, ১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদের জাতীয় সংসদের নির্বাচনকে জায়েজ করার দায়িত্ব।

আমি তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রশাসন অনুবিভাগের মহাপরিচালক; ফখরুদ্দিন আহমেদ সাহেব পররাষ্ট্র সচিব; আর মাহবুবুজ্জমান সাহেব মন্ত্রিপরিষদ সচিব। নির্বাচনের পর যথারীতি ফল ঘোষিত হলো। এর কয়েকদিনের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব ফখরুদ্দিন সাহেব আমাকে তার অফিসে ডেকে বললেন, তোমার কাজ একটু বেড়ে গেল; একটু আগে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুবুজ্জামান টেলিফোন করে জানিয়েছেন, জেনারেল এরশাদ চান আমাদের দূতাবাসগুলো বিদেশে ‘Restoration of Democracy in Bangladesh’ উদযাপন করবে; তবে এজন্য কোনো অতিরিক্ত ফান্ড বরাদ্দ থাকবে না।

আমি ফখরুদ্দিন সাহেবকে বললাম, নো প্রবলেম, স্যার। প্রেসিডেন্ট এরশাদ যেমন চাইছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রবর্তন আমাদের দূতাবাসগুলোতে উদযাপিত হবে। আপনি তো স্যার আমাদের চেয়ে অনেক বেশি অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ; আইয়ুব খান জমানা থেকে এমন ঘটনা ঘটে আসছে বলে আপনার মতো সিনিয়রদের কাছ থেকে শুনে আসছি। ফখরুদ্দিন সাহেব একটু মুখ টিপে হেসে আমাকে বিদায় করলেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আমার অফিসে ফিরে বাংলাদেশে ‘রেস্টোরেশন অব ডেমোক্রেসি’ উদযাপনের নির্দেশ দিয়ে আমাদের সব দূতাবাসে বার্তা পাঠালাম। শ্রীলংকায় তখন আমাদের ডেপুটি হাইকমিশনার ছিলেন ব্যারিস্টার শামসুল মোর্শেদ (মরহুম)। কয়েকদিন পর ভিন্ন কারণে তাকে আমার টেলিফোন করতে হয়েছিল। ‘রেস্টোরেশন অব ডেমোক্রেসি ইন বাংলাদেশ’ কীভাবে উদযাপন করলেন তখন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম।

তিনিও নন-চ্যালেন্টলি আমাকে জবাব দিলেন, ইট ওয়াজ নো প্রবলেম, আপনার বন্ধু ডিকম্যানকে বাসায় বিকালে ড্রিংকসের দাওয়াত দিয়েছিলাম, সে কিছুক্ষণ মদ খেয়ে বিদায় নিল; আর আমাদের উদযাপনও সম্পন্ন হয়ে গেল! ডিকম্যান আমার জেদ্দায় চাকরি করাকালে তার অ্যাম্বেসিতে ‘ডেপুটি হেড’ ছিলেন; সেই সুবাদে আমার বন্ধু।

এখন ৩০ বছর আগে নিউইয়র্কে আমাদের স্থায়ী মিশনে আমার একটি অভিজ্ঞতা। জাতিসংঘের কোনো একটি কমিটিতে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশের আদিবাসীদের অবস্থা, দুরবস্থা নিয়ে আলোচনা হলো কয়েক সেশনে। এ আলোচনাকালে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের ওপর একটি ক্রিটিকেল বক্তৃতা দিলেন নরওয়ের একজন প্রতিনিধি।

আলোচনা শেষে তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা উত্তর মেরুর কাছের মানুষ, তো আমাদের দেশের আদিবাসীদের নিয়ে তোমাদের এত আগ্রহ কেন? এ প্রতিনিধির সঙ্গে আগে জাকার্তায় দুই বছর কাজ করেছি, সুতরাং বন্ধু শ্রেণির। সে বলল, চলো, কফি খাই; তখন তোমাকে ব্যাখ্যা করব। ব্যাখ্যায় বন্ধুটি বলল, আমাদের একজন এমপি আছেন। আমাদের কিছু লোকজন তাকে বোঝাতে সফল হয়েছে, তোমার দেশে তোমাদের আদিবাসীদের ওপর অন্যায় আচরণ করা হচ্ছে। এখন এ এমপি তোমাদের আদিবাসীদের ওপর খেয়াল রাখতে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নিয়মিতই চিঠি লিখে থাকেন; আর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বিষয়টি আলোচনায় উঠাতে আমাদের নির্দেশ পাঠিয়ে থাকেন।

এখন তোমাকে বুঝতে হবে, এমপির আগ্রহ পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপেক্ষা করতে পারেন না; হোক না, তিনি সংখ্যায় মাত্র এক। আমাদের ব্যবস্থায় প্রতিজন এমপিকেই গুরুত্ব দিতে হয়। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও তাই দিয়ে যাচ্ছেন।

এখন বাংলাদেশের ব্যবস্থায় আসুন। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ৩৫০ জন এমপির একজনও কি রোজিনা ইস্যুতে একটিবার মুখ খুলেছেন? তারপরও বিদেশে আমাদের দূতাবাসগুলোকে বলতে হবে, বাংলাদেশে ‘ভাইব্রেন্ট ডেমোক্রেসি’ বিরাজ করছে! ডিজিটাল আইনে আটক থাকা অবস্থায় মুশতাক মাস চারেক আগে জেলে মারা গেলেন।

সারা দুনিয়াতে তখনো আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার (এ পদটির গুরুত্ব আমাদের অনেক মন্ত্রী এবং এমপি জানেন বলে আমার মনে হয় না) মিশেল ব্যাশেলেট (চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট) তখন বাংলাদেশের কাছে দাবি তুলেছিলেন, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট নিয়ে পরে যা করার করুন; কিন্তু এখন এ আইনের প্রয়োগটি স্থগিত রাখুন।

তখন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলছিলেন, এ ডিজিটাল আইনটিকে কীভাবে সংশোধন করে উন্নত করা যায়, সে বিষয়ে এ হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেটের অফিসের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কিন্তু তারপর কী হলো? আনিসুল হক দৃশ্যত ভুলে গেছেন যে, বছর তিন/চার আগে ‘কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চার’ Committee Against Torture (CAT)-এর এক সেশনে তাকে কেমন বিবস্ত্র করে ছাড়া হয়েছিল।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বর্তমান হাইকমিশনার মিশেল ব্যাশেলেটের আগের হাইকমিশনার জর্ডানের প্রিন্স জাইদ রা’দ আল-হোসাইনও ড্রাগ অভিযুক্তদের বিনা বিচারে হত্যা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ সরকারকে। ২০১৮ সালের ৭ জুন ডেইলি স্টারের একটি শিরোনাম ছিল জাইদ রা’দ আল-হোসাইনের এ উক্তিটি দিয়ে-‘Halt Killings of Suspects in Anti-drug Drive’।

জাতিসংঘের একজনের পর একজন মানবাধিকার হাইকমিশনার বাংলাদেশকে আবেদনের পর আবেদন করে যাবেন, আর বাংলাদেশ সরকার তা বারবার অগ্রাহ্য করে যাবে, তো কোন সে দেশের ফরেন মিনিস্ট্রি আন্তর্জাতিকভাবে প্রমাণিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের এমন গুরুতর অভিযোগ সামাল দিতে পারবে?

বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সম্পর্কে যারা খোঁজখবর রাখেন, তারা জানেন, বিদেশের বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশিত কোনো একটি রিপোর্টেও বাংলাদেশে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের ইতিবাচক চর্চা নিয়ে এতটুকুও প্রশংসা নেই; বরং আছে কোথাও কোথাও কঠোর নিন্দা।

অনেকেই ইতোমধ্যে ভুলে গেছেন, গত অক্টোবর মাসে ১০ জন আমেরিকান সিনেটর তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পওকে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত গুম, খুন, ক্রসফায়ার- এসবের অবসান ঘটাতে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে চিঠি লিখেছিলেন। বাংলাদেশে মানবাধিকারের এমন চরম লঙ্ঘনের যে অভিযোগগুলো ১০ জন সিনেটর তুলেছেন, তার সামাল ওয়াশিংটনে আমাদের দূতাবাস কীভাবে দিতে পারে?

আমাদের নেতা-মন্ত্রীরা যখন আমাদের ফরেন মিনিস্ট্রি এবং দূতাবাসগুলোর ব্যর্থতার কথা বলেন, তখন তাদের মনে থাকে না যে, দুনিয়ার ৫০টির মতো দেশের দূতাবাস এ ঢাকা শহরেই আছে। তো ঢাকায় তাদের কাজটি কী? আমাদের সরকারটি কোথায় কী করছে, কতজনকে জেলে নিচ্ছে, কতজনকে কে কোথায় খুন করছে, গুম করছে; সরকারের কোথায় কী সাফল্য, কী ব্যর্থতা-সেসবেরও তো খবর রাখতে হয় এ ৫০টি বিদেশি দূতাবাসকে।

আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে মাঝে মাঝে কেমন দুরবস্থায় পড়তে হয়, এখন তার একটি উদাহরণ। কয়েকদিন আগে দেখলাম, একটি ওষুধ কোম্পানির বড় কর্তা দাবি তুলেছেন, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে চুক্তি মোতাবেক কোভিড টিকা আনতে ভারতের সঙ্গে আমাদের কূটনীতিকে জোরদার করতে হবে! এ লোক বলে কী! কূটনীতি কীভাবে জোরদার করতে হবে, তার কোনো প্রস্তাব নেই!

কিন্তু জোরদার করতে হবে। কেন করতে হবে কয়েকদিনের মধ্যে বোঝা গেল। মাত্র কয়েক সপ্তাহে তার কোম্পানি সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে কয়েক লাখ টিকা আমদানির নামে শুধু হাতবদল করে ৩৮ কোটি টাকা লাভ করে ফেলেছে! আরও কোটি কোটি টাকা লাভ করার লোভে এ লোক এখন চায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়টা তাকে এখন ভাড়া দিতে হবে!

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য এক অকূটনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হয়ে দাঁডিয়েছে অবৈধ, অনির্বাচিত ও জুলুমবাজ সরকারগুলোর জন্য বিদেশ থেকে বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা জোগাড় করা। যে কোনোভাবে ক্ষমতা গ্রহণ করে ফেললেই হলো; তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলা হবে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পররাষ্ট্রনীতি কতটুকু সফল, তা নির্ভর করবে ক্ষমতাগ্রহণকারীর জন্য কতগুলো বিদেশ সফরের আয়োজন করা গেল।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করা গেলে পররাষ্ট্রনীতি দারুণ সফল। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘ইয়েস’ বললে আর কোনো দেশ ও সংস্থাকে গ্রাহ্য না করলেও চলে। আর ওয়াশিংটন সফরকালে ১০/১২ জন সিনেটরের সঙ্গে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করা গেলে পররাষ্ট্রনীতি আরও সফল।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সাফল্যের আরও একটি মানদণ্ড হলো, ক্ষমতা গ্রহণকারীকে কতগুলো আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক সংস্থায় প্রেসিডেন্ট/সংস্থাপ্রধান নির্বাচিত করা।

১৯৯২ সালে আমি যখন নিউইয়র্কে আমাদের স্থায়ী মিশনে ‘ডেপুটি হেড’, তখন আমার এক শিক্ষক, এখন আওয়ামী লীগের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, আমাকে বলেছিলেন, যে সরকার দেশে যত বেশি ব্যর্থ, সেই সরকার বিদেশে তত বেশি সফল হতে চায়।

কিন্তু দেশে ভালো রেকর্ড না থাকলে, রোজিনার মতো কাণ্ড ঘটালে কোনো রাষ্ট্রদূতই যে দেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে পারবে না, এ বোধটুকু আমাদের নেতা-মন্ত্রীদের মধ্যে কখন দেখব?

‘শিউলিতলা’, উত্তরা

মহিউদ্দিন আহমদ : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব

https://www.jugantor.com/todays-paper/sub-editorial/425145/