২৭ মে ২০২১, বৃহস্পতিবার, ২:৪৪

সাত মাসে গুনতে হয়েছে ৩৫৬৯৪ কোটি টাকা

ঋণের সুদ দিতে ব্যয় বাড়ছে সরকারের

উচ্চমাত্রায় সুদ পরিশোধে অর্থনীতি চাপে পড়বে -আশঙ্কা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিডিএমসির

ঋণের সুদ পরিশোধে বাড়ছে সরকারের ব্যয়। চলতি অর্থবছরের (২০২০-২১) প্রথম সাত মাসে ৩৫ হাজার ৬৯৪ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে সুদ পরিশোধে। গত বছর একই সময়ে এ ব্যয় ছিল ৩২ হাজার ৪৯৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ আগের বছরের তুলনায় এই বছরে সুদ বাবদ অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে ৩ হাজার ১৯৮ কোটি টাকা। এই ব্যয় সরকারের সার্বিক মোট ব্যয়ের ২০ দশমিক ৪৪ শতাংশ। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি সংক্রান্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এমন তথ্য।

এদিকে উচ্চমাত্রায় সুদ পরিশোধের কারণে অর্থনীতি চাপে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ‘নগদ ও ঋণ ব্যবস্থাপনা কমিটির (ক্যাশ অ্যান্ড ডেবট ম্যানেজমেন্ট কমিটি বা সিডিএমসি)’। সর্বশেষ এ কমিটির বৈঠকে বলা হয়, করোনায় কাঙ্ক্ষিত হারে রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। ফলে স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডের ব্যয় মেটাতে ব্যাংক, সঞ্চয়পত্র ও ট্রেজারি বিল থেকে বেশি মাত্রায় ধারদেনা করতে হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ নেওয়া হয়েছে। যে কারণে সুদ পরিশোধে ব্যয় বাড়ছে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রাজস্ব আদায়ের গতি ভালো নয়। অন্যদিকে করোনার কারণে নানা ধরনের প্রণোদনা কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিও চলছে। যে কারণে অভ্যন্তরীণ ঋণের পরিমাণ বেড়েছে। আর ঋণ বৃদ্ধির কারণে সুদ পরিশোধ ব্যয়ও বাড়ছে।

বিআইডিএস’র সাবেক ডিজি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরি যুগান্তরকে জানান, দুর্যোগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি, নতুন করে আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি আরও খারাপ দিকে যাবে। এতে ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে ঋণের ওপর আরও নির্ভরশীলতা বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, বিদেশি ঋণ গ্রহণ কঠিন বিধায় অভ্যন্তরীণ ঋণের দিকে যাচ্ছে সরকার। পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ গ্রহণে বেশি সুদ দিতে হচ্ছে। যে কারণে বেড়ে যাচ্ছে সুদ পরিশোধ ব্যয়।

চলতি অর্থবছরে ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৮৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। তবে ঋণ নেওয়া ঠিক করা হয় বাজেট ঘাটতির হিসাব করে। যে পরিমাণ ঘাটতি থাকে সেটি পূরণ করতে ঋণ গ্রহণ করা হয়। মূলত দুটি উৎস থেকে ঋণ নেওয়া হয়। একটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ খাত-ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র এবং আরেকটি হচ্ছে বিদেশি ঋণ। তবে দুটি খাত থেকে জুলাই-জানুয়ারিতে ঋণ নেওয়া হয়েছে ৬৩ হাজার ৮১২৫ কোটি টাকা।

এর মধ্যে ব্যাংকিং খাত থেকে ২৪ হাজার ৮৮০ টাকা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ২০ হাজার ৪৮৭ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে। তবে সঞ্চয়পত্র ব্যুরোর সর্বশেষ হিসাবে সরকার গত মার্চ পর্যন্ত ৮৫ হাজার ৯৯০ কোটি ৬৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে এ খাত থেকে। পাশাপাশি অর্থবছরের ছয় মাসে বিদেশি ঋণ পাওয়া গেছে ১৮ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা।

জানা গেছে, গত জুলাই থেকে জানুয়ারি-এই সাত মাসে অভ্যন্তরীণ খাত থেকে ঋণ গ্রহণের বিপরীতে সুদ পরিশোধে গেছে ৩২ হাজার ৯১২ কোটি টাকা। গত বছরের একই সময়ে ব্যয় হয় ২৯ হাজার ৮৩৫ কোটি টাকা। একইভাবে বিদেশি ঋণের ক্ষেত্রে সুদ গুনতে হয় ২ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা। যা গত বছরের একই সময়ে ব্যয় হয় ২ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সুদ পরিশোধে ব্যয় বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম রাজস্ব আদায়। বিশেষ করে করোনার প্রাদুর্ভাবে চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) রাজস্ব কাঙ্ক্ষিত হারে আদায় হয়নি। মূলত আমদানি-রপ্তানির স্থবিরতা মূল কারণ। এছাড়া রাজস্ব আদায় প্রক্রিয়া ডিজিটাল না হওয়ায় অনেকেই করমুখী হচ্ছে না। সব মিলে কাঙ্ক্ষিত হারে লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কমেছে রাজস্ব আয়। ফলে বড় ঘাটতি সৃষ্টি হওয়ায় ব্যয় মেটাতে সরকার বেশি মাত্রায় ঋণ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঋণ ব্যবস্থাপনা শাখার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, প্রবাসীদের রেমিট্যান্স ও সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের কারণে তারল্য পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক আছে। এটি না হলেও ট্রেজারি বন্ড ও বিল থেকে আরও ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বেড়ে যেত।

অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সুদ পরিশোধসহ অন্যান্য খাতে চলতি অর্থবছরের সাত মাসের সরকারের মোট ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৭৪ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা। এই ব্যয় গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম। এই ব্যয়ের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ও ভাতা খাতে গেছে ৩২ হাজার ৮৩০ কোটি টাকা, পণ্য ও সেবা খাতে ব্যয় ১১ হাজার ৭২২ কোটি টাকা, পূর্তকাজসহ মূলধনী ব্যয় ৫ হাজার ৬৪০ কোটি টাকা। এছাড়া খাদ্য খাতে ২ হাজার ৯৯৭ কোটি টাকা, উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে (এডিপি) ৪১ হাজার ৪৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে।

https://www.jugantor.com/todays-paper/first-page/424767