২৭ মে ২০২১, বৃহস্পতিবার, ২:৩৬

প্রয়োজন এক নতুন সভ্যতার

ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকট আসলে সভ্যতার সংকট। সভ্যতা চাইলে এই সংকটের সমাধান বহু আগেই হয়ে যেতে পারতো। সভ্যতার শাসকরা তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থে অনেক কিছুই করে থাকেন, তবে তার সবকিছু প্রত্যক্ষভাবে উচ্চারিত হয় না। ফলাফলের মাধ্যমে বিষয়গুলো উপলব্ধি করা যায়। বর্তমান সভ্যতায় একটি বিষয়ের চাষাবাস বেশ ভালো হয়েছে। কথামালার এই চাষাবাসে সভ্যতার নায়কদের অবশ্যই কৃতিত্ব দিতে হয়। এই কথামালার বিশেষ তাৎপর্য হলো, সুন্দর সুন্দর কথা বলতে হবে, তবে তা বাস্তবায়ন না করলেও চলবে। কথা ও কাজের এই গড়মিলকে অবশ্য নীতিবান মানুষরা প্রতারণাপূর্ণ কর্ম কিংবা মোনাফেকি আচরণ হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন।

এমন আচরণের সাথে যুক্ত মানুষরা কি কখনো কোনো সংকটের যৌক্তিক সমাধানে সমর্থ হতে পারেন? পারেন না বলেই ফিলিস্তিন সংকটের সমাধান আজও হয়নি। কথামালার সংস্কৃতি বর্তমান সভ্যতায় বেশ প্রবল, আর তা টিকিয়ে রেখেছেন সভ্যতার শাসকরাই। ইসরাইল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে যুদ্ধবিরতি আরও টেকসই করতে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্রিংকেন ২৫ মে তেলআবিবে পৌঁছেছেন। এখন যুদ্ধবিরতি টেকসই করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু যুদ্ধটা লাগলো কেমন করে? যুদ্ধের ইতিহাসটা কেমন? সভ্যতার প্রশ্রয়েই তো ইসরাইল আজ এত উদ্ধত।

ইসরাইলের অপরাধের কোনো শেষ নেই। শুক্রবার আল-আকসা মসজিদে জুমার সালাতের পর আবার ফিলিস্তিনী মুসল্লিদের ওপর হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এই হামলার জবাবে ইসরাইলকে ভণ্ড ও কপট রাষ্ট্র আখ্যা দিয়ে তুরস্ক জানিয়েছে, ইহুদি এই রাষ্ট্রটি তাদের ভণ্ড ও কপটাচারী চরিত্র প্রদর্শন অব্যাহত রেখেছে। উল্লেখ্য যে, অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের পর শুক্রবার ইসরাইল ওই হামলা চালায়। এ প্রসঙ্গে শুক্রবার ইস্তাম্বুলে এক অনুষ্ঠানে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তৈয়ব এরদোগান বলেন, ফিলিস্তিনী ভূখণ্ডে ইসরাইলী দখলদারিত্ব শুরু হওয়ার পর থেকে ফিলিস্তিন মানচিত্র কিভাবে পরিবর্তিত হয়েছে তা তুরস্ক বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা অব্যাহত রাখবে। তিনি বলেন, সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরাইল যে কি জিনিস সে সম্পর্কে সমগ্র বিশ্বের জানা উচিত। ইসরাইল ১৯৪৭ সাল থেকে অবৈধ দখলদারিত্বের মাধ্যমে পুরো ফিলিস্তিনীকে গ্রাস করেছে এবং এখন সেখানে ফিলিস্তিনীদের জন্য কেবল এক মুঠো জমি বাকি আছে।

তুর্কি প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যে বলেন, বিশ্বমানবতা সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের ধারণা নিয়ে যে কথা বলে, সেটা হচ্ছে ইসরাইল। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের সকল নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষ আরও শক্তিশালী তুরস্কের জন্য অপেক্ষা করছে। বর্তমান সভ্যতায় বিশ্বের নির্যাতিত ও বঞ্চিত মানুষ আসলেই মুক্তির অপেক্ষায় আছে। তারা চায় শক্তিশালী এমন কোনো দেশের উত্থান, যারা প্রতারণার বদলে প্রকৃত অর্থেই মজলুম মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবে। আর এখানে একথা উচ্চারণ করা উচিত যে, বর্তমান অমানবিক সভ্যতায় সবচাইতে বেশি নির্যাতিত ও বঞ্চিত ভূখণ্ড হলো ফিলিস্তিন। ফিলিস্তিনীদের ভূখণ্ডে উড়ে এসে জুড়ে বসলো ইহুদীরা। তারা ভূমিপুত্র ফিলিস্তিনীদের ভূমি জবরদখল করে শুধু বসতি স্থাপন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে ফিলিস্তিনীদের এক উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। জঘন্য এই অপরাধের শুরুটা করেছিল বৃটেন, আর এখন তা ষোলকলায় পূর্ণ করছে যুক্তরাষ্ট্র আর তার মিত্ররাষ্ট্রগুলো। তাই একথা স্পষ্ট করেই বলা যায় যে, প্রহসনের এই সভ্যতার নায়কদের কাগুজে বক্তব্যে মজলুম ফিলিস্তিনীদের মুক্তি নেই। এখন প্রয়োজন নতুন সভ্যতার উত্থান। এরদোগান কি সে কথাই বলে গেলেন?

ধ্বংস্তূপ থেকে আবার জেগে উঠছে গাজা। শনিবার থেকে ক্যাফেগুলো খুলেছে, জেলেরা মাছ ধরতে যাচ্ছে, দোকানিরা খুলছে তাদের দোকান। ভীতিকর ১১দিন কাটিয়ে ধীরে ধীরে আবার প্রাণবন্ত হচ্ছে ফিলিস্তিনী জনপদ। অবাক প্রাণশক্তি এদের! ইসরাইলী নৃশংস হামলায় অনেক কিছুই ধ্বংস হয়, কিন্তু ধ্বংস হয় না ভূমিপূত্র ফিলিস্তিনীদের প্রাণশক্তি। বোমা আর কামানের গোলার সাথেই ওদের বসবাস। ইসরাইলী ট্যাঙ্কের সাথে পাথর দিয়ে যুদ্ধ করে অসীম সাহসী ফিলিস্তিনী কিশোরেরা। অসম এ যুদ্ধের চিত্র লক্ষ্য করে যাচ্ছে বিশ্ববাসী। আর বিশ্বনেতারা হয়তো তা উপভোগই করছেন!

তবে ধ্বংসযজ্ঞ ধ্বংসযজ্ঞই। আর কোনো ধ্বংসযজ্ঞের পেছনে যদি সভ্যতার নায়কদের প্রশ্রয় থাকে, তখন তা হয়ে ওঠে মর্মান্তিক। মর্মান্তিক এমন বাস্তবতায় আবার নতুন নির্মাণের সংগ্রামে অবতীর্ণ হবে ফিলিস্তিনীরা। কাজটি অবশ্যই কঠিন। তবে এই কঠিনকে জয় করাইতো ফিলিস্তিনীদের জীবনসংগ্রাম। গাজাবাসী এখন নিজেদের আবিষ্কার করছে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে। একসময় যেখানে ছিল সুউচ্চ ভবন, সেখানে আজ ভাঙ্গা কংক্রিটের স্তূপ। গাজার চেহারা যেন বদলে গেছে। তবে তাদের প্রাণশক্তি এখনো আছে অটুট। তাই গাজা আবার জেগে উঠছে।

নিউইয়র্ক টাইমস এক প্রতিবেদনে গাজা শহরের করুণ অবস্থার চিত্র তুলে ধরেছে। গাজার বাসিন্দা সামি আবুল আউফ এক ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন। একসময় এটি ছিল তার বোনের বাড়ি। আবুল আউফ ভেবেছিলেন, তাদের বাসভবন সামরিক লক্ষ্য হবে না। তবে রোববারের হামলা তার সেই ভাবনা বদলে দিয়েছে। বোমা হামলায় নিহত হয়েছেন তার বোন রিমসহ পরিবারের ১২ জন সদস্য। উত্তর গাজা উপত্যকায় ছয় সন্তানের পিতা রামেজ আল-মাসরি একটি গর্ত দেখিয়ে বলেন, এখানেই আমার বাড়ি ছিল। ফিরে এসে আমার ভবনের জায়গায় বিরাট গর্ত দেখতে পাচ্ছি। এটি আমার জন্য এক বড় ধাক্কা। আর ইউনিসেফ বলেছে, গাজা এলাকায় এক লাখের বেশি মানুষ তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে উদ্বাস্তু হয়েছে। সেখানকার আট লাখ মানুষ খাওয়ার পানির সংকটে রয়েছে। এমন বহু প্রতিবেদন আগেও প্রকাশিত হয়েছে। আসলে ফিলিস্তিনীদের সংকট সভ্যতার সংকট। তাই অধিকার বঞ্চিত ওই মানুষগুলোর সংকট কাটছে না। সংকট মোচনো হয়তো প্রয়োজন হবে নতুন এক সভ্যতার। মানবিক সেই সভ্যতার উত্থানের দিকে তাকিয়ে আাছে ফিলিস্তিনসহ বঞ্চিত বিশ্ববাসী।

https://dailysangram.com/post/453578