২৬ মে ২০২১, বুধবার, ২:২০

করোনায় রাজস্ব ঘাটতিতে বাজেট বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত

করোনা মহামারির কারণে রাজস্ব ঘাটতি বৃদ্ধিতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বাজেট বাস্তবায়ন। প্রথম ধাক্কা সামলে অনেকটাই গতি ফিরে পেয়েছিল কিন্তু দ্বিতীয় ধাক্কায় তা আবার পিছিয়েছে। চলতি অর্থবছরের গত ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব ঘাটতি ৪০ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায় আগের তুলনায় বাড়লেও বাজেট বাস্তবায়ন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে করের আওতা আরও বাড়াতে হবে। এ জন্য আয় বাড়াতে বিকল্প উৎস ঝুঁকছে সরকার।

চলতি অর্থবছরের গত ১০ মাসে (জুলাই-এপ্রিল) রাজস্ব ঘাটতি ৪০ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষ হতে বাকি আছে আর দুই মাস। এই সময়ে ঘাটতি পূরণে নিয়মিত আদায়ের পাশাপাশি জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বকেয়া আদায়ে জোর বাড়িয়েছে। বিশেষভাবে বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর বড় অঙ্কের বকেয়ার একটি টাকাও পরিশোধ করছে না তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায়ে কঠোর অবস্থানে গিয়েছে এনবিআর। এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অনেককে এনবিআরে তলব করে বকেয়া পরিশোধে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এনবি আরের তলবে অনেকে নিজে আসছেন, অনেকে আবার প্রতিনিধি পাঠিয়ে কাজ সারছেন। একই সঙ্গে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইনের আওতায়ও রাজস্ব আদায়ে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নিয়মিত আদায়ের পাশাপাশি বকেয়া আদায়ে জোর দেওয়ায় এনবিআর সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন অর্থবছরের শেষ হিসাবে ঘাটতি থাকবে না।

এনবিআর সদস্য আলমগীর হোসেন বলেন, করোনার কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক ধারা ছিল। এতে রাজস্ব আদায় কম হয়েছে। এনবিআর সারা বছরই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা পূরণে কাজ করেছে। শেষ দুই মাসে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছি। আশা করি লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।

গত বছরের মার্চে দেশে করোনাব্যাধির প্রকোপ শুরু হয়। এর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ে। ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ছিল না। শিল্প খাতে লোকসান হতে থাকে। এতে সামগ্রিকভাবে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ে ধস নামে। গত অর্থবছরের শেষ হিসাবে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ৮৫ হাজার কোটি টাকা। চলতিবারেও ঘাটতি রয়েছে। দেশে করোনারোধে টিকা এলেও করোনার প্রকোপ কমেনি, কবে কমবে তার নিশ্চয়তাও নেই। রাজস্ব আদায়ে বড় অঙ্কের ঘাটতির মুখে চলতি অর্থবছরের জানুয়ারিতে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা তিন লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা থেকে সংশোধন করে কমিয়ে তিন লাখ এক হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়।

গত এপ্রিল পর্যন্ত এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ৩৬ হাজার ২০৭ টাকা। এ সময়ে আদায় হয়েছে এক লাখ ৯৫ হাজার ৬৭১ টাকা। এপ্রিল পর্যন্ত আমদানি-রপ্তানি খাতে সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ৭৮ হাজার ২০৩ কোটি ৪৯ লাখ টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৬১ হাজার ৪৪ কোটি সাত লাখ টাকা। স্থানীয় পর্যায়ে মূসক ৮৬ হাজার ৯০০ টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৭৫ হাজার ২০ কোটি টাকার, আয়কর ও ভ্রমণ কর ৭১ হাজার ১০৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৫৯ হাজার ৬০৭ কোটি ৬৪ লাখ টাকা।

এনবিআর কর্মকর্তাদের জোরালো পদক্ষেপের কারণে চলতি অর্থবছরের (জুলাই-মার্চ) গত ৯ মাসের তুলনায় (জুলাই-এপ্রিল) ১০ মাসে ঘাটতি কিছুটা কমেছে। চলতি অর্থবছরের গত মার্চ পর্যন্ত এনবি আরের রাজস্ব আদায়ের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই লাখ ২৭ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা। এ সময়ে আদায় হয় এক লাখ ৭৮ হাজার ২৬৩ কোটি টাকা। জুলাই-মার্চে ঘাটতি ছিল ৪৯ হাজার ৫০১ কোটি টাকা। চলতি জুলাই-ফেব্রুয়ারিতে রাজস্ব ঘাটতি ছিল ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা।

বিড়ি-সিগারেট খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে এনবিআরের পাওনা পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি। একইভাবে মোবাইল খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছেও সরকারের রাজস্ব পাওনা চার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি ও সিরামিকস খাতেও এনবিআরের বড় অঙ্কের পাওনা আছে।

এনবিআরের কঠোর পদক্ষেপের কারণে মোট রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক ধারা থাকলেও এপ্রিল পর্যন্ত সিগারেট, ফার্মাসিউটিক্যালস এবং মোবাইল খাতে ভ্যাট আদায় গত অর্থবছরের তুলনায় গড়ে ১৯ শতাংশ বেড়েছে। দেশের দুই বড় মাপের ক্লাব ঢাকা ক্লাব লিমিটেডের কাছে ৩৪ কোটি টাকা এবং চট্টগ্রাম ক্লাবের কাছে ২০ কোটি টাকার রাজস্ব পাওনা রয়েছে এনবিআরের। এসব রাজস্ব আদায়েও চলছে জোর উদ্যোগ।

এ ছাড়া বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি আইনের (এডিআর) আওতায় আটকে থাকা মামলা নিষ্পত্তি করে অনাদায়ি রাজস্ব আদায়ে জোর উদ্যোগ নিয়েছে এনবি আর। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিভাগে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের শুল্ক, আয়কর ও মূসক সংক্রান্ত ২৪ হাজার ৫৭২টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আটকে থাকা মামলার বিপরীতে অনাদায়ি আছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব। চলতিবারে আয়করসংক্রান্ত মামলা এডিআরে নিষ্পত্তিতে আবেদনকারীর সংখ্যা ৯৯৮টি। এতে জড়িত রাজস্ব ১০ হাজার ৭১৭ টাকা। ৫৯৭ জন আবেদনকারী বিভিন্ন শুনানি শেষে মামলা নিষ্পত্তিতে পরিপূর্ণ সম্মতি দিয়েছে। আংশিক সম্মতি দিয়েছে ১৫০ জন। ১৯৯ জন সম্মতি দেয়নি। ৫২ মামলায় শুনানি চলছে।

এই ধাক্কা সামলাতে বিকল্প উৎসর সন্ধানে নেমেছে সরকার। নতুন আয়ের উৎস হিসেবে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোতে থাকা উদ্বৃত্ত অর্থ এবং বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলকে টার্গেট করা হচ্ছে। এ দুই খাত থেকে ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি আয় হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানানো হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

এ ব্যাপারে অর্থ বিভাগের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, রাজস্ব আয় নিয়ে আমরা চিন্তিত। তবে যেহেতু এটি আপাতত বাড়ানো যাচ্ছে না, তাই আমরা বিকল্প চিন্তা করেছি। বিকল্প খাতগুলো থেকে প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্থ পাওয়া গেলে ব্যয় নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর ও অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, এগুলো হলো সব পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। রিজার্ভের অর্থে খুব বেশি চাপ দেওয়া ঠিক হবে না। স্বায়ত্তশাসিত এখন ভালো অর্থ দিচ্ছে, পরে যে পারবে তার নিশ্চয়তা কী? তাই বিকল্প উৎস যাওয়ার আগে এনবি আরকে চাপ দিতে হবে। করের জাল বাড়াতে হবে। এনবি আরকে আধুনিকায়ন করতে হবে। আমাদের এত বড় বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) দরকার নেই। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বাদ দিতে হবে। ব্যয় কমাতে হবে। এতে দীর্ঘমেয়াদি সুফল আসবে।

মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্রুত দারিদ্র্য বিমোচন এবং কভিড-১৯ জনিত অভিঘাত মোকাবেলা করে উচ্চতর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারায় প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রয়োজন ব্যাপক বিনিয়োগ। আমাদের রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত এখনো কম রয়েছে। তাই বিনিয়োগের জন্য অর্থায়নের নতুন উৎস অনুসন্ধান জরুরি হয়ে পড়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে নতুন উৎস খুঁজেও পেয়েছে। প্রথম উৎস হিসেবে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলোতে থাকা উদ্বৃত্ত অর্থ আরো বেশি করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ৬৮টি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আরো বেশি অর্থ কিভাবে আনা যায় সে পরিকল্পনা সাজানো হচ্ছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে ১৬ হাজার ৪৬ কোটি টাকা সংগ্রহ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আসতে পারে বলে আশা করছে মন্ত্রণালয়।

দ্বিতীয় উৎস হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিলকে টার্গেট করছে। চলতি মাসের ১৫ তারিখ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই তহবিলের উদ্বোধন করেন। এই তহবিলের মাধ্যমে রিজার্ভের অর্থ উন্নয়ন কার্যক্রমে ব্যবহার করা হবে। প্রাথমিকভাবে লাভজনক হিসাবে বন্দর এবং বিদ্যুৎ প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে। বছরে সর্বোচ্চ দুই বিলিয়ন ডলার বা ১৬ হাজার ৯২৩ কোটি ২৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করা হবে। এ খাত থেকে প্রতি অর্থবছর পাঁচ হাজার কোটি টাকারও বেশি অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হতে পারে বলে ধারণা করছেন অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা।

https://dailysangram.com/post/453453