সিলেট সিটি মেয়রের দফতরে আরিফুল হক চৌধুরী এবং রাসিক মেয়রের দফতরে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। রোববার প্রায় দুই বছর পরে আদালতের নির্দেশে চেয়ারে বসতে না বসতেই তাদেরকে ফের বরখাস্ত করা হয় -যুগান্তর
৩ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১১:২৩

ফের বরখাস্ত বুলবুল-আরিফ

বরখাস্তের বার্তা গউছের হাতেও * রাজনৈতিক নাশকতা, মত বিশেষজ্ঞদের

রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের (সিসিক) মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে ফের বরখাস্ত করা হয়েছে। রোববার স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় এ সংক্রান্ত ফ্যাক্স বার্তা উভয় সিটি কর্পোরেশনে পাঠায়। উচ্চ আদালতের ছাড়পত্র নিয়ে ২৩ মাস পর রোববার দায়িত্বে ফেরেন বুলবুল। আর দুই বছর তিন মাস পর দায়িত্ব পান আরিফুল। তবে দায়িত্ব নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তারা সাময়িক বরখাস্তের বার্তা পান। এ নিয়ে দুই সিটির বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে দিনভর উত্তেজনা ছিল। এদিকে দায়িত্ব নেয়ার ১১ দিনের মাথায় ফের বরখাস্ত হয়েছেন হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ।


জানা যায়, দীর্ঘ ২৩ মাস পর আদালতের রায় পেয়ে রোববার ১০টার পর নগর ভবনে যান রাসিক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। বিকাল ৩টার দিকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে বরখাস্তের একটি ফ্যাক্স বার্তা সিটি কর্পোরেশনে পৌঁছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মুহম্মদ আনোয়ার পাশা স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, বুলবুলের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ায় সিটি কর্পোরেশন আইন-২০০৯ এর ১২ ধারার উপধারা-১ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

তবে এ আদেশকে কতিপয় কর্মকর্তার ‘ষড়যন্ত্র’ দাবি করে মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল যুগান্তরকে বলেন, ‘সুপ্রিমকোর্টের আপিলের রায় নিয়ে আমি চেয়ারে বসেছি। কাজেই আমি এখন থেকে নিয়মিত অফিস করব। কাজ করব। এছাড়া বিগত দুই বছরে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র, কাউন্সিলর ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে, তদন্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

এদিকে দিনভর নানা নাটকীয়তা শেষে বুলবুলকে ফের সাময়িক বরখাস্তের প্রসঙ্গে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার যুগান্তরকে বলেন, ‘আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। আইন মেনেই মন্ত্রণালয় তাকে বরখাস্ত করেছে। এখানে কারাও জোর-জবরদস্তি করে ক্ষমতা ধরে রাখার কিছু নেই।’

প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন জানান, বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীকে নিয়ে মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল নগর ভবনে যান। নগর ভবনে ঢুকেই মেয়র বুলবুল তার দফতরে যান। এ সময় কক্ষটি তালাবদ্ধ থাকায় তিনি পাশেই সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কক্ষে গিয়ে বসেন। সেখানে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন উপস্থিত থাকলেও তিনি মেয়রের হাতে দায়িত্ব তুলে দিতে কোনো উদ্যোগ নেননি। পরে মেয়র বুলবুল সাংবাদিকদের জানান, ‘আদালতের রায় হাতে নিয়ে দায়িত্ব নিতে এসেছি। কিন্তু এসে দেখি কক্ষে তালা।’ বুলবুলের বিরোধী পক্ষই কক্ষে তালা দেয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

বেলা সাড়ে ১১টার দিকে রাসিকের সচিব খন্দকার মাহাবুবুর রহমান মেয়র বুলবুলকে তার কক্ষে নিয়ে বসান। এ সময় বিএনপিপন্থী কাউন্সিলর ও দলীয় নেতাকর্মীদের তোপের মুখে পড়েন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. এবিএম শরীফ উদ্দিন বলেন, ‘মেয়র হিসেবে বুলবুলের দায়িত্ব পালনে কোনো বাধা নেই। আমরা তাকে বাধাও দিচ্ছি না। কিন্তু কে বা কারা মেয়রের কক্ষে তালা দিয়ে গেছে, তা আমার জানা নেই।’

মেয়রের কক্ষ তালাবদ্ধ থাকায় বিএনপি নেতাকর্মীদের মাঝে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বেলা সাড়ে ১২টার দিকে মেয়রের দফতরের পাশের কক্ষে হঠাৎ ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এ সময় বিপুলসংখ্যক পুলিশ নগর ভবনে প্রবেশ করে বহিরাগতদের বের করে দেয়। নগর ভবনের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনুরোধে পুলিশ গিয়ে দুপুর দেড়টার দিকে মেয়রের দফতরের তালা ভেঙে দেয়। এরপরই বুলবুল মেয়রের চেয়ারে বসেন। কিছুক্ষণ পরই সাময়িক বরখাস্তের প্রজ্ঞাপন ফ্যাক্সে নগর ভবনে আসে। এরপরই নগর ভবনের দৃশ্য পাল্টে যায়। এনিয়ে তীব্র ক্ষোভ জানান বুলবুল। পরে তিনি গাড়িতে চড়ে বাসায় চলে যান।

উল্লেখ্য, সরকারবিরোধী অবরোধ-হরতাল চলাকালে বিভিন্ন ঘটনায় দায়ের মোট ১৭টি মামলার আসামি বুলবুল। পুলিশ সদস্য সিদ্ধার্থ সরকার হত্যা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামি হওয়ায় ২০১৫ সালে ৭ মে সিটি মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে মেয়র পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। তবে বুলবুলের আপিলের পর ২০১৬ সালের ১০ মার্চ উচ্চ আদালত তার বরখাস্ত আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। এরপর আইনি লড়াই শেষে গত মঙ্গলবার স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব মাহমুদুল আলম স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা বাস্তবায়নে সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়। এরপরই রোববার দায়িত্ব নিতে নগর ভবনে যান মেয়র বুলবুল।

এদিকে রোববার সকালে সিলেট নগরীর কুমারপাড়াস্থ বাসা থেকে বিপুল সংখ্যক দলীয় নেতাকর্মী ও সমর্থকসহ শোডাউন করে সিটি কর্পোরেশনের অস্থায়ী কার্যালয়ে যান আরিফুল হক চৌধুরী। মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষে পীর হবীবুর রহমান পাঠাগারের আশপাশ এলাকায় কর্মী-সমর্থকদের ঢল নামে। বেলা ১১টার দিকে সিসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ফুল দিয়ে বরণ করেন মেয়র আরিফকে। পরে নগর ভবনের অস্থায়ী কার্যালয়ের মেয়রের দফতরে প্রবশে করেন তিনি। এ সময় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলর ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা এবং কর্মচারী ছাড়াও দলীয় নেতাকর্মীরা তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান।

দুপুরে সিলেট সিটি কর্পোরেশনে বরখাস্তের একটি ফ্যাক্স বার্তা পৌঁছে। এতে বলা হয়েছে, ‘আরিফুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল মামলা-৪/২০০৯ এর সম্পূরক অভিযোগপত্র ২২ মার্চ আদালতে গৃহীত হয়েছে। সেহেতু সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে স্থানীয় সরকার বিভাগ আইন ২০০৯ এর ১২ উপধারা প্রদত্ত ক্ষমতাবলে সাময়িক বরখাস্ত করা হল।’

এ খবরে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ফের বরখাস্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘অতিতের মতো এটিও আইনিভাবে মোকাবিলা করা হবে। আমার সঙ্গে যে বৈরী আচরণ করা হচ্ছে তার বিচারের ভার নগরবাসীসহ দেশবাসীর কাছে ছেড়ে দিলাম। সত্যের জয় একদিন হবেই।’

জানা যায়, ২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জের বৈদ্যের বাজারে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। এ হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলার তৃতীয় সম্পূরক চার্জশিটে মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীকে আসামি করা হয়। ওই বছরের ৭ জানুয়ারি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ এক আদেশে মেয়র আরিফকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। সম্প্রতি এ আদেশের বিরুদ্ধে রিট পিটিশন দায়ের করলে শুনানি শেষে সাময়িক বরখাস্তের আদেশ স্থগিত করেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ বাতিলের জন্য সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে সরকার পক্ষ আবেদন করলে আদালত তা খারিজ করে দেয়। এর মধ্য দিয়ে আরিফের মেয়র পদ ফিরে সব আইনি বাধা দূর হয়। চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি দীর্ঘ কারাভোগের পর সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান আরিফুল হক চৌধুরী। অপরদিকে কারাগারে থাকা অবস্থায় ২০০৪ সালের ২১ জুন সুনামগঞ্জে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় বোমা হামলার ঘটনার প্রায় ১২ বছর পর মেয়র আরিফকে শ্যোন অ্যারেস্ট দেখানো হয়। অবশেষে এ মামলায় ফের বরখাস্ত হলেন মেয়র আরিফ।

বরখাস্ত হবিগঞ্জ পৌর মেয়র গউছ : দায়িত্ব নেয়ার ১১ দিনের মাথায় ফের বরখাস্ত হয়েছেন হবিগঞ্জ পৌরসভার মেয়র জি কে গউছ। রোববার বিকালে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে তার বরখাস্তের আদেশের কপি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পৌঁছে। সুনামগঞ্জে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় বোমা হামলা মামলার অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হওয়ায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

উল্লেখ্য, সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া হত্যা মামলায় ২০১৪ সালে দেয়া সর্বশেষ সম্পূরক অভিযোগপত্রে মেয়র জি কে গউছকে আসামিভুক্ত করা হয়। একই বছর ২৮ ডিসেম্বর তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। সম্প্রতি তিনি উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পান। ২৩ মার্চ মেয়র হিসেবে হবিগঞ্জ পৌরসভার দায়িত্ব নেন তিনি। সুনামগঞ্জে সাবেক এমপি প্রয়াত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভায় বোমা হামলা মামলায়ও তিনি আসামি। এ মামলায় অভিযোগপত্র আদালতে গৃহীত হলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় তাকে বরখাস্ত করে।

বিশেষজ্ঞদের প্রতিক্রিয়া : আইনি লড়াই শেষে দায়িত্বে ফেরার কয়েক ঘণ্টা পর দুই সিটি কর্পোরেশনের ও এক পৌরসভার মেয়রের বরখাস্তের ঘটনাকে রাজনৈতিক নাশকতা বলে উল্লেখ করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড. তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, আইপিইউ সম্মেলন চলাকালে এ ধরনের ঘটনা বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশে ভুল বার্তা যাবে। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হবে।

ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, আদালতের আদেশে দায়িত্বে পুনর্বহালের অল্প সময়ের মধ্যে বরিশাল, সিলেট সিটি কর্পোরেশন ও হবিগঞ্জ পৌর মেয়র বরখাস্তের সংবাদ জেনে খারাপ লেগেছে। জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের বারবার বরখাস্ত করে কাজ করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা শুভ বার্তা বহন করে না। এটা নেতিবাচক চর্চা। এটা দেশ ও রাজনীতির জন্য বড় ক্ষতির কারণ।

আইন বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক বলেন, সুপ্রিমকোর্টের আদেশের শর্তমতে পুনর্বহালের কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আবার সাময়িক বরখাস্তাদেশ আমার দৃষ্টিতে উদ্দেশ্যপূর্ণ। জনগণের ধারণা হবে এর মাধ্যমে আইন প্রয়োগের পরিবর্তে মেয়রদের কাজে বিরত রাখাই সরকারের মুখ্য উদ্দেশ্য। এটা ক্ষমতার অপপ্রয়োগ।

http://www.jugantor.com/first-page/2017/04/03/114528/