৩ এপ্রিল ২০১৭, সোমবার, ১১:২০

নতুন ভ্যাট আইন সংশোধন

২৪ বৈঠকেও ফলাফল শূন্য

ক্ষোভে ফুঁসছেন সাধারণ ব্যবসায়ীরা * দাবি অগ্রাহ্য হলে আন্দোলন ছাড়া উপায় থাকবে না

ব্যবসায়ীদের সুপারিশ অগ্রাহ্য করে নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর করতে যাচ্ছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এ অভিযোগ করে এফবিসিসিআই নেতারা বলছেন, সাধারণ ব্যবসায়ীরা ক্ষোভে ফুঁসছেন। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা প্যাকেজ ভ্যাট বহাল রাখাসহ খুচরা ব্যবসা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের ভ্যাট অব্যাহতির সীমা বাড়ানোর দাবিতে অনড়। এর ব্যত্যয় ঘটলে গত বছরের মতো আন্দোলনে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন তারা। এ অবস্থায় এফবিসিসিআইর শীর্ষ নেতারা চাচ্ছেন আলোচনা-সমঝোতার মাধ্যমে দাবি আদায় করতে। যদিও এর আগে যৌথ কমিটি ও কোর ওয়ার্কিং কমিটির ২৪টি বৈঠকে ফলাফল না পাওয়ায় চরম হতাশ তারা।


দীর্ঘদিন থেকে প্যাকেজ ভ্যাট বহাল, খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের টার্নওভার বৃদ্ধি, ভ্যাট হার সংশোধনের দাবি জানিয়ে আসছিলেন ব্যবসায়ীরা। এ নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে এনবিআরের সঙ্গে দুই দফায় ২৪টি বৈঠক অনুষ্ঠিত হলেও ফলাফল আসেনি।

রোববার ব্যবসায়ী ঐক্য ফোরামের মহাসচিব আবু মোতালেব জানান, এনবিআরের সিদ্ধান্তহীনতায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমাজ মর্মাহত। মিটিংয়ের পর মিটিং হচ্ছে কিন্তু ফল আসছে না। আমাদের সুপারিশ ও দাবি অগ্রাহ্য করা হলে দুর্বার আন্দোলন ছাড়া ব্যবসায়ীদের অন্য কোন উপায় থাকবে না।

এফবিসিসিআইর একাধিক নেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে ভ্যাট আইন সংশোধনে দফায় দফায় ২৪টি সভা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ সভারই কোনো কার্যবিবরণী হয়নি। এজন্য সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হলেও তা কার্যকরের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এনবিআর ব্যবসায়ীদের দাবি উপেক্ষা করেই ১ জুলাই থেকে ভ্যাট আইন কার্যকরের প্রস্তুতি নিয়েছে। যা প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। তারা বলেন, ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা ছাড়া কোনোভাবেই নতুন আইন কার্যকর করা সম্ভব নয়। আর তা করা হলে কঠোর আন্দোলন ছাড়া ব্যবসায়ীদের কাছে অন্য কোনো উপায় থাকবে না বলেও এফবিসিসিআই নেতারা সতর্ক করেছেন।

ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী নেতারা বলছেন, অর্থমন্ত্রী এনবিআরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন করতে। সে অনুযায়ী ২০১৪ সালে যৌথ কমিটি এবং গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর কোর ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। এ দুটি কমিটি ২৪টি বৈঠকে অংশ নিয়ে বেশ কয়েকটি ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছায়। কিন্তু এ পর্যন্ত একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন করেনি এনবিআর। উল্টো আলোচনার নামে প্রহসনের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। কৌশলে সময়ক্ষেপণ করে ব্যবসায়ীদের অন্ধকারে রেখেই আইন বাস্তবায়ন করতে চাচ্ছে। এতে ব্যবসায়ী মহলে ক্ষোভ বাড়ছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকলে ব্যবসায়ীরা আইন বাস্তবায়নে সহায়তা করবেন না।

তাদের মতে, আইন অপরিবর্তিত রেখে বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। যদি তাই হয় তাহলে আইনটি ২০১৫ সালেই করা যেত। অহেতুক বিলম্বের প্রয়োজন ছিল না। সরকার যেহেতু চাচ্ছে আইনটিকে ব্যবসাবান্ধব করতে সে ক্ষেত্রে এনবিআরের অবশ্যই ব্যবসায়ীদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেয়া উচিত। আলোচনার টেবিলে এনবিআর কর্মকর্তারা ঐকমত্যে পৌঁছলেও কাজের ক্ষেত্রে তারা দ্বিমুখী নীতি অনুসরণ করছেন।

এ বিষয়ে এফবিসিসিআইর প্রথম সহ-সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, আইন সংশোধনের বিষয়ে এনবিআর সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। কোর ওয়ার্কিং গ্রুপের ১০টি বৈঠকের একটির কার্যবিবরণীও তৈরি করা হয়নি। যেখানে সরকার প্রধান বাণিজ্য পদ্ধতিকে সহজতর করতে চায় সেখানে এনবিআরের এ ধরনের ভূমিকায় ব্যবসায়ীরা আস্থা হারাচ্ছেন। তারপরও উদ্ভূত সমস্যা সমাধানে আলোচনা চালিয়ে যেতে চাই।

এফবিসিসিআইর উপদেষ্টা মনজুর আহমেদ বলেন, নতুন ভ্যাট আইনে মৌলিক কিছু ব্যাপারে ব্যবসায়ীদের আপত্তি আছে। এগুলো অপরিবর্তিত রেখে আইন বাস্তবায়নের সুযোগ নেই। বলা যায়, আইনটি এখনও বাস্তবায়নের অবস্থায় আসেনি। নতুন আইনে বহুজাতিক কোম্পানি ছাড়া ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা মারাত্মক বিপর্যস্ত হবে। এছাড়া সম্পূরক শুল্কের বিষয়েও খোলাসা করে কিছু বলা হয়নি। সম্পূরক শুল্ক উঠে গেলে স্থানীয় শিল্প সুরক্ষা হারাবে। বর্তমানে আইন বাস্তবায়ন করা হলে কোন খাতে কি প্রভাব পড়তে পারে তা বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সামগ্রিক তুলে ধরা হবে।

এদিকে ২৩ মার্চ প্রাক-বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে এফবিসিসিআইর পরিচালক আবু নাসের হুশিয়ারি দিয়ে বলেন, ভ্যাট আইন নিয়ে একবার ব্যবসায়ীরা রাস্তায় নেমেছিলেন। তখন এফবিসিসিআইয়ের উদ্যোগ নেয়ায় ব্যবসায়ীরা ঘরে ফিরেছিলেন। কিন্তু বারবার আমরা (এফবিসিসিআই) উদ্যোগ নেব না।

তিনি আরও বলেন, ভ্যাটের বিষয়ে এখন পর্যন্ত ব্যবসায়ী মহল ও এনবিআরের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির অবসান হয়নি। সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রীও নির্দেশনা দিয়েছেন। সামনে জাতীয় নির্বাচন রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হবে না, যাতে দেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালের ১ জুলাই নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে পরপর ২ বছর সেটি পিছিয়ে চলতি বছরের ১ জুলাই তা বাস্তবায়নের দিন ধার্য করা হয়। অথচ যেসব দাবির কারণে ২ বছর আইন বাস্তবায়ন পেছানো হয়েছে তার একটিরও সুরাহা হয়নি। সর্বপ্রথম নতুন ভ্যাট আইন সংশোধনে ব্যবসায়ীদের দাবি পর্যালোচনা করতে ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর এনবিআরের সাবেক সদস্য আলী আহমেদকে চেয়ারম্যান করে ৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির কো-চেয়ারম্যান করা হয় এফবিসিসিআইর সাবেক প্রথম সহ-সভাপতি জসিম উদ্দীনকে। ওই কমিটি ১৩টি বৈঠকের পর ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি শেষ পর্যন্ত ১০টি ধারা পরিবর্তনের সুপারিশ করে। যাতে এনবিআরের ৪ সদস্যের স্বাক্ষরও আছে। অথচ এসব সুপারিশের একটিও পরে আমলে নেয়া হয়নি। এরপর গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর শুল্কনীতির জ্যেষ্ঠ সদস্য ফরিদ উদ্দিনকে সভাপতি করে চলতি বছরের বাজেটের ওপর এফবসিসিআইর সুপারিশ পর্যালোচনা করতে একটি কোর ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। যেখানে নতুন ভ্যাট আইন সংশোধনের সুপারিশও উঠে আসে। এ কমিটিতে এফবিসিসিআই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে দেন প্রথম সহ-সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। ১০টি বৈঠক করে কোর ওয়ার্কিং কমিটি।

 

http://www.jugantor.com/last-page/2017/04/03/114536/